বুধবার, ১৬ জুলাই, ২০২৫

ফেসবুক


ইউটিউব


টিকটক

Rupali Bangladesh

ইনস্টাগ্রাম

Rupali Bangladesh

এক্স

Rupali Bangladesh


লিংকডইন

Rupali Bangladesh

পিন্টারেস্ট

Rupali Bangladesh

গুগল নিউজ

Rupali Bangladesh


হোয়াটস অ্যাপ

Rupali Bangladesh

টেলিগ্রাম

Rupali Bangladesh

মেসেঞ্জার গ্রুপ

Rupali Bangladesh


রেজাউল করিম মানিক, রংপুর

প্রকাশিত: জুলাই ১৬, ২০২৫, ০২:৩৭ এএম

চোখের জল শুকানোর আগে বিচার দেখতে চান বাবা-মা

রেজাউল করিম মানিক, রংপুর

প্রকাশিত: জুলাই ১৬, ২০২৫, ০২:৩৭ এএম

চোখের জল শুকানোর আগে বিচার দেখতে চান বাবা-মা

‘আমার ছেলেকে যারা হত্যা করল তারা এখনো বাইরে ঘুরে বেড়ায়, চাকরি করে! তাদের তো ধরে না। এখনো বিচারও হইল না, বিচার আর কোনো দিন হইবে?’ অশ্রুসিক্ত চোখে আক্ষেপ করে কথাগুলো বলছিলেন জুলাই গণঅভ্যুত্থানের প্রথম শহিদ রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদের মা মনোয়ারা বেগম। ছেলে পুলিশের গুলিতে নিহত হওয়ার এক বছর অতিবাহিত হলো। অথচ ছেলে হত্যার বিচারের কোনো অগ্রগতি নেই, বাইরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন আসামিরা। আদৌ কি ছেলে হত্যার বিচার পাবেন এমন কথা মনে করে কাঁদছেন শহিদ আবু সাঈদের বাবা মকবুল হোসেন।  তাদের চোখে মুখে ক্ষোভ আর আক্ষেপের চিহ্ন। ছেলে হত্যার বিচারের অপেক্ষায় থাকা শোকে মুহ্যমান মা মনোয়ারা প্রিয় সন্তানের ছবির দিকে তাকিয়ে শুধুই প্রশ্ন করেন, ‘আমার ছেলের দোষটা কী ছিল?’ রংপুরের পীরগঞ্জের বাবনপুরে আবু সাঈদের গ্রামের বাড়িতে গিয়ে এমন দৃশ্য চোখে পড়ল। এ প্রেক্ষাপটের মধ্যে জুলাই গণঅভ্যুত্থানে নিহত আবু সাইদের মৃত্যুর এক বছর পূর্ণ হচ্ছে আজ। সরকারের আশ্বাসের মধ্যেই যেন সীমাবদ্ধ না থাকে আবু সাঈদ হত্যার বিচার। 

সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে গত বছরের ১৬ জুলাই দুপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়-সংলগ্ন পার্ক মোড় এলাকায় পুলিশের গুলিতে নিহত হন আবু সাঈদ। যে ঘটনায় দেশজুড়ে আলোড়ন তৈরির পাশাপাশি আন্দোলনের পালে লাগে জোর হাওয়া। বিশ্ববিদ্যালয়টির ইংরেজি বিভাগের ১২তম ব্যাচের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ ছিলেন ওই আন্দোলনের অন্যতম সক্রিয় মুখ। বিক্ষোভরত অবস্থায় পুলিশের গুলিতে অসময়ে নিভে যায় তার জীবন প্রদীপ। সেদিন থেকে শুরু হয় আবু সাঈদের পরিবারের শোকযাত্রা, আর বিচারের জন্য দীর্ঘ অপেক্ষা। ছেলে হারানোর পর থেকেই ছেলের কবরের পাশে বসে দিনের বেশির ভাগ সময় কাটে মনোয়ারা বেগমের। দরজার পাশে বসে থাকেন একাকী, চোখে সর্বক্ষণ জলের রেখা।

বিলাপ করতে করতে মনোয়ারা বেগম বলেন, ‘আমার ছেলের কি দোষ আছিল! সে তো কোনো দোষ করে নাই। কিন্তু গুলি করি হামার ব্যাটাক মারি ফেলাইছে। এক বছর হয়া গেইলেও এখনো বিচার হইলো না! হামার কোনো চাওয়া নাই, যারা খুন করছে তাদের যেন শাস্তি হয়।’ এ কথাগুলো বলেই কান্নার ভারে ফের থেমে যান মনোয়ারা বেগম।
শহিদ আবু সাঈদের মা মনোয়ারা বেগম কথা বলার সময় পাশে বসা বাবা মকবুল হোসেন কথা বলছিলেন একবুক গর্ব ও কষ্টের মিশ্র অনুভূতি নিয়ে। তিনি বলেন, ‘দুনিয়ার সব মানুষ আছে; কিন্তু আমার ছেলে নাই, এ দিক দিয়ে খুব দুঃখ পাই। কিন্তু আমার ছেলের উছিলায় অনেক আলেম-ওলামা জেল থেকে ছাড়া পাইছেÑ এইটা ভাবলে গর্ব হয়।’ আমার ছেলে জীবন দিয়েছে, আমার ছেলেকে তো শেখ হাসিনার নির্দেশেই পুলিশ গুলি করে হত্যা করা হয়েছে, আমি কি শেখ হাসিনাসহ সব আসামির বিচার পাব? 

আবু সাঈদের বাবার চোখে একরাশ শোক থাকলেও সন্তানের আত্মত্যাগ যে বড় কিছু পরিবর্তনের সূচনা করেছে, তাতে যেন এক ধরনের তৃপ্তিও খুঁজে পান তিনি। মকবুল হোসেন বলেন, ‘আমি চাই সরকার যেন আমার ছেলের হত্যার বিচার করুক। আমার ছেলের সঙ্গে আরও হাজার হাজার মানুষ শহিদ হইছে, অনেক বাপ-মার বুক খালি হইছে। আমি চাই, এমনটা যেন আর কোনো মায়ের সঙ্গে না হয়। যা হইছে আমার, তা যেন আর কারো না হয়।
আক্ষেপ নিয়ে মকবুল হোসেন বলেন, এক বছর হয়ে গেল, মাত্র চার ন অপরাধীকে সরকার গ্রেপ্তার করল। আর সবাই এখনো বহাল তবিয়তে থাকল, আমার কি এ জনমে আমাদের ছেলে হত্যার বিচার পাব? 
এদিকে আবু সাঈদ হত্যা মামলার আনুষ্ঠানিক অভিযোগ আমলে নিয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। একইসঙ্গে এ মামলার ৩০ আসামির মধ্যে পলাতক ২৬ জনের বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনাল-২ গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে। তাদের মধ্যে আছেন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য মো. হাসিবুর রশীদ। ট্রাইব্যুনাল-২-এ এ আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করে চিফ প্রসিকিউটর কার্যালয়। আনুষ্ঠানিক অভিযোগে ৩০ জনকে আসামি করা হয়। যাদের মধ্যে মাত্র চারজন গ্রেপ্তার আছেন। তারা হলেন- বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক প্রক্টর শরিফুল ইসলাম, পুলিশের সাবেক সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) আমির হোসেন, সাবেক কনস্টেবল সুজন চন্দ্র রায় ও নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগের নেতা ইমরান চৌধুরী ওরফে আকাশ।

এর আগে গত ২৬ জুন আবু সাঈদ হত্যাকা-ের ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় তদন্ত প্রতিবেদন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা থেকে প্রসিকিউশনের কাছে জমা দেওয়া হয়।
তবে এর মধ্যেই এ প্রতিবেদন নিয়ে সন্দেহ ও অসন্তোষ প্রকাশ করেছে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের একটি অংশ। তারা এ হত্যা মামলার প্রতিবেদন দাখিলের আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও সংশ্লিষ্ট সবাইকে নিয়ে গণশুনানির দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে আসছেন।

সংবাদ সম্মেলন করে তারা জানিয়েছেন, তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের আগে ২৩ জুন রংপুরে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের একটি গণশুনানি আয়োজনের কথা ছিল। কিন্তু শেষ মুহূর্তে তা বাতিল করে দেওয়া হয়। এ ঘটনায় তদন্ত প্রক্রিয়া নিয়ে সংশ্লিষ্টদের মধ্যে সন্দেহ ও অনাস্থা তৈরি হয়েছে।

আবু সাঈদ হত্যা মামলার অন্যতম সাক্ষী ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী শাহরিয়ার সোহাগ সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের বিষয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল এক সংবাদ সম্মেলন করেছে। সেখানে তারা এ ঘটনার সঙ্গে ৩০ জনের সম্পৃক্ততার কথা উল্লেখ করেন। তবে এবারও অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে তারা পুলিশের সম্পৃক্ততার বিষয়টি এড়িয়ে গেছেন। তারা একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষককে প্রশাসনিক দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগে অভিযুক্ত হিসেবে উল্লেখ করলেও পুরো বক্তব্যে পুলিশের কোনো সংশ্লিষ্টতার কথা উল্লেখ করেননি। অথচ জাতিসংঘের একটি তদন্ত প্রতিবেদনে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, আবু সাঈদ হত্যাকা- ছিল একটি পরিকল্পিত পুলিশি হত্যাকা-।’

শাহরিয়ার সোহাগ বলেন, ‘দুটি বিষয়কে কেন্দ্র করে আমরা গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করছি। প্রথমত, একটি পরিকল্পিত পুলিশি হত্যাকা-কে সচেতনভাবে ‘প্রশাসনিক হত্যাকা-’ হিসেবে উপস্থাপন করা হচ্ছে। দ্বিতীয়ত, যেসব ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তা এ ঘটনার জন্য দায়ী, তাদের তদন্ত থেকে সূক্ষ্মভাবে পাশ কাটিয়ে দেওয়া হচ্ছে।’

অবশ্য আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের ওপর আস্থা আছে বলে জানিয়েছেন শহিদ আবু সাঈদের বড় ভাই আবু হোসেন। তিনি বলেন, ‘অভিযোগ দাখিল পিছিয়ে গেছে এটা নিয়ে কোনো সমস্যা নেই। তবে আমার একটা বিশ্বাস আছে, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল থেকে যেটা প্রতিবেদন আসবে, সেটা সঠিক ও সত্যনিষ্ঠ হবে।’

তার পরিবার ন্যায়বিচার চায় উল্লেখ করে রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের একাংশের আন্দোলন নিয়ে প্রশ্ন তোলেন আবু হোসেন। তিনি বলেন, ‘আন্দোলনটা কতটা যুক্তিসংগত, আমি জানি না। আবু সাঈদের যারা সহযোদ্ধা ছিলেন, যারা এখনো আন্দোলনে আছেন, তাদের সঙ্গে বসে, তাদের কথা শুনে চূড়ান্ত প্রতিবেদন তৈরি করা উচিত। আমরা চাই ন্যায়বিচার, না কোনো নিরপরাধ ব্যক্তি ফাঁসুক, না কোনো প্রকৃত অপরাধী ছাড় পেয়ে যাক।’

বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ড. শওকাত হোসেন বলেন, এ বিশ্ববিদ্যালয়ের গর্ব শহিদ আবু সাঈদ হত্যার সুষ্ঠু বিচার অবশ্যই হবে, সব আসামি গ্রেপ্তার হবে। কোনো আসামি ছাড় পাবে না। 
রংপুর রেঞ্জ ডিআইজি আমিনুল ইসলাম বলেন, আবু সাঈদ হত্যার বিচার অবশ্যই হবেÑ এ নিয়ে সংশয়ের কোনো কারণ নেই। সব আসামি গ্রেপ্তার হবে এবং বিচারের মুখোমুখি হবে। যারা দেশে রয়েছে তাদের গ্রেপ্তারে চেষ্টা চলছে।

রূপালী বাংলাদেশ

Shera Lather
Link copied!