মঙ্গলবার, ২২ জুলাই, ২০২৫

ফেসবুক


ইউটিউব


টিকটক

Rupali Bangladesh

ইনস্টাগ্রাম

Rupali Bangladesh

এক্স

Rupali Bangladesh


লিংকডইন

Rupali Bangladesh

পিন্টারেস্ট

Rupali Bangladesh

গুগল নিউজ

Rupali Bangladesh


হোয়াটস অ্যাপ

Rupali Bangladesh

টেলিগ্রাম

Rupali Bangladesh

মেসেঞ্জার গ্রুপ

Rupali Bangladesh


রূপালী প্রতিবেদক

প্রকাশিত: জুলাই ২২, ২০২৫, ০১:২৪ এএম

বার্ন ইউনিটে মায়ের আহাজারি ‘আল্লাহ এত কষ্ট কিসের জন্য দিলা’

রূপালী প্রতিবেদক

প্রকাশিত: জুলাই ২২, ২০২৫, ০১:২৪ এএম

বার্ন ইউনিটে মায়ের আহাজারি  ‘আল্লাহ এত কষ্ট কিসের জন্য দিলা’

‘আল্লাহ আমার বাচ্চাকে আমার কাছে ফিরাইয়া দাও। আমার বাচ্চাকে সুস্থ করে দাও। সুস্থ পোলা কেমনে শেষ হয়ে গেল। ও আল্লাহ এত কষ্ট কিসের জন্য দিলা’ বুকের ওপর হাত চাপড়ে এভাবেই জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের জরুরি বিভাগে বিলাপ করছিলেন ছোট্ট আরিয়ানের মা মনিকা আক্তার আঁখি। মাহিদ হাসান আরিয়ান মাইলস্টোনের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র। প্রতিদিনের মতো গতকাল সোমবার সকাল ৭টার দিকে স্কুলে যায় আরিয়ান। বিকেল ৩টায় কোচিং শেষ করে বাসায় ফেরার কথা ছিল তার। কিন্তু ক্লাস শেষ করে কোচিংয়ের জন্য প্রস্তুতি নেওয়ার সময়ই ঘটে বিপত্তি। বাসায় ফেরা হলো না আরিয়ানের। বিমানবাহিনীর যুদ্ধবিমান বিধ্বস্তে আগুনে পুড়ে হাসপাতালের বিছানায় কাতরাচ্ছে শিশুটি। আরিয়ানের শরীরের অর্ধেকই পুড়ে গেছে বলে জানিয়েছেন তার স্বজনরা। 

রাজধানীর উত্তরার দিয়াবাড়িতে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ভবনে যুদ্ধবিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় দগ্ধ শিক্ষার্থীদের একটি বড় অংশের চিকিৎসার জন্য আনা হয় জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে। এখানে গতকাল বিকেল পর্যন্ত প্রায় শতাধিক অগ্নিদগ্ধকে নেওয়া হয়। এর মধ্যে চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী আরিয়ান, সপ্তম শ্রেণি পড়ুয়া শায়ান, তৃতীয় শ্রেণি পড়ুয়া জুনায়েদ হাসানসহ আরো বহু শিক্ষার্থী। জরুরি বিভাগের বাইরে অপেক্ষায় ছিলেন এসব শিক্ষার্থীর অভিভাবক। যাদের আহাজারিতে ভারী হয়ে ওঠে সেখানকার পরিবেশ। আবার কেউ কেউ তাদের নিখোঁজ সন্তানদের খুঁজতে হাসপাতালের বিভিন্ন তলায় তলায় ঘুরছেন অশ্রুসিক্ত নয়নে। দগ্ধদের রক্তের প্রয়োজনে হাহাকার করতে দেখা গেছে হাসপাতালের বাইরে। একসঙ্গে এত রোগীকে সেবা দিতে হিমশিম খান সেখানকার চিকিৎসকরা। হাসপাতালের কর্তব্যরত চিকিৎসকরা বলছেন, ভর্তি হওয়া রোগীদের মধ্যে অধিকাংশের অবস্থাই আশঙ্কাজনক। 

গতকাল জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে সরেজমিনে দেখা গেছে, বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় আহতদের নিয়ে একের পর এক অ্যাম্বুলেন্স আসতে থাকে ইনস্টিটিউটের ইমারজেন্সি গেটে। কোনো দগ্ধ রোগীর সঙ্গে স্বজন রয়েছে আবার কারো সঙ্গে নেই কেউ। হাসপাতালের স্টাফরা অ্যাম্বুলেন্স থেকে দগ্ধদের ট্রলিতে করে জরুরি বিভাগে নিয়ে যান। আহতদের স্বজনের খোঁজে হচ্ছিল মাইকিং। হাসপাতালের প্রতিটি ফ্লোর স্বজনদের আহাজারিতে ভারি হয়ে ওঠে। কেউ তাদের সন্তান বা স্বজনকে খুঁজছে, আবার কেউ তাদের স্বজনদের সান্ত¡না দিচ্ছেন। প্রতিটি ওয়ার্ডের সামনেই স্বজনদের আহাজারি করতে দেখা যায়। এ ছাড়া আহতদের রক্ত এবং অন্যান্য সহযোগিতা নিশ্চিত করতে বিভিন্ন স্কুলের স্কাউট দলসহ কয়েকটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন সক্রিয়তা দেখা গেছে। তবে উৎসুক জনতার ভিড় ও ফেসবুক লাইভ করতে থাকা অনেকের জন্য চিকিৎসাসেবা ব্যাহত হওয়ার চিত্রও দেখা গেছে। 

সারা শরীর পুড়ে যাওয়া ১১ বছর বয়সি আরিয়ানের যখন জরুরি বিভাগের ভেতরে চিকিৎসা চলছিল, বাইরে বসে তার মা মনিকা আক্তার আঁখি কাঁদতে কাঁদতে বলেন, সকাল ৭টায় স্কুলে যায় আরিয়ান। দেড়টায় ছুটি হওয়ার কথা ছিল, এরপর দেড়টা থেকে সাড়ে তিনটা পর্যন্ত কোচিং। সকালে ছেলেরে খাবার দিয়া দিছি, এর মধ্যে এই ঘটনা ঘটল।’ তিনি জানান, স্কুলের কাছেই বাসা থাকায় দুর্ঘটনার খবর পেয়ে ছেলের খোঁজে স্কুলে ছুটে যান। এরপর গিয়ে ওই মা ছেলেকে দগ্ধ অবস্থায় পান। সেখান থেকে তাকে প্রথমে বাংলাদেশ মেডিকেলে নেওয়া হয়। ওই হাসপাতাল থেকে আরিয়ানকে বার্ন ইনস্টিটিউটে পাঠিয়ে দেয় উন্নত চিকিৎসার জন্য।

সপ্তম শ্রেণির শায়ানের শরীরের বেশির ভাগ অংশ পুড়ে গিয়েছে বলে জানিয়েছেন তার ফুপু রুবিনা আক্তার। উত্তরা ১০ নম্বর সেক্টরের এই বাসিন্দা বলেন, সকাল বেলা সুস্থ ছেলেটা বাসা থেকে বের হইল, আর এখন হাসপাতালে।
তৃতীয় শ্রেণি পড়ুয়া জুনায়েদ হাসানের মা ঝর্না আক্তারও জরুরি বিভাগের সামনে কাঁদছিলেন। তিনি বলেন, ‘আর একটু পরেই ছুটি হইলে ছেলে বাসায় চলে যেত। আর এখন ছেলে আমার আইসিইউতে। আমার ছেলের রোল নম্বর- ২০৬৬। স্কুল থেকে ফোন দিয়ে বলছে আমার ছেলে দগ্ধ হয়েছে। জুনায়েদকে হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে।  

বিমান বিধ্বস্তের ঘটনাটি প্রত্যক্ষভাবে দেখছিলেন বলে জানায় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী সাইমুন খান। তিনি বলেন, ঘটনার সময় ক্লাসে ছিলাম। তারপর বিকট শব্দ শুনে দেখি আগুন, অবস্থা খারাপ। এ সময় জুনিয়রদের শিফটটা চলছিল। মুহূর্তেই দেখতে পাই আগুন ও ধোঁয়া। এর কিছুক্ষণের মধ্যেই সেনাবাহিনীর সদস্যরা এসে উদ্ধার কাজ শুরু করে। তারপর ফায়ার সার্ভিস আসে। এর মধ্যে এক আন্টি বলেন, বাবা আমার মেয়েকে একটু ধরো, তার দুই হাত পুড়ে গেছে। পরে তাকে নিয়ে হাসপাতালে এসেছি।

বন্ধুর বোনকে দগ্ধ অবস্থায় হাসপাতালে নিয়ে আসেন কলেজের একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী সাজ্জাদ আহম্মেদ আদি। তিনি বলেন, ‘তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী রাদিয়ার ডান হাত পুড়ে গেছে। ওর হাতের অবস্থা খারাপ। জানি না কী হবে।’ বিমান বিধ্বস্তের সময় কলেজেই ছিলেন আদি। পুরো ঘটনার বিষয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘কলেজে একটু পড়েই পরীক্ষা ছিল আমার। স্কুলের ইংরেজি ভার্সন ছুটি হলেও বাংলা ভার্সনের ক্লাস চলছিল। এমন সময় দেখলাম বিমান যাচ্ছে, এরই মধ্যে কিছু একটা পড়ছে বুঝতে পাড়ছি। সবচেয়ে ছোট মাঠ ও কলেজের মেইন গেটের সামনে পড়ছিল বিমানটি। সেখানে বাংলা ভার্সন, কলেজ হোস্টেল ও ক্যান্টিন ছিল।’

আইসিইউতে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে অনেকে: বিধ্বস্তের ঘটনায় শতাধিক শিক্ষার্থীদের ঢাকা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ভর্তি রয়েছে। তাদের মধ্যে অনেকেই আইসিইউতে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে। বার্ন ইনস্টিটিউটের তথ্য মতে, দগ্ধদের সবার বয়স ৯ থেকে ১০ বছরের মধ্যে। তাদের মধ্যে আশরাফুল ইসলামের ১৫ ভাগ, রোহান ৫০ ভাগ, শ্রেয়া ৫ ভাগ, কাব্য ২০ ভাগ, চান মিয়া ৪০ ভাগ, ইউশা ৬ ভাগ, মেহেরিন চৌধুরি ১০০ ভাগ, মেহরীন ৪ ভাগ, রুপি বড়ুয়া ৬ ভাগ, তাসমিয়া ৫ ভাগ, ইমন (জানা যায়নি), নাজিয়া ৮০ ভাগ, জায়ানা ৮ ভাগ, এরিকসন ১০০ ভাগ, সায়েবা ৮ ভাগ, পায়েল ১০ ভাগ,  আবির ২০ ভাগ, কাফি ১০ ভাগ, মুনতাহা ১০ ভাগ, আলভিনা ৫ ভাগ, নিলয় ১৮ ভাগ, মাসুম ৬০ ভাগ, আয়েন ৬০ ভাগ, মাহতাব ৪০ ভাগ, আরিয়ান ৫৫ ভাগ, মকিন ৬২ ভাগ, আবির ৯০ ভাগ ও আনিজন ১০০ ভাগ দগ্ধ হয়েছে। এ ছাড়া আইসিইউতে আছে নাফিস, শামীম, শায়ান ইউসুফ, মাহিয়া, আফনান, ফাইয়াজ ও সামিয়া নামে আরও অনেকে। এদের সবার অবস্থা আশঙ্কাজনক বলে জানায় চিকিৎসকরা। 

অ্যাম্বুলেন্স দেখলেই ছুটছেন স্বজনরা: হাসপাতালে আহত-নিহত স্বজনরা শোকে পাথর হয়ে গেছেন। একে একে অ্যাম্বুলেন্স আসছে, সঙ্গে সঙ্গে শত শত মানুষ ছুটে যাচ্ছে সেটির পেছনে, যেন এই গাড়িটিতেই আছে তার দগ্ধ শিশুটি বা স্বজন। অ্যাম্বুলেন্স আসলেই হাসপাতাল স্টাফদের মাকিং- পাশে যান, রোগীদের ভিতরে ঢুকতে দিন। রক্তের প্রয়োজনের বিষয়টিও বারবার ঘোষণা করা হচ্ছে। কখনো মাইকিং, কখনো কাগজে লিখে জানানো হচ্ছে- দগ্ধ শিশুদের রক্ত লাগবে। কেউ কেউ আবার চিৎকার করে জানাচ্ছেন, রক্ত লাগবে, অমুক গ্রুপের রক্ত দরকার। অনেকে নিজেরা কাগজে লিখে জানাচ্ছেন তারা রক্ত দিতে চান। বিশেষ করে ও এবং এ নেগিটিভ রক্ত সংগ্রহে চলে মাইকিং। ইমার্জেন্সি রেসকিউ টিমের সদস্যরা বলেন, অ্যাম্বুলেন্সে করে দেড় থেকে দুই হাজার ডোনার হাসপাতালে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। নেগিটিভ রক্ত সংগ্রহে চলছে মাইকিং।

ফেসবুকজুড়ে ‘মাইলস্টোনের জন্য প্রার্থনা’: প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হয়ে ২০ জনের মৃত্যু ও ১৭১ জন আহত হওয়ার ঘটনায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমজুড়ে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। এই মর্মান্তিক ঘটনায় কলেজের শিক্ষক-শিক্ষার্থী, প্রাক্তন শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন স্তরের মানুষ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাদের গভীর শোক ও সমবেদনা প্রকাশ করেছেন। বিমান দুর্ঘটনার খবরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকজুড়ে দেখা যায় শোকের ছাপ। মাইলস্টোন কলেজের অনেকেই নিহতদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে আবেগঘন স্ট্যাটাস ও প্রোফাইল ছবি পরিবর্তন  করেছেন। ‘প্রে ফর মেইলস্টোন’ শিরোনামে নিহতদের আত্মার শান্তি কামনা এবং আহতদের দ্রুত সুস্থতা কামনায় শত শত পোস্ট শেয়ার করা হচ্ছে। আবার অনেকে শোক প্রকাশের পাশাপাশি আহদের জন্য প্রয়োজনীয় রক্তসহায়তা চেয়ে পোস্ট দিচ্ছেন।

রূপালী বাংলাদেশ

Shera Lather
Link copied!