বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী চা শিল্প টিকে থাকার লড়াইয়ে নেমেছে। দেড় শতাব্দী পুরোনো এই শ্রমনির্ভর খাতটি একদিকে উৎপাদন খরচের লাগামছাড়া বৃদ্ধি, অন্যদিকে নিলামে চায়ের দরপতন, শ্রমিক মজুরি বেড়ে যাওয়া এবং ব্যাংক ঋণের অসহযোগিতায় সংকটজনক অবস্থায় পৌঁছেছে।
দেশে প্রায় পাঁচ লক্ষাধিক মানুষের জীবিকার উৎস এ শিল্পে স্থবিরতা নামলে জাতীয় অর্থনীতি ও সামাজিক স্থিতিশীলতায় ভয়াবহ প্রভাব পড়বে বলে আশঙ্কা সংশ্লিষ্টদের। এই সংকট নিরসনে বাংলাদেশীয় চা সংসদ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের জরুরি হস্তক্ষেপ, ঋণ পুনঃতপশিল এবং ৪৫০০ কোটি টাকার বিশেষ তহবিল গঠনের আহ্বান জানিয়েছে।
বাংলাদেশীয় চা সংসদ (বিটিএ) সম্প্রতি গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুরকে একটি দিয়েছেন। যার একটি অনুলিপি রূপালী বাংলাদেশের হাতে এসেছে। ওই চিঠিতে চা শিল্পের ভয়াবহ বাস্তবতা ও একাধিক গঠনমূলক প্রস্তাব তুলে ধরা হয়েছে। শিল্পটিকে বাঁচাতে তারা যে পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন, তার মধ্যে রয়েছে অভ্যন্তরীণ ঋণ ঝুঁকি নিরূপণ ব্যবস্থা থেকে অব্যাহতি, ঋণ পুনঃতপশিল, পৃথক তহবিল গঠন, আর্থিক সহায়তা এবং সর্বোপরি জাতীয় পর্যায়ে এই শিল্পের প্রতি সচেতনতা গড়ে তোলা।
বিটিএর চিঠিতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের চা শিল্প বর্তমানে এক গভীর সংকটে। এ সংকট শুধু অর্থনৈতিক নয়, বরং সামাজিক, মানবিক ও পরিবেশগত অর্থে বহুমাত্রিক। দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদার প্রায় শতভাগ চা যোগান দেওয়া এ শিল্প একদিকে যেমন ঐতিহ্য বহন করে, তেমনি প্রায় লাখ লাখ মানুষের জীবিকার সরাসরি বা পরোক্ষ উৎস। এখন রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে বিশেষ নীতির অভাব এই খাতটিকে এমন জায়গায় দাঁড় করিয়েছে, যেখানে কার্যত টিকে থাকা অসম্ভব হয়ে পড়ছে।
অর্থনীতি, সমাজ ও পরিবেশে চা শিল্পের গুরুত্ব
বাংলাদেশের চা শিল্প শুধু একটি কৃষিভিত্তিক উৎপাদন ব্যবস্থা নয়। এটি বাংলাদেশের জাতীয় অর্থনীতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। দেশে প্রায় ১৬৭টিরও বেশি চা বাগান রয়েছে, যার অধিকাংশই সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, চট্টগ্রাম ও পঞ্চগড় অঞ্চলে অবস্থিত। এই চা বাগানগুলোয় সরাসরি নিয়োজিত রয়েছেন প্রায় দেড় লক্ষাধিক শ্রমিক, যাদের অর্ধেকের বেশি নারী। শ্রমিকদের পরিবারের সদস্যসহ মোট উপকারভোগীর সংখ্যা প্রায় ৫ লক্ষাধিক। এর বাইরে পরিবহন, বিপণন, হোটেল, টি-প্যাকিং কোম্পানি, ছোট ও মাঝারি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানসহ প্রায় ১৫ লাখের বেশি মানুষের জীবিকা এই শিল্পের সঙ্গে সম্পর্কিত।
চিঠিতে বলা হয়েছে, চা শিল্প কেবল অর্থনৈতিক মূল্যেই নয়, সামাজিক দিক থেকেও গুরুত্বপূর্ণ। এটি নারীর কর্মসংস্থান, সামাজিক অন্তর্ভুক্তি এবং পরিবেশ সুরক্ষার অন্যতম বড় ক্ষেত্র। একটি চা বাগানে প্রতিবছর হাজার হাজার গাছ রোপণ, তৃণাচ্ছাদন সংরক্ষণ ও সেচব্যবস্থার মাধ্যমে পরিবেশ সংরক্ষণে বিশাল ভূমিকা রাখে।
লাভ নয়, লোকসানে চলছে শতাধিক চা বাগান
চা শিল্পের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ বর্তমানে এর উৎপাদন খরচ ও বাজারমূল্যের মধ্যকার ভয়াবহ পার্থক্য। ২০২৪ সালে চায়ের কেজি প্রতি গড় উৎপাদন খরচ দাঁড়িয়েছে প্রায় ২৬০ টাকা। অথচ পাবলিক নিলামে প্রতি কেজির গড় বিক্রয় মূল্য ২০৩ দশমিক ৯৯ টাকা। ২০২৩ সালে এই মূল্য ছিল ১৭২ দশমিক ৬০ টাকা। তার আগের বছরগুলোয়ও একাধিকবার তা উৎপাদন খরচের নিচে নেমে গেছে।
একটা সময়ে চা শিল্প ছিল লাভজনক, বিশেষ করে ২০১৮-১৯ সাল নাগাদ যখন গড় বিক্রয়মূল্য ২৬১ টাকায় পৌঁছেছিল। কিন্তু কোভিড-উত্তর সময়ে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকট, স্থানীয় বাজারে চাহিদার স্থবিরতা, আমদানিনির্ভর উপকরণের মূল্যবৃদ্ধি এবং শ্রমিক খরচ বেড়ে যাওয়ার ফলে এই লাভজনক শিল্প বর্তমানে গভীর আর্থিক ক্ষতির মুখোমুখি।
মানবিক সমাধান কিন্তু অর্থনৈতিক বোঝা
২০২২ সালের আগস্টে চা শ্রমিকদের সংগঠিত ধর্মঘট দেশের অন্যতম আলোচিত সামাজিক ইস্যুতে পরিণত হয়েছিল। শ্রমিকরা দৈনিক ১২০ টাকা মজুরির বদলে ১৭০ টাকা দাবি তুলে তা বাস্তবায়নে বিগত সময়কার প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেন। সংশ্লিষ্টদের তথ্যমতে, ধর্মঘটের ফলে ৪০০ কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি হয় চা শিল্পে। সরকার সমঝোতার ভিত্তিতে মজুরি বাড়িয়ে ১৭০ টাকা নির্ধারণ করে। ২০২৪ সালের আগস্ট থেকে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১৭৮ দশমিক ৫০ টাকায় এবং আগামী ৫ বছর তা প্রতি বছর ৫ শতাংশ হারে বাড়বে।
বর্তমানে শ্রমিকের মাসিক মজুরি (নগদ ও অনগদ মিলে) দাঁড়িয়েছে প্রায় পনেরো হাজার ৩৫৫ টাকা। এই খরচ ব্যয়বহুল হলেও শিল্প মালিকদের কোনো বিকল্প নেই। শ্রমিকদের চিকিৎসা, আবাসন, রেশন, শিক্ষা, কল্যাণ খরচ সবই মালিকপক্ষের দায়িত্ব।
ব্যাংক ঋণের জটিলতায় বিপর্যস্ত চা শিল্প
চা বাগানগুলোর প্রায় শতভাগ আয় আসে পাবলিক নিলামে চা বিক্রির মাধ্যমে। এই অর্থ সরাসরি জমা হয় ঋণ প্রদানকারী ব্যাংকের হিসাবে। মূলত উৎপাদনের জন্য নেওয়া ঋণ এবং শ্রমিকদের খরচÑ সবকিছু নির্ভর করে একটিমাত্র উৎসের ওপর। এই একমাত্র আয়ের উৎস যখন উৎপাদন খরচের নিচে নেমে যায়, তখন ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ, শ্রমিকদের মজুরি ও বাগানের খরচ চালানো অসম্ভব হয়ে পড়ে বলে দাবি চা বাগান মালিকদের।
এ অবস্থায় মালিকদের দাবি, বাংলাদেশ ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ ঋণঝুঁকি মূল্যায়ন পদ্ধতি চা শিল্পের মতো বিশেষায়িত কৃষি খাতে বাস্তবভিত্তিক নয়। কারণ এই মূল্যায়ন কাগজে-কলমে নেতিবাচক হিসাব তুলে ধরে, বাস্তব চিত্রকে প্রতিফলিত করে না।
উল্লেখ্য, অভ্যন্তরীণ ঋণ ঝুঁকি মূল্যায়ন পদ্ধতি এমন প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে একটি ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান তাদের ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে সম্ভাব্য ঝুঁকি চিহ্নিত এবং মূল্যায়ন করে। এই পদ্ধতিতে ঋণগ্রহীতার ঋণ পরিশোধের ক্ষমতা এবং ইচ্ছাশক্তি যাচাই করা হয়, যাতে ঋণ দেওয়ার পর তা ফেরত পাওয়ার ক্ষেত্রে ঝুঁকি কমানো যায়।
তহবিল, নীতিমালা ও সময়োপযোগী ছাড়
বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে দেওয়া চিঠিতে চা সংসদ ৩টি প্রধান সমাধানমুখী প্রস্তাব উত্থাপন করেছে। এর মধ্যেÑ অভ্যন্তরীণ ঋণ ঝুঁকি মূল্যায়ন থেকে চা শিল্পকে অব্যাহতি দেওয়ার কথা বলা হয়। এ ছাড়াও এই কৃষিভিত্তিক শিল্পে প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য ও বাজারনির্ভর আয় হওয়ায় অভ্যন্তরীণ ঋণ ঝুঁঁকি মূল্যায়ন প্রয়োগ অবাস্তব ও অবিচারমূলকÑ তাই এই ঋণ মূল্যায়ন ব্যবস্থার বাইরে চা শিল্পকে রাখা হোক।
পাশাপাশি শ্রমিক ধর্মঘট ও চায়ের দরপতনের কারণে গৃহীত ঋণগুলো একটি পৃথক হিসাবে সংরক্ষণের প্রস্তাব করা হয়েছে। ২০২৫ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত গৃহীত মূলধনের সব ঋণ একটি নতুন হিসাবে স্থানান্তর। ২০২৫ থেকে ২০২৮ সময়কালে কেবল ৪ দশমিক ৫ শতাংশ সরল সুদ পরিশোধ এবং ২০২৮ থেকে ২০৩৮ মেয়াদে ১০ বছরে আসল ও সুদ পরিশোধের ব্যবস্থার কথাও বলা হয়।
এ ছাড়াও বিশেষ তহবিল গঠন করে ৪৫০০ কোটি টাকার পুনঃঅর্থায়ন তহবিলের কথাও বলা হয়। চা উৎপাদন, সৌরবিদ্যুৎ, ইকো-ট্যুরিজম, শস্য বহুমুখীকরণ, অবকাঠামো উন্নয়ন ও শ্রমিক কল্যাণে বিনিয়োগের জন্য প্রস্তাবিত এই তহবিল ব্যবহারের সুযোগ দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়। এর মধ্যে বারোশ কোটি টাকা শস্য ঋণ ও চলতি মূলধন। আর ৩৩০০ কোটি টাকা দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন প্রকল্পে বিনিয়োগ।
উদ্যোগ না নিলে চায়ের কাপ থাকবে শূন্য
চা শিল্প ধ্বংস হলে শুধু ৫ লাখ শ্রমিক ও তাদের পরিবারের জীবিকা হুমকিতে পড়বে না বরং প্রতিবছর প্রায় ২ হাজার কোটি টাকার চা আমদানি করে তা পূরণ করতে হবে। ফলে বৈদেশিক মুদ্রার ওপর চাপ, গ্রামীণ দারিদ্র্য বৃদ্ধি, নারীর কর্মসংস্থান হ্রাস এবং সামাজিক অস্থিরতা দেখা দেবে।
চা সংসদের ভাষ্য, চা বাগান একবার বন্ধ হয়ে গেলে তা আবার চালু করা কঠিন ও ব্যয়বহুল। বর্তমানে ৫টি বাগান বন্ধ, ২০টির বেশি শ্রমিকদের নিয়মিত মজুরি দিতে পারছে না এবং ৮০টিরও বেশি বাগান তীব্র সংকটের মধ্যে রয়েছে। যা দেশের অর্থনীতির জন্য মারাত্মক সতর্ক সংকেত বলে মনে করছেন দেশীয় চা সংসদের চেয়ারম্যান কামরান টি. রহমান।
এখনই সময় রাষ্ট্রীয় পদক্ষেপের
কামরান টি. রহমান বলেন, বাংলাদেশের চা শিল্প শুধু একটি উৎপাদন খাত নয়। এটি একটি ঐতিহ্য, একটি জীবনব্যবস্থা এবং অর্থনৈতিক ভারসাম্যের এক গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ। সরকার, বাংলাদেশ ব্যাংক এবং সংশ্লিষ্ট সব প্রতিষ্ঠান যদি এখনই সময়োপযোগী আর্থিক ও নীতিগত পদক্ষেপ না নেয়, তবে শত বছরের এই গৌরবময় শিল্প ধ্বংস হয়ে যাবে।
তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশীয় চা সংসদ বিশ্বাস করে, সরকারের সদিচ্ছা এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের দ্রুত সহায়তা পেলে চা শিল্প আবার ঘুরে দাঁড়াতে পারবে। সেই সঙ্গে দেশের অর্থনীতি, পরিবেশ, সমাজ ও কর্মসংস্থানে এর ভূমিকা আরও সুদৃঢ় হবে।