অদম্য ইচ্ছেশক্তি আর স্বামী-সন্তানের অনুপ্রেরণায় ৫৬ বছর বয়সে এইচএসসিতে পাস করেছেন খুলনার শাম্মী আক্তার। খুলনার মজিদ মেমোরিয়াল সিটি কলেজ থেকে বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে এ বছর এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে জিপিএ ৩.১৮ পেয়ে পাস করেন তিনি। নিজের মনের জোর, পরিবারের অনুপ্রেরণা আর অদম্য ইচ্ছাশক্তি এই তিনের মিশ্রণেই এই বয়সে আবারও পরীক্ষার হলে বসেন তিনি। তার এই সাফল্যে আনন্দিত স্বামী ও সন্তানেরা।
১৯৮৮ সালে দশম শ্রেণিতে পড়ার সময় বিয়ের পিঁড়িতে বসেছিলেন শাম্মী আক্তার। সংসার, সন্তান, দায়িত্ব—সব মিলে তখনই থেমে যায় নিজের পড়াশোনা। কিন্তু থেমে থাকেননি তিনি। সন্তানদের উচ্চ শিক্ষিত করার পাশাপাশি নিজের শিক্ষার স্বপ্ন রেখেছেন অটুট।
শাম্মী জানান, ২০১৯ সালে ছেলে ও স্বামীর উৎসাহে আবারও পড়াশোনার আগ্রহ জাগে তার মনে। উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে খুলনার ইকবাল নগর বালিকা বিদ্যালয়ে ভর্তি হলেও পরবর্তীতে কোর্স বন্ধ হয়ে যায়। বদলি প্রতিষ্ঠান থেকেও ভর্তি বাতিলের খবর পান তিনি। একপর্যায়ে ভেঙে পড়েছিলেন, মনে হয়েছিল হয়তো আর সম্ভব নয়। তবু ২০২১ সালে এক শিক্ষকের খুদে বার্তায় আবার জেগে ওঠে আশার প্রদীপ। স্বামী ও সন্তানকে জানিয়ে পড়াশোনা শুরু করেন নিয়মিতভাবে। ২০২৩ সালে এসএসসি পরীক্ষায় পাস করেন তিনি। পড়াশোনার পাশাপাশি উদ্যোক্তা হয়ে বেকারত্ব দূর করতে কাজ করছেন। পরিবারের সদস্যদের নিয়ে খুলনার করিমনগরের বাড়িতেই একটি ছোট ব্যবসা শুরু করেছেন তিনি।
শাম্মী আক্তার বলেন, প্রতিদিনের পরিশ্রম আর ধৈর্যই আমাকে আজকের অবস্থানে নিয়ে এসেছে। পরিবারের সব কাজ শেষ করার পর রাত ১১টার পরে পড়তে বসি। সবাই তখন বিশ্রাম নেয়, আমি পড়তে বসি। কারণ সারা দিন আমি পড়ার সুযোগ পেতাম না। বাসায় কোনো কাজের লোকও (গৃহপরিচালিকা) নেই। পড়তে পড়তে কখন যে রাত ১টা-দুটো বেজে যেত টেরই পেতাম না। এমনও আছে, কোনো দিন রাত ৩টাও বেজে যেত। কোনো প্রাইভেট শিক্ষক ছিল না, অনেক সময় ইংরেজি ইউটিউব দেখে শিখতাম। এভাবে রাতে সময় বের করেছি।
নিজ ইচ্ছা আর স্বপ্নের কথা তুলে ধরতে গিয়ে শাম্মী আক্তার বলেন, ‘আমার খুব ইচ্ছা ছিল, উচ্চ ডিগ্রি নেওয়ার, কিন্ত পারিনি। দশম শ্রেণিতে পড়াকালীন আমার বিবাহ হয়। এরপর অনেক চেষ্টা করেছি লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়ার; কিন্ত সময়-সুযোগ হয়নি, আর্থিক অনটনও ছিল। তখন চিন্তা করলাম, নিজে যখন পারলাম না তখন সন্তানদের আগে একটা পর্যায়ে নিয়ে যায়। সন্তানদের দিকেই বেশি ফোকাস করলাম। সন্তানরা উচ্চ ডিগ্রি নিল। তারাই আমাকে অনুপ্রেরণা দিয়েছে আর আমারও চেষ্টা ছিল। এই বয়সে এসে অনেকে পারে কি না জানি না, কিন্তু ইনশাআল্লাহ আমি পেরেছি।’
তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি বয়স শুধু একটা সংখ্যা মাত্র। আমার যে ৫৬ বছর বয়স, এটা আমি কখনোই মাথায় আনি না। আমি একটা মানুষ, আমার অনেক দূর যেতে হবে। প্রকৃতি ও এই সমাজকে কিছু দিয়ে যেতে হবে। সামনে পড়াশোনা চালিয়ে যাব। এবার অনার্সে ভর্তি হব। পড়ার ইচ্ছা আছে।’
তার স্বামী অবসরপ্রাপ্ত সেনা সার্জেন্ট মো. হাফিজুর রহমান মোল্লা বলেন, “শাম্মীকে উদ্বুদ্ধ করেছি। ছেলে দুইটি যখন একটা কাঙ্ক্ষিত সাফল্যের দিকে এগিয়ে গেল, তখন বললাম, ‘এখন আর তোমার বসে থাকার সময় নেই। লেখাপড়ার প্রতি ফোকাস করো। ভালো ফলাফল লাগবে না, পাস করে আসো।’ এতে সমাজের জন্যও কিছু করতে পারবা, পরবর্তী প্রজন্ম বলতে পারবে আমার দাদি-নানি এই ছিল। কোনো কোনো সময় কাজের কিছুটা ব্যঘাত ঘটলেও সেগুলোকে অভারলুক করে নিজেরটা নিজে করেছি। দৈনন্দিন কাজে সহযোগিতা করেছি।’
স্ত্রী সাফল্যে সন্তুষ্ট জানিয়ে তিনি বলেন, ‘তাকে অল্প বয়সে বিবাহ দিয়েছে, আমিও অল্প বয়সে বিবাহ করেছি। সমাজের অবক্ষয় দূর করতে আমি চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। ওর স্বপ্ন পূরণে সবসময় পাশে ছিলাম, আছি।’
শাম্মীর বড় ছেলে মো. মামুনুর রশীদ খুলনার আযম খান সরকারি কমার্স কলেজ থেকে মার্কেটিংয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষে বর্তমানে নোয়াখালীর একটি মহিলা কলেজের প্রভাষক। ছোট ছেলে এম এম আবদুল্লাহ আল মামুন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর শেষে হাঙ্গেরিতে পিএইচডি করেছেন।
শাম্মীর বড় ছেলে মো. মামুনুর রশীদ বলেন, ‘আমি পৃথিবীর কম সংখ্যক সন্তানদের মধ্যে একজন যে তার মায়ের ফলাফল পেয়ে আনন্দিত। এই আনন্দ ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। এই দিনটার স্বপ্ন ২০১৯ সালে দেখেছি, যখন সবাই একমত হলাম, মায়ের নতুন শিক্ষা জীবনের জন্য। আমাদের সেই স্বপ্নেরই বহিঃপ্রকাশ এটা।’


