যুক্তরাষ্ট্রের রেসিপ্রোকাল ট্যারিফের চাপে ভারসাম্য রক্ষা ও বাংলাদেশকে অনুকূল অবস্থানে আনার লক্ষ্যে এবার প্রতিশ্রুুতির পালা। দেশটির সঙ্গে শুল্ক নিয়ে দর-কষাকষির অংশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের উড়োজাহাজ কোম্পানি বোয়িংয়ের কাছ থেকে ২৫টি বিমান কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ। এর মধ্যে কিছু বিমান আগামী এক-দুই বছরের মধ্যে পাওয়া যাবে। গতকাল রোববার সচিবালয়ে সাংবাদিকদের এসব তথ্য জানিয়েছেন বাণিজ্যসচিব মাহবুবুর রহমান।
পাশাপাশি গম, এলএনজি, তুলা, ওষুধ, মূলধনী যন্ত্রপাতি, রাসায়নিক কাঁচামাল, কৃষিজ পণ্য আমদানির ঘোষণাÑ সব মিলিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য আলোচনায় ইতিবাচক আবহ তৈরির চেষ্টায় নেমেছে ঢাকা।
এ ছাড়াও আজ পাঁচ সদস্যের প্রতিনিধিদল ওয়াশিংটনের উদ্দেশে রওনা দিচ্ছে বলেও জানান মাহবুবুর রহমান। যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধি দপ্তরের (ইউএসটিআর) সঙ্গে ২৯ ও ৩০ জুলাই বৈঠক হবে। প্রয়োজন হলে ৩১ তারিখেও আলোচনা চলবে। বৈঠকে বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীনের নেতৃত্বে অন্যদের মধ্যে থাকবেন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান, আন্তর্জাতিক বিষয় সংক্রান্ত বিশেষ দূত লুৎফে সিদ্দিকী ও বাণিজ্য সচিব নিজে।
সবমিলিয়ে বোয়িং, গম, সয়াবিন ও তুলা এই চারটি প্রধান পণ্যে প্রতিশ্রুতির একটি স্পষ্ট বার্তা নিয়েই বাংলাদেশ প্রতিনিধি দল যাচ্ছে ওয়াশিংটনে। এসব পদক্ষেপের মূল উদ্দেশ্য হলো যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি কমিয়ে আনা, যাতে ডোনাল্ড ট্রাম্প ওই ৩৫ শতাংশ শুল্কের বোঝা থেকে বাংলাদেশকে রেহাই দেয়। রেসিপ্রোকাল চুক্তির মোড় যেন হয় বাংলাদেশের স্বার্থের পক্ষে।
এ প্রসঙ্গে বাণিজ্য সচিব মাহবুবুর রহমান বলেন, আমরা তাদের খসড়ার প্রতিটি অনুচ্ছেদে জবাব দিয়েছি। আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠক, দুই দফা ওয়াশিংটনে আলোচনা, একাধিক অনলাইন মিটিংয়ের পর গত ২৩ জুলাই আমরা চূড়ান্ত অবস্থান জানিয়ে দিয়েছি। এবার সরাসরি আলোচনার পালা।
চুক্তিকে ঘিরে বোয়িং ক্রয়ের বিষয়টি কৌশলগত গুরুত্ব পাচ্ছে। সচিব জানান, আগে ১৪টি বোয়িং কেনার অর্ডার ছিল, তা বাড়িয়ে ২৫টি করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের অন্যান্য ক্রেতার মতো আমরাও একই লাইনেই রয়েছি, তবে বাংলাদেশ বিমানের বহর দ্রুত বাড়ানোর প্রয়োজন থাকায় বিষয়টি গুরুত্ব পাচ্ছে।
তিনি স্পষ্ট করেন, বোয়িং কেনা মানেই একচেটিয়াভাবে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি নির্ভরতা নয়। প্রয়োজন অনুসারে অন্য উৎস থেকেও বিমান কেনা হবে।
অর্থনৈতিক বিষয় সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদের ও ক্রয় সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদের অনুমোদন ছাড়া কি করে বোয়িং কেনার অনুমোদন দেওয়া হলো এই বিষয়ে বাণিজ্য সচিবের কাছে জানতে চাইলে তিনি রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, আমরা আসলে বোয়িং কেনার কোনো আদেশ দেইনি। মূলত তাদের বলা হয়েছে আমরা কিনতে চাই, তারা কবে নাগাদ দিতে পারবে তা জানতে চাওয়া হয়েছে। কেনার আগে তো অবশ্যই অর্থনৈতিক বিষয় সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদের ও ক্রয় সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদের অনুমোদন নেওয়া হবে।
সচিব বলেন, শুধু বোয়িং নয়, গম ও অন্যান্য কৃষিপণ্যের দিকেও নজর রয়েছে সরকারের। বর্তমানে রেড সি অঞ্চলের অস্থিরতায় বিকল্প সরবরাহচক্র গড়ে তোলার অংশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার প্রতি নির্ভরতা বাড়ানো হচ্ছে। বেসরকারি খাতের ব্যবসায়ীরা ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্র থেকে সয়াবিন ও তুলা কেনার প্রক্রিয়ায় আছে। আমাদের প্রতি বছর ৯ মিলিয়ন টনের বেশি গম লাগে। আগে যুক্তরাষ্ট্র থেকেও আসত। এখন আবার নিয়মিতভাবে কেনার উদ্যোগ নিচ্ছি।
চুক্তিতে বিনিয়োগের বিষয়টিও রয়েছে, তবে সেটি মুখ্য নয়। যুক্তরাষ্ট্র তাদের বৈশ্বিক বাণিজ্য ঘাটতি (১ দশমিক ৩ ট্রিলিয়ন ডলার) কমাতেই মূলত ট্যারিফ কাঠামো পুনর্বিন্যাস করছে। বাংলাদেশ চায়, ভারতের মতো শুল্কছাড় না হোক, অন্তত সমান মর্যাদা পাক। মূলত, বাংলাদেশ চায় ভারত-ভিয়েতনামের তুলনায় কিছুটা কম শুল্ক বা একই সমান।
সচিব বলেন, ‘আমাদের ওপর বেশি চাপ দেবেÑ এমনটা মনে করার কারণ নেই। বরং সম্ভাবনা আছে, আমরা চীন থেকে স্থানান্তরিত কিছু উৎপাদন ধরতে পারি।’
তিনি বলেন, সরকার মনে করছে, বাজার বাস্তবতায় যুক্তরাষ্ট্র থেকে পণ্য আনায় ব্যবসায়ীরা আগ্রহী থাকবেন এবং সেটি বাজার দামে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে না। সরকার কাউকে চাপ দিচ্ছে না। যুক্তরাষ্ট্র থেকে পণ্য আসছে, কারণ সেগুলোর মান, সরবরাহ ও সুবিধা রয়েছে।
বোয়িংয়ের ব্যবসা যুক্তরাষ্ট্র সরকার নয়, বোয়িং কোম্পানির। বাংলাদেশ ২৫টি বোয়িংয়ের অর্ডার দিয়েছে। ভারত, ভিয়েতনাম ১০০টি করে অর্ডার দিয়েছে। ইন্দোনেশিয়া দিয়েছে ৫০টি। এ রকম অর্ডার বিভিন্ন দেশ দিয়েছে। বোয়িং কোম্পানি তাদের সক্ষমতা অনুযায়ী সরবরাহ করবে। অর্ডারের বোয়িং পেতে অনেক সময় লাগবে। যাকে আগে অর্ডার দিয়েছে তাদের আগে দেবে কিংবা প্রতিষ্ঠানটি তাদের ব্যবসার ধরন অনুযায়ী বিমান সরবরাহ করবে।
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের বহরে থাকা বেশির ভাগ উড়োজাহাজই মার্কিন কোম্পানি বোয়িংয়ের। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে ফ্রান্সের কোম্পানি এয়ারবাস থেকে ১০টি বড় উড়োজাহাজ কেনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল বাংলাদেশ। তবে সরকার বদলের পর সে উদ্যোগে তেমন কোনো গতি দেখা যায়নি। আগের সিদ্ধান্ত পাল্টে বাংলাদেশ যে ফের বোয়িং কেনার ক্রয়াদেশ দিয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র থেকে গম আমদানির চুক্তি করা হয়েছে। বেসরকারি খাতের ব্যবসায়ীরা সয়াবিন আমদানির চিন্তা করছে। সেজন্য তারা বসবে। সরকার যখন ইউএসটিআরের সাথে বসবে, তখন বেসরকারি খাতের ব্যবসায়ীরাও যুক্তরাষ্ট্রের সয়াবিন তেল সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের সাথে বসবেন। আশা করা হচ্ছে, তাদের মধ্যেও একটি সমঝোতা হবে। আগেই তাদের তুলা কেনার বিষয়টি প্রায় চূড়ান্ত করা হয়েছে। এখনো তুলা তাদের কাছ থেকে আমদানি করা হয়। তবে তিন বছর আগে বাংলাদেশ প্রায় ১ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলরের তুলা আমদানি করত। সেটা আবার বেড়ে যেন আগের অবস্থায় যায়, সেই চেষ্টাই করা হচ্ছে।
ট্রাম্প দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় বসার পর গত ২ এপ্রিল শতাধিক দেশের ওপর চড়া হারে শুল্ক আরোপের ঘোষণা দেন। বাংলাদেশের ওপর তখন বাড়তি ৩৭ শতাংশ শুল্কের ঘোষণা আসে।
এ নিয়ে উদ্বেগের মধ্যে সম্পূরক শুল্ক পুনর্বিবেচনা করতে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে চিঠি পাঠান বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস। বাণিজ্য ঘাটতি কমিয়ে আনতে পদক্ষেপ নেওয়ার কথা তুলে ধরে শুল্কারোপের সিদ্ধান্ত তিন মাস স্থগিত রাখার অনুরোধ করা হয় সেখানে। তাতে রাজি হয়েছিলেন ট্রাম্প।
এই তিন মাস সময় ট্রাম্প মূলত দিয়েছিলেন আলোচনার জন্য। বাংলাদেশের তরফ থেকেও সে বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। ৬২৬টি পণ্যে শুল্ক ছাড়ের ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল বাজেটে। কিন্তু তাতে কাজ হয়নি। ৩৭ শতাংশের বদলে ট্রাম্প ৩৫ শতাংশ শুল্কের খড়্গ নামিয়েছেন বাংলাদেশের ওপর। ১ আগস্ট থেকেই তা কার্যকর করার ঘোষণা দিয়েছেন। তাতে সবচেয়ে বড় ধাক্কা খাবে বাংলাদেশি তৈরি পোশাক খাত, কারণ যুক্তরাষ্ট্রই বাংলাদেশি পোশাকের সবচেয়ে বড় বাজার। সরকারের তরফ থেকে বলা হচ্ছে, শুল্কের বিষয়ে বাংলাদেশও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একটি চুক্তিতে আসার চেষ্টা করছে। সেজন্য আলোচনাও চলছে।