দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে উত্তপ্ত পরিস্থিতি বিরাজ করছে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের নির্দিষ্ট তারিখ ঘিরে। কবে, কখন, কীভাবে নির্বাচনি ইশতেহার ঘোষণা করবেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস সে দিকেই অধীর আগ্রহে তাকিয়ে সব দল। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, নির্বাচন যত বিলম্বিত হবে, ততই সংকট সৃষ্টি হবে, সরকার নানা প্রশ্নের মুখে পড়বে। এমন পরিস্থিতিতে সরকারের নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার বিষয়টি ইতিবাচক। তারা মনে করেন, অধীর আগ্রহে নির্বাচনের নির্দিষ্ট তারিখের দিকে তাকিয়ে রয়েছে গণতন্ত্রে বিশ্বাসী দেশের বৃহৎ রাজনৈতিক দলগুলো।
গত শনিবার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক শেষে জাতীয় পার্টির (কাজী জাফর) চেয়ারম্যান মোস্তফা জামাল জানান, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা আগামী চার-পাঁচ দিনের মধ্যে জাতীয় নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করবেন। তবে চার/পাঁচ দিনের মধ্যে নির্বাচনি তারিখ ঘোষণার বিষয়টি তথ্যবিভ্রাট উল্লেখ করে বৈঠকে অংশ নেওয়া জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলনের (এনডিএম) চেয়ারম্যান ববি হাজ্জাজ বলেন, ড. মুহাম্মদ ইউনূস প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন আগামী ৫ আগস্টের মধ্যে নির্বাচনি তারিখ ঘোষণা করবেন। নির্বাচনের জন্য বিএনপি যেকোনো সময়েই প্রস্তুত রয়েছে বলে জানিয়েছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীন খসরু মাহমুদ। জামায়াতের ভাষ্য, তারা গত ৫৪ বছরের দখল-ভোট লুটের নির্বাচন চায় না। এদিকে এনসিপি মনে করে বিচার-সংস্কার ছাড়া নির্বাচন জনগণ গ্রহণ করবে না।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ২০২৬ সালের প্রথম ভাগেই হবে জাতীয় নির্বাচন। নির্বাচনের স্পষ্ট একটা তারিখ পাওয়ার যে ঘোষণা আসছে বৈঠক থেকে তা ইতিবাচক। এর ফলে দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা বেশ খানিকটা কমবে।
নির্বাচনি তারিখ ঘোষণার বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, বিএনপি যেকোনো সময়েই নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত রয়েছে। বিএনপি গণতন্ত্রে বিশ্বাসীÑ নির্বাচনের দল, অলওয়েজ রেডি ফর ইলেকশন। তিনি বলেন, অনেকের অবস্থা এমনÑ কথা শুনলে জাতীয় নির্বাচন মানব, না শুনলে নির্বাচনে যাব না। এটা অগণতান্ত্রিক আচরণ। গণতন্ত্রের কথা বলে গণতন্ত্রকে ধ্বংস করার প্রক্রিয়া। শেখ হাসিনাও যা বলত, তা-ই মানতে হতো। তিনি আরও বলেন, নির্বাচনকে ভয় পেলে তাদের রাজনীতির দরকার নেই। তারা প্রেসার গ্রুপ হিসেবে কাজ করুক। রাজনীতি করবেন, নির্বাচনে যাবেন না, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করবেন, এটা হতে পারে না। যেসব দেশে এমন বিপ্লব হয়েছে এবং নির্বাচনকে বিলম্বিত করার চেষ্টা হয়েছে, সেখানে বিভাজন হয়েছে। গৃহযুদ্ধসহ ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। যারা দ্রুত নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্রে ফিরে যেতে পেরেছে, তারা আর্থিক, সামাজিক ও গণতান্ত্রিকভাবে ভালো করেছে।
নির্বাচনের বিষয়ে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির সাবেক এমপি ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, জামায়াতে ইসলামী নির্বাচন চায়, তবে ৫৪ বছরের ইতিহাসের কেন্দ্র দখল-ভোট বাক্স লুটের নির্বাচন চায় না। তিনি বলেন, স্বাধীনতার পর যারাই সরকার গঠন করেছে তারা জনগণের ভোটের নামে প্রহসনের নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করেছে। এ জন্যই জামায়াত বারবার দাবি জানাচ্ছে জনগণের ভোটাধিকার নিশ্চিত এবং জনগণের প্রতিটি ভোটের মূল্যায়নের জন্য রাষ্ট্রের মৌলিক সংস্কার করে পিআর পদ্ধতিতে জাতীয় সংসদ নির্বাচন দিতে। তিনি আরও বলেন, রাষ্ট্রের মৌলিক সংস্কার, গণহত্যার বিচার শেষ করে পিআর পদ্ধতির নির্বাচনে আসেন। বড় দল, কোনো দলের মৌলিক পরিচয় হতে পারে না। মৌলিক পরিচয় হচ্ছে আদর্শ, নীতি এবং ত্যাগের রাজনীতি। আওয়ামী লীগ ২০১৪ সালে একতরফা নির্বাচন, ২০১৮ সালে রাতের ভোট এবং ২০২৪ সালে আমি ও ডামি নির্বাচন করে দেশের মানুষের ভোটাধিকার কেড়ে নিয়েছে। এবার জনগণ ভোটাধিকার প্রয়োগের জন্য প্রস্তুত। নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টি করে একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, অংশগ্রহণমূলক ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনের আয়োজন করতে হবে।
জাতীয় নির্বাচন নিয়ে এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম জানান, সংস্কার ছাড়া জাতীয় নির্বাচন চায় না। তিনি বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে অনেক দাবি ছিল। কিন্তু আমাদের সব দাবিকে নির্বাচনের দাবিতে রূপান্তর করে ফেলা হয়েছে। আমরা বলেছি আমরা নির্বাচন চাই, আমরা গণতন্ত্রের পক্ষের শক্তি, ভোটাধিকারের পক্ষে লড়াই করা শক্তি। কিন্তু বিচার-সংস্কার ছাড়া নির্বাচন অর্থহীন হয়ে যাবে। তিনি বলেন, এই নির্বাচনকে জনগণ গ্রহণ করবে না। ফলে বিচার ও সংস্কারে যতটুকু আমরা এগিয়েছি তার পক্ষে আমাদের ঐকমত্য হয়ে নির্বাচনের দিকে যেতে হবে।
এদিকে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে ১৪টি রাজনৈতিক দলের বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের মোস্তফা জামাল হায়দার জানান, চার-পাঁচ দিনের মধ্যে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করবেন। তিনি বলেন, প্রধান উপদেষ্টা ক্যাটাগরিক্যালি (সুস্পষ্টভাবে) বলেছেন, তিনি আগামী চার-পাঁচ দিনের মধ্যে নির্বাচনের সময়সীমা, তারিখ ঘোষণা করবেন। আলোচনার সবচেয়ে ফলপ্রসূ বিষয় হচ্ছে এটা। দেশে যে অরাজকতা, তার একমাত্র সমাধানের পথ নির্বাচনÑ এটা সরকার বুঝতে পেরেছে। তিনি আরও বলেন, নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার চেয়ে আনন্দের বার্তা আর কিছু হতে পারে না। নৈরাজ্যের সমাধান করবে নির্বাচন। নির্বাচনের মাধ্যমে অনেক সমস্যার সমাধান হবে।
চার-পাঁচ দিনের ভেতর নির্বাচনি তারিখের বিষয়ে কোনো আলোচনা কেউ করেনি উল্লেখ করে এনডিএম চেয়ারম্যান ববি হাজ্জাজ রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, আগামী ৫ আগস্টের মধ্যে নির্বাচনি তারিখের ঘোষণার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন ড. ইউনূস। তিনি ভুলবশত এটি বলেছেন যা পরে স্পষ্ট করা হয়েছে। তিনি জানান, এনডিএম আলোচনার সময় কিছু দাবি করে যার মধ্যে ছিল, জুলাই সনদ ঘোষণার সাথে সাথে নির্বাচন কমিশন কবে তপশিল ঘোষণা করবে তা নির্ধারণ করা। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে মনিটরিং সেল গঠন করা। একই সাথে, উপদেষ্টাদের ১ বছরের পারফরম্যান্সের খতিয়ান উপস্থাপন করা।
উল্লেখ্য, শীর্ষ দুই নেতার বৈঠকের পর যৌথ ঘোষণায় কিছুটা স্বস্তি ফিরলেও নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট তারিখ ঘোষণা না দেওয়ায় দলগুলোর মধ্যে এক ধরনের সন্দেহ রয়েই গেছে, তবে ৫ আগস্টের ভেতর তারিখ ঘোষণা স্বস্তির জায়গা তৈরি করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। নির্বাচনকে মূল বিষয় ধরে অন্য বিষয়গুলো কাজ করলে মানুষ আরও উজ্জীবিত হবে বলেও মনে করছেন বিশ্লেষকরা। ডিসেম্বরের মধ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে প্রস্তুতি সম্পন্ন করার নির্দেশ হয়তো সেটিরই ইঙ্গিত কিংবা রোজার আগে নির্বাচন আয়োজন নিয়ে জটিলতা নিরসনে এক ধাপ এগিয়ে যাওয়া।