ঢাকা সোমবার, ২৮ জুলাই, ২০২৫

বললেন আলী রীয়াজ

জুলাই সনদের খসড়া প্রস্তুত

রূপালী প্রতিবেদক
প্রকাশিত: জুলাই ২৮, ২০২৫, ১২:৫৬ এএম

জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেছেন, জুলাই সনদের খসড়া প্রস্তুত হয়েছে। সেটা আগামীকাল সোমবারের মধ্যে সবকটি রাজনৈতিক দলের কাছে পাঠানো হবে।

দলগুলো দ্রুত মতামত দিলে সেটা সন্নিবেশিত করা হবে। এক ব্যক্তি সর্বোচ্চ দুই মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী পদে থাকা ও স্বাধীন পুলিশ কমিশন গঠনে একমত হয়েছে রাজনৈতিক দলগুলো। তবে সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি কী হবে তা নিয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকে বামপন্থি এবং ডানপন্থি রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিরোধ দেখা দিয়েছে।

গতকাল রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ঐকমত্য কমিশনের দ্বিতীয় ধাপের আলোচনার ১৯তম দিনের সূচনা বক্তব্যে এসব কথা বলেন আলী রীয়াজ। এ ছাড়াও রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি, নাগরিকের মৌলিক অধিকার সম্প্রসারণ-সম্পর্কিত মূলনীতি এবং পুলিশ কমিশন গঠনসংক্রান্ত প্রস্তাব বিষয়ে গতকালের আলোচনা হয়েছে।

সনদের খসড়া নিয়ে সংলাপে আলোচনা করা হবে না জানিয়ে আলী রীয়াজ বলেন, যদি বড় রকমের মৌলিক আপত্তি ওঠে, তাহলে আলোচনায় আনব, না হলে আনব না। আপনাদের (রাজনৈতিক দল) পক্ষ থেকে মতামত দেওয়া হলে সেটা সন্নিবেশিত করে প্রাথমিক সনদে ভূমিকা-পটভূমি থাকবে এবং কমিটমেন্টের জায়গা থাকবে।

আলী রীয়াজ জানান, জাতীয় সনদ সইয়ের জন্য চলমান আলোচনায় একটি দিন বরাদ্দ রাখা হবে। আর ৩১ জুলাইয়ের মধ্যে ঐকমত্য কমিশনের চলমান আলোচনা শেষ করা হবে। ১০টি বিষয়ে আমরা ঐকমত্য হয়েছি। সাতটি বিষয়ে ঐকমত্য অসমাপ্ত আছে। আর তিনটি বিষয়ে আলোচনা এখনো হয়নি।

আলী রীয়াজ বলেন, দলগুলো এক ব্যক্তি সর্বোচ্চ দুই মেয়াদ বা ১০ বছর প্রধানমন্ত্রী পদে থাকতে পারবেন বলে একমত হয়েছে। একই সঙ্গে তারা স্বাধীন পুলিশ কমিশন গঠনেও একমত হয়েছে।

এ সময় তিনি প্রশ্ন তোলেন, ‘এ বিষয়ে আমরা কি একমত হয়েছি? এ বিষয়ে সালাহউদ্দিন আহমদ একটি শর্ত দিয়েছিলেন, সেটা কি এখনো আছে?’

পরে এ নিয়ে কথা বলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দীন আহমদ। তিনি বলেন, আমরা একবার বলেছি তো বলেছি, ১০ বছরের বেশি কোনো ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রী পদে বহাল থাকবেন না। আমি বলেছিলাম সংবিধান ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানে নিয়োগের কমিটি থাকলে বিষয়টি মানব না। আমরা এ হাউসের মতামতের ভিত্তিতে নির্বাচন কমিশন নিয়োগসংক্রান্ত বিধান সংবিধানে যুক্ত করব। এর বাইরের বিষয়ে আলোচনা হলে আমাদের শর্ত বহাল থাকবে। আশা করি, সেটা বিবেচনা করবেন। এখন ১০ বছরের বিষয়ে আপনারা ঘোষণা দিতে পারেন। বরং এটা আমাদের প্রস্তাব।

আলোচনার শুরুতে বাংলাদেশ পুলিশের পেশাদারি ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে ‘স্বাধীন পুলিশ কমিশন’ গঠনের প্রস্তাব রাজনৈতিক দলগুলোর সামনে উপস্থাপন করে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। পরে দলগুলো আলোচনা করে স্বাধীন পুলিশ কমিশন গঠনে একমত হয়। তবে আইনি কাঠামো নিয়ে আলোচনা করা হবে।

এ বিষয়ে আলী রীয়াজ বলেন, পুলিশ কমিশনের বিষয়ে আমরা একমত। গঠনপ্রক্রিয়া নিয়ে আমরা আলোচনা করব। বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো আলাপ-আলোচনায় একটি স্বাধীন পুলিশ কমিশন গঠনে একমত হয়েছে। যা পুলিশের জবাবদিহি ও দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করবে, জনবান্ধবতা নিশ্চিত করবে।

পুলিশ কমিশনের প্রস্তাবে বলা হয়, পুলিশ বাহিনী যেন একটি শৃঙ্খলিত বাহিনী হিসেবে আইনসম্মত ও দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে, তা নিশ্চিত করা হবে কমিশনের অন্যতম লক্ষ্য। একই সঙ্গে পুলিশ সদস্য ও সাধারণ নাগরিকÑ উভয় পক্ষের অভিযোগ নিষ্পত্তির দায়িত্বও এই কমিশনের ওপর ন্যস্ত থাকবে।

পুলিশ কমিশনের বিষয়ে আলী রীয়াজ বলেন, আমরা একটি পুলিশ কমিশনের প্রস্তাব করেছি। ঐকমত্য কমিশনের পক্ষ থেকে ১৬৬টা সুপারিশ আপনাদের (রাজনৈতিক দল) কাছে পাঠানো হয়েছিল। সেগুলোতে পুলিশ কমিশনের ব্যাপারে সুপারিশ ছিল না। আমরা এখন একটি সংযুক্ত করছি সময়ক্ষেপণের জন্য নয়। এই আলোচনা শুরু হওয়ার পর থেকে নাগরিকদের পক্ষ থেকে নানা জায়গা থেকে শুনেছি যে, পুলিশ কমিশনের বিষয়ে কেন আলোচনা হচ্ছে না। গত ১৬ বছরে পুলিশের ভূমিকার কারণেই এ প্রশ্নটা খুব বৈধভাবে উৎপন্ন হয়েছে। তাই এটি সংযুক্ত করা হয়েছে। আমাদের বিশ্বাস আমরা সবকিছু নিয়ে একটি ঐকমত্য তৈরি করতে পারব।

এদিকে সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি কী হবে সেটি নিয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকে বামপন্থি এবং ডানপন্থি রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে তুমুল বিরোধ দেখা দিয়েছে। বৈঠকের শুরুতে পুলিশ কমিশন নিয়ে আলোচনা হয়। এরপর রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি নিয়ে আলোচনায় আসলে ডানপন্থি রাজনৈতিক দলগুলো এবং বামপন্থি রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিরোধ দেখা দেয়।

সংবিধানের মূলনীতির ব্যাপারে কমিশনের প্রস্তাব অনুযায়ী, স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে উল্লিখিত ৩টি মূলনীতি অর্থাৎ সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার। এগুলোর সঙ্গে গণতন্ত্র এবং ধর্মীয় স্বাধীনতা ও সম্প্রীতিকে মূলনীতি হিসেবে প্রস্তাব করা হয়েছে। পাশাপাশি বাহাত্তরের সংবিধানে থাকা অথবা পঞ্চম সংশোধনীতে যোগ হওয়া কোনো মূলনীতি যোগ হবে নাকি হবে না, এটা আগামী সংসদের এখতিয়ারের ওপরে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।

সিপিবি, ওয়ার্কার্স পার্টি, বাসদ (মার্কসবাদী)সহ বেশ কয়েকটি বামপন্থি রাজনৈতিক দলের মতে, বাংলাদেশ এক রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে পাকিস্তান থেকে স্বাধীন হয়েছে। তার ভিত্তিতেই বাহাত্তরের সংবিধান প্রণয়ন করা হয়েছে। সেই মূলনীতি একেবারেই পরিবর্তন করা মানে মুক্তিযুদ্ধকে অস্বীকার করা। বাহাত্তরের সংবিধানের মূলনীতির ব্যাপারে কোনো ছাড় দেওয়া হবে না। কমিশন যদি এ ব্যাপারে তাদের ওপর সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয় তাহলে তারা কমিশনের সঙ্গে আর আলোচনা চালিয়ে না যাওয়ারও ঘোষণা দেন।

অপরদিকে বিএনপি, জামায়াত, এবি পার্টিসহ ডানপন্থি দলগুলো কমিশনের প্রস্তাবের সঙ্গে একমত। একই সঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ সংবিধানে ‘আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা’র বিষয়টি সংযোজন করার প্রস্তাব দেন। এ ব্যাপারেও ডানপন্থি সব দলই ঐকমত্যে পৌঁছেছে। তবে মূলনীতির ব্যাপারে একটু ভিন্নমত এনসিপির। তাদের মতে, বাহাত্তরের সংবিধানের কোনো মূলনীতিই না রেখে নতুন করে যে বিষয়গুলো আসছে সেসবকেই মূলনীতি করা।

বৈঠকে দুপুরের মধ্যাহ্নভোজের বিরতির আগে এসব বিষয় নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে ব্যাপক বিতর্ক হয়। এ সময় কমিশনের সহসভাপতি ড. আলী রীয়াজকেও উত্তেজিত হয়ে অনেক বক্তাকে থামাতে দেখা যায়।

আলী রীয়াজ বলেন, নাগরিকদের মৌলিক অধিকার সম্প্রসারণবিষয়ক প্রস্তাবটি অনালোচিত ছিল। সংবিধান সংস্কার কমিশনের পক্ষ থেকে প্রস্তাব করা হয়েছিল যে, সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগে এবং তৃতীয় ভাগে বর্ণিত যে অধিকারগুলোর বিষয়ে বলা হয়েছে, সেগুলো একটি অধ্যায়ে সন্নিবেশিত করে বিল অব রাইটসের মতো করে উপস্থাপন করা। সেই বিষয়ে তারা সুস্পষ্টভাবে কিছু কিছু পরামর্শ এবং সুপারিশ দিয়েছে। কিন্তু প্রাথমিক পর্যায়ের আলোচনায় দেখা গেছে অধিকাংশ রাজনৈতিক দল, এ ব্যাপারে একমত হতে পারেনি। রাজনৈতিক দলগুলো নাগরিকের মৌলিক অধিকার সম্প্রসারণের ব্যাপারে একমত কিন্তু কীভাবে সম্প্রসারণ করা হবে সেটা নিয়ে আলোচনা হবে।

আলী রীয়াজ বলেন, গতকাল (শনিবার) থেকে আগামী তিন দিনের মধ্যে আমি আশা করছি, অনেক কাজ সম্পাদন করে আমরা প্রক্রিয়াটা সম্পন্ন করতে পারব বা চূড়ান্তে উপনীত হতে পারব। আপনারা (রাজনৈতিক দলগুলো) অব্যাহতভাবে সহযোগিতা করছেন, আমরা সবাই মিলে চেষ্টা করছি। সেই চেষ্টায় অবশ্যই সফলতা আসবে। এ বিশ্বাস এবং আস্থা আমাদের রাখা দরকার।

আলোচনায় অংশ নিয়েছে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), ইসলামী আন্দোলন, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), গণসংহতি আন্দোলনসহ ৩০টি রাজনৈতিক দল।

প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দারের সঞ্চালনায় আলোচনায় উপস্থিত আছেন সফর রাজ হোসেন, এমদাদুল হক, বদিউল আলম মজুমদার, ইফতেখারুজ্জামান, আইয়ুব মিয়া প্রমুখ।