মঙ্গলবার, ২৯ জুলাই, ২০২৫

ফেসবুক


ইউটিউব


টিকটক

Rupali Bangladesh

ইনস্টাগ্রাম

Rupali Bangladesh

এক্স

Rupali Bangladesh


লিংকডইন

Rupali Bangladesh

পিন্টারেস্ট

Rupali Bangladesh

গুগল নিউজ

Rupali Bangladesh


হোয়াটস অ্যাপ

Rupali Bangladesh

টেলিগ্রাম

Rupali Bangladesh

মেসেঞ্জার গ্রুপ

Rupali Bangladesh


শহিদুল ইসলাম রাজী

প্রকাশিত: জুলাই ২৯, ২০২৫, ১২:৫৩ এএম

কোনোমতেই বাগে আসছে না মোহাম্মদপুরের আইনশৃঙ্খলা

শহিদুল ইসলাম রাজী

প্রকাশিত: জুলাই ২৯, ২০২৫, ১২:৫৩ এএম

কোনোমতেই বাগে আসছে না  মোহাম্মদপুরের আইনশৃঙ্খলা

পড়ন্ত বিকেলে হেলেদুলে হাঁটছেন দুই কিশোর। প্রথম দেখায় মনে হবে, খেলনা হাতে অবচেতন মনে হাঁটছেন তারা। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে চকচকে চাপাতি হাতে ওই দুজন পেশাদার ছিনতাইকারী। দিনদুপুরে চাপাতি ঠেকিয়ে মানুষের মূল্যবান জিনিসপত্র লুটে নেওয়াই তাদের নিত্যদিনের কাজ। 

সম্প্রতি রাজধানীর আদাবর এলাকায় তাদের ছিনতাইয়ের একটি ভিডিওফুটেজ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। এ ছাড়া একটি সিসি ক্যামেরার ফুটেজে দেখা গেছে, মোহাম্মদপুরের নবোদয় হাউজিংয়ের খালপাড়ে রাতে চাপাতি হাতে আসে তিন কিশোর। রিকশা থামিয়ে কয়েকটি মোবাইল, মানিব্যাগসহ মূল্যবান জিনিসপত্র লুটে নিয়ে পালিয়ে যায় তারা। শুধু এ ঘটনাই নয়, গত রোববার রাজধানীর মোহাম্মদপুরে থানা এলাকায় সন্ধ্যা থেকে রাত ১১টার মধ্যে ঘটেছে তিনটি ছিনতাইয়ের ঘটনা। তিন-চারজন গ্রুপ ধরে চাপাতি-আগ্নেয়াস্ত্র হাতে ছিনতাই এসব এলাকায় নিত্যদিনের ঘটনা। রাতে তো আছেই, দিনদুপুরে ছিনতাই, অস্ত্রবাজি, ডাকাতি, চাঁদাবাজি, খুন, ধর্ষণের অভয়ারণ্য হয়ে উঠেছে এলাকাটি। এ ছাড়া কিশোর গ্যাংয়ের দৌরাত্ম্য থামছে না কিছুতেই। গড়ে প্রতি ৪৮ ঘণ্টায় একটি করে ছিনতাই মামলা নথিভুক্ত হয় থানায়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অগোচরে অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠছে অপরাধী চক্র। এসব এলাকায় প্রতিনিয়তই অস্ত্র হাতে প্রকাশ্যে বাসাবাড়ি ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে ডাকাতি ও রাস্তায় ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটছে।

চুরি-ছিনতাই ও ডাকাতির ভয়ে আতঙ্কে দিন কাটছে স্থানীয়দের। সন্ধ্যা নামতেই থমথমে হয়ে যায় এলাকার প্রতিটি আবাসিক ভবন আর সড়কগুলো। দুর্বৃত্তদের নিয়ন্ত্রণে হিমশিম খাচ্ছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাও। সেনাবাহিনী, র‌্যাব, পুলিশ নিয়মিত টহল কার্যক্রম পরিচালনা করলেও কিছুতেই বাগে আসছে না, মোহাম্মদপুরের আইনশৃঙ্খলা। অত্র এলাকায় মাদক, সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজি বন্ধের দাবিতে এবং আদর্শ মোহাম্মদপুর-আদাবর গড়ার প্রত্যয়ে আজ মানববন্ধন ও র‌্যালি করবে স্কুল-কলেজ, মাদ্রাসার শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা।  

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বৃহত্তর মোহাম্মদপুরের শ্যামলী, আদাবর, বেড়িবাঁধ ও ঢাকা উদ্যান এবং পুরো উত্তরা এলাকায় চুরি-ডাকাতি, চাঁদাবাজি, ছিনতাইয়ের পাশাপাশি আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে অপরাধের মাত্রা অন্যান্য সময়ের তুলনায় দ্বিগুণ হয়েছে। মারামারিসহ বিভিন্ন ধরনের সন্ত্রাসী কার্যক্রম পরিচালনা করছে কিশোর গ্যাং সদস্যরা। পুলিশ তাদের কাছে অসহায় হয়ে পড়েছে। দলবেঁধে অস্ত্র প্রদর্শন করে চলাচল করায়, তাদের মুখোমুখি হতে ভয় পাচ্ছে প্রশাসন ও সাধারণ মানুষ। এ ছাড়া তারা মাদক সেবনসহ সংশ্লিষ্ট এলাকায় মাদক কারবারের সঙ্গেও জড়িত ছিল। এ গ্যাংয়ের সদস্যরা রাস্তাঘাটে ইভটিজিং, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অপ্রীতিকর ভিডিও শেয়ারসহ বিভিন্ন কুরুচিপূর্ণ কার্যক্রমের সঙ্গেও জড়িত।

গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। এরপর থেকে আর বাগে আনা যায়নি, মোহাম্মদপুরের আইনশৃঙ্খলা। নিজেদের হিরোইজম জাহির করতে চাঁদাবাজি, ছিনতাই, মাদক কারবার এমনকি খুনোখুনিতে লিপ্ত হচ্ছে এসব কিশোর-তরুণ। এতে আতঙ্কিত রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন শহর-পাড়া-মহল্লার বাসিন্দারা। আওয়ামী লীগের পতন হলেও দল পালটে এখনো অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে এসব কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য। অতীতের মতো এখনো রাজনৈতিক নেতা কিংবা প্রভাবশালী মহলের ছত্রছায়ায় তারা। তবে পুলিশের কাছে শুধু কিশোর গ্যাংয়ের অপরাধের আলাদা কোনো তথ্য নেই।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, মোহাম্মদপুরে চারটি হটস্পটে বেশি সক্রিয় রয়েছে মাদক কারবারি, ছিনতাইকারী, চোর-ডাকাতসহ বিভিন্ন ধরনের অপরাধী। এই চার হটস্পট হচ্ছেÑ বসিলা বেড়িবাঁধ, ঢাকা উদ্যান, জেনেভা ক্যাম্প ও টাউন হল বিপরীত পাশের বিহারি ক্যাম্প। 

ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) সূত্রে জানা গেছে, মোহাম্মদপুর জোনে গত জুন মাসে মোহাম্মদপুর থানায় একটি হত্যাসহ ১১টি ছিনতাই এবং পাঁচটি চুরির মামলা নথিভুক্ত হয়। একই সময়ে আদাবর থানায় একটি হত্যাসহ দুটি করে ছিনতাই ও চুরির মামলা নথিভুক্ত হয়। এ ছাড়া মে মাসে মোহাম্মদপুর থানায় একটি হত্যাসহ ১০টি ছিনতাই এবং পাঁচটি চুরির মামলা নথিভুক্ত হয়। আদাবর থানায় চারটি ছিনতাই এবং তিনটি চুরির মামলা নথিভুক্ত হয়। গত এপ্রিলে মোহাম্মাদপুর থানায় ১২টি ছিনতাই এবং ১০টি চুরির মামলা নথিভুক্ত হয়েছে। একই সময়ে আদাবর থানায় ছিনতাই ছয়টি এবং একটি করে চুরি ও অপহরণের মামালা নথিভুক্ত হয়েছে। সব মিলিয়ে এপ্রিল, মে ও জুনে মোহাম্মদপুর জোনে তিনটি হত্যা মামলা, ৪৫টি ছিনতাই, ২৬টি চুরি এবং একটি অপহরণ মামলা নথিভুক্ত হয়। গড় হিসাব করলে মোহাম্মদপুর জোনে প্রতি ৪৮ ঘণ্টায় একটি করে ছিনতাই মামলা নথিভুক্ত হচ্ছে। যদিও স্থানীয়রা বলছেন, এ ধরনের অপরাধের প্রকৃত চিত্র কয়েক গুণ বেশি। কারণ ছিনতাই চক্রের ভয়ে এবং পুলিশি ঝামেলা এড়াতে মামলায় অনীহা ভুক্তভোগীদের। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, এলাকায় টহল টিম থাকলেও থামছে না ছিনতাই।

জানা গেছে, গত রোববার রাতে রাজধানীর মোহাম্মদপুর থানা এলাকায় ঘটেছে তিনটি ছিনতাইয়ের ঘটনা। সন্ধ্যা থেকে রাত ১১টার মধ্যে লালমাটিয়া, মোহম্মদপুর ও ঢাকা উদ্যান এলাকায় ঘটে এসব ঘটনা। ছিনতাইকারীরা অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে চারটি মোবাইল ফোন, টাকা ও দুটি ব্যাগ ছিনিয়ে নিয়ে যায় বলে অভিযোগ ভুক্তভোগীদের। এ বিষয়ে মোহাম্মদপুর থানায় তিনটি অভিযোগ করেছেন তারা। তবে অভিযান চললেও এখন পর্যন্ত এসব ঘটনায় কাউকে আটক করতে পারেনি পুলিশ। 

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ভুক্তভোগী বলেন, ‘সিভিয়ার একটা সিচুয়েশনের মধ্যে যাচ্ছি আমরা। একটা নিরাপত্তা জোনে আমরা নিরাপদ না। যেখানে নিরাপত্তা কম, সেখানে তো আরও খারাপ অবস্থা। ওভার অল দেশের পরিস্থিতি আমার মনে হয় রাস্তায় বের হওয়া অনেকটাই অনিরাপদ হয়ে উঠছে।’ 

গত শনিবার পূর্বশত্রুতার জেরে রাজধানীর মোহাম্মদপুর বুদ্ধিজীবী কবরস্থানের গেটের সামনে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে ফজলে রাব্বি সুমন (২৫) নামের এক যুবককে হত্যার ঘটনা ঘটে। মুমূর্ষু অবস্থায় স্বজন ও বন্ধুরা তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে এলে চিকিৎসক বেলা সাড়ে ৩টার দিকে মৃত ঘোষণা করেন। হাসপাতালে মৃত সুমনের স্ত্রী মঞ্জুমা আক্তার বলেন, সুমন বন্ধুদের সঙ্গে মোহাম্মদপুর বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধের ভেতরে গিয়েছিলেন।

সেখানে মুন্না নামের এক যুবক সুমনকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে আহত করে এবং তার কাছ থেকে একটি মোবাইল নিয়ে যায়। পরে সুমনের বন্ধুরা তাকে উদ্ধার করে প্রথমে শিকদার মেডিকেলে নিয়ে যায়। পরবর্তী সময়ে ঢাকা মেডিকেলে নিলে চিকিৎসক মৃত বলে ঘোষণা করেন। 

সম্প্রতি মোহাম্মদপুরের ‘এলটিডি বয়েজ’ নামের একটি কিশোর গ্যাংয়ের চার সদস্যকে র‌্যাব গ্রেপ্তার করেছে। তারা মোহাম্মদপুর এলাকায় আতঙ্ক সৃষ্টি করছিল এবং ছিনতাই ও অন্যান্য সন্ত্রাসী কার্যকলাপে জড়িত ছিল। তাদের কাছ থেকে দেশীয় অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। র‌্যাবের একটি সূত্র জানায়, সম্প্রতি মোহাম্মদপুর এলাকায় বেশ কয়েকটি ছিনতাইকারী দল সন্ত্রাসী কর্মকা-ে জড়িয়ে পড়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে, র‌্যাব-২ তাদের টহল ও গোয়েন্দা কার্যক্রম বৃদ্ধি করে। পরে ১৯ জুলাই গোপন সংবাদের ভিত্তিতে র‌্যাব জানতে পারে, মোহাম্মদিয়া হাউজিং এলাকায় দেশীয় অস্ত্র নিয়ে একদল লোক জড়ো হয়েছে। এরপর র‌্যাব সেখানে অভিযান চালিয়ে ‘এলটিডি বয়েজ’ গ্রুপের চার সদস্যকে গ্রেপ্তার করে। 

মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা সজীব বলেন, ‘আমরা কয়েক মাস ধরে দেখছি, মোহাম্মদপুর এলাকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি একেবারে নড়বড়ে হয়ে পড়েছে। মোহাম্মদপুরের অলিগলিতে দেশীয় ধারালো অস্ত্র ঠেকিয়ে ছিনতাই, পাড়া-মহল্লায় কিশোর গ্যাং সদস্যদের দিনের আলোতেই অস্ত্র নিয়ে হামলার ঘটনা ঘটছে। বর্তমান ওসি মোহাম্মদপুরের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সামাল না দিয়ে নাকে তেল দিয়ে ঘুমাচ্ছেন। তার অধীনস্থ এলাকার এমন পরিস্থিতিতে তার ইন্ধন রয়েছে। না হয় কীভাবে একটি এলাকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এত খারাপ রূপ ধারণ করে।’ 

আরেক বাসিন্দা ইসমাইল বলেন, কেউ ছিনতাই কিংবা কিশোর গ্যাংয়ের হামলার শিকার হলে পুলিশ কোনো সহায়তা করে না। কোথাও প্রকাশ্যে কিশোর গ্যাং সদস্যরা হামলা করলে কিংবা ছিনতাইকারীরা ছিনতাই করলে পুলিশের নিষ্ক্রিয় ভূমিকা দেখা যায়। 

ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) ডিসি মুহাম্মদ তালেবুর রহমান বলেন, রাজধানীতে নিয়মিত পুলিশি টহল ও অভিযান পরিচালনার মাধ্যমে এসব অপরাধ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হচ্ছে। পাশাপাশি বিট পুলিশিংয়ের মাধ্যমে এলাকাভিত্তিক সচেতনতা তৈরির মধ্য দিয়ে অপরাধীদের গ্যাং সংস্কৃতি রোধ করার চেষ্টা চলছে।
তিনি বলেন, ‘রাজধানীর অপরাধ স্থিতিশীল রাখার জন্য আমাদের যে অপরাধ নিয়ন্ত্রণ কৌশল, সেটা অনেকটা কার্যকর হচ্ছে বলেই অপরাধ অনেকটা স্থিতিশীল রয়েছে। আশা করি, সামনের দিনগুলোয় পরিস্থিতি আরও উন্নতি হবে।’

রূপালী বাংলাদেশ

Shera Lather
Link copied!