গোপালগঞ্জে দুই সপ্তাহ আগে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) পদযাত্রা কর্মসূচি ঘিরে সংঘর্ষের সময় জীবননাশের হুমকি তৈরি হলে ‘আত্মরক্ষার্থে’ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বল প্রয়োগ করতে বাধ্য হলেও প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার হয়নি বলে জানিয়েছে সেনা সদর।
গতকাল বৃহস্পতিবার ঢাকা সেনানিবাসের অফিসার্স মেসে সংবাদ সম্মেলনে মিলিটারি অপারেশনস পরিদপ্তরের স্টাফ কর্নেল মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, গোপালগঞ্জে একটি অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতি ছিল। যেখানে শুধু ইটপাটকেল নিক্ষেপ করা হয়নি, ককটেলও নিক্ষেপ করা হয়েছে। যখন সেখানে জীবননাশের হুমকি ছিল, তখন আত্মরক্ষার্থে আমাদের যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ছিল, তারা বল প্রয়োগ করেছে বা করতে বাধ্য হয়েছে। এখানে প্রাণঘাতী কোনো অস্ত্রের ব্যবহার করা হয়নি।
সেনাবাহিনীর তরফে সাম্প্রতিক সময়ে যৌথ বাহিনীর কার্যক্রম তুলে ধরতে নিয়মিত সংবাদ সম্মেলন করা হচ্ছে। সেই ধারাবাহিকতায় এদিনের ব্রিফিংয়ে আসেন স্টাফ কর্নেল শফিকুল ইসলাম। সেনা সদরে গতকাল তিনি বলেন, ‘গোপালগঞ্জে কী হয়েছিল, সেটার সত্যতা উদঘাটনের জন্য একটি তদন্ত কমিটি গঠন হয়েছে। আমরা আশা করি, এই তদন্ত কমিটি সত্য এবং সঠিক ঘটনা উন্মোচনে সক্ষম হবে।’
এনসিপির প্রতি সেনাবাহিনীর ‘আলাদা নজর’ থাকা প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমরা কোনো রাজনৈতিক দলকে বিশেষভাবে কখনো কাউকে সহায়তা করিনি। আমাদের দায়িত্বের মধ্যে কাউকে বিশেষভাবে দেখি না। গোপালগঞ্জে যেটা হয়েছে, ওইখানে ওই রাজনৈতিক দলের অনেকেরই জীবননাশের হুমকি ছিল। তাদের জীবন বাঁচানোর জন্যই সেনাবাহিনী সহায়তা করেছে। এখানে জীবন বাঁচানোই মূল লক্ষ্য ছিল, অন্য কিছু না।
আমরা আসলে বিশেষ কোনো দলের ক্ষেত্রে আমাদের আলাদা নজর নেই। আমরা দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে সবাই আমাদের কাছে সমান। যেখানে জনদুর্ভোগ ও জীবননাশের হুমকি থাকে, সেখানে আমরা কঠোর হই বা জনসাধারণকে সহায়তা করে থাকি। সেখানে আমরা যদি আমাদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন না করতাম, তাহলে সেখানে আরও হতাহত বা জীবননাশের সম্ভাবনা থাকত।’
গোপালগঞ্জে সহিংসতার বিষয়ে সেনাবাহিনীর কাছে অগ্রিম তথ্য ছিল কি না, এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, কোনো রাজনৈতিক দল কোথায় তাদের সভা করবে, এটার ছাড়পত্র নিতে হয় স্থানীয় প্রশাসন থেকে। তাই সে বিষয়ে সেখানকার স্থানীয় প্রশাসন ও পুলিশ অবগত থাকলেও সেনাবাহিনীর কাছে কোনো তথ্য ছিল না।
এনসিপি নেতাদের উদ্ধার জীবনের হুমকি বিবেচনায়:
কোনো দল নয়, বরং জীবন রক্ষার্থেই আমাদের এ কাজটি করতে হয়েছে, বলেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নাজিম-উদ-দৌলা। গোপালগঞ্জে কর্মসূচিতে গিয়ে হামলা-সংঘর্ষের মধ্যে আটকা পড়া জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) নেতাদের সাঁজোয়া যানে করে কেন সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল, দুই সপ্তাহ পর তার ব্যাখ্যা দিল সেনাবাহিনী।
গতকাল সেনা সদরের মিলিটারি অপারেশনস পরিদপ্তরের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. নাজিম-উদ-দৌলা এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘অবশ্যই জীবন রক্ষা আমাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং আমরা সেটা করেছি ইতিপূর্বে। কোনো দল নয়; বরং জীবন রক্ষার্থেই আমাদের এ কাজটি করতে হয়েছে।’
গত ১৬ জুলাই গোপালগঞ্জে এনসিপির কর্মসূচিতে দফায় দফায় হামলার পর পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সঙ্গে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সংঘর্ষ বাধে। একপর্যায়ে পুরো শহরে সংঘাত ছড়িয়ে পড়ে। সংঘর্ষের মধ্যে গুলিতে চারজন নিহত এবং অন্তত ৯ জন গুলিবিদ্ধসহ অর্ধশতাধিক আহত হন। পরে ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আরেকজনের মৃত্যু হয়। গোপালগঞ্জে সেই রণক্ষেত্রের পরিস্থিতির মধ্যে আটকা পড়া এনসিপি নেতাদের সাঁজোয়া যানে করে সরিয়ে নেয় সেনাবাহিনী। ওই ঘটনার ছবি ও ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। বিষয়টি নিয়ে সমালোচনাও হয়।
নিহতদের ঘটনায় পুলিশের করা মামলায় দুষ্কৃতকারীদের গুলিতে মৃত্যুর কথা বলা হলেও সেদিন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে গুলি চালাতে দেখার অভিযোগ করেছেন স্থানীয়রা। প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্য অনুযায়ী, শহরের গলির মুখে দাঁড়ানো হামলাকারীদের সরিয়ে দিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দিক থেকে গুলি চালানো হয়। তবে সেনাবাহিনীর ভূমিকা নিয়ে আইএসপিআর ১৭ জুলাই যে সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দেয়, তাতে সেনাবাহিনীর তরফে ‘আত্মরক্ষার্থে বলপ্রয়োগে বাধ্য হওয়ার’ কথা বলেছিল; ঘটনার ১৫ দিন পর সংবাদ সম্মেলনে এসে প্রায় একই ভাষ্য সেনা সদরের।
‘মেজর সাদিক নামে একজন আওয়ামী লীগের লোকজনকে প্রশিক্ষণ দিচ্ছে’, এমন একটি বিষয় নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আলোচনা হচ্ছেÑ এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে কর্নেল শফিকুল বলেন, ‘মেজর সাদিকের বিষয়ে আমরা অবগত। এ বিষয়ে আমাদের তদন্ত চলমান। তদন্ত শেষে বলতে পারব বিষয়টি পুরোপুরিভাবে।’
আরেক প্রশ্নের জবাবে মাদক ও চাঁদাবাজির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ৫ হাজার ৫৭৬ জনকে সেনাবাহিনীর গ্রেপ্তারের তথ্য দিয়ে তিনি বলেন, চাঁদাবাজ বা এ ধরনের ঘটনা নিয়ন্ত্রণের জন্য যে আইনশৃঙ্খলা এজেন্সিগুলো যাদের সর্বাগ্রে দায়িত্ব পালন করার কথা, তারা যদি কার্যকর হয়, তাহলে আরও কমে আসবে বলে আমরা বিশ্বাস করি। সাথে সাথে আমাদের যে আভিযানিক দায়িত্ব রয়েছে, সেটা আমরা সর্বদা পালন করছি।
সেনাবাহিনীকে যে ম্যাজিস্ট্রেসি পাওয়ার দেওয়া হয়েছে, সেই ধারাগুলোয় আমরা শুধু তল্লাশি এবং অপরাধীকে গ্রেপ্তার করতে পারি। অপরাধীদের গ্রেপ্তার করার পর বিচারিক প্রক্রিয়ায় হস্তান্তর করার পর আসলে আমাদের আর কিছু করার থাকে না। যারা সর্বাগ্রে কাজ করার কথা, তাদেরকে আরও কার্যকর হতে হবে।
পার্বত্য অঞ্চলে সাম্প্রতিক নানা সংঘাতের বিষয়গুলো সেখানে বিভিন্ন গোষ্ঠীর ‘চাঁদাবাজির জের’ বলে তুলে ধরেন তিনি। তার ভাষ্য, ‘আমরা আমাদের কার্যক্রম ও অভিযান জারি রেখেছি। ভবিষ্যতেও আমাদের কার্যক্রম চলমান থাকবে।’ বান্দরবানে কিছু সেনাক্যাম্প প্রত্যাহারের কারণে আরাকান আর্মির সঙ্গে কুকি চীনের অস্ত্র কেনাবেচার মতো ঘটনা ঘটছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, সেনাবাহিনী পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রটেকশন দিতে পারছে না, এটা সঠিক নয়। সেনাবাহিনী প্রটেকশান দিয়ে যাচ্ছে এবং ভালোভাবে দিয়ে যাচ্ছে। আমাদের বর্তমানে যে ক্যাম্পগুলো আছে, সেখান আমাদের আভিযানিক কার্যক্রম পরিচালনা করছি।
আপনার মতামত লিখুন :