ঢাকা সোমবার, ০৪ আগস্ট, ২০২৫

ট্রাইব্যুনালে প্রথম সাক্ষী

হাজার হাজার মানুষকে মারার জন্য দায়ী হাসিনা

রূপালী প্রতিবেদক
প্রকাশিত: আগস্ট ৩, ২০২৫, ১১:২৪ পিএম
  • শেখ হাসিনা সব অপরাধের নিউক্লিয়াস: চিফ প্রসিকিউটর
  • পৃথিবীর সব স্বৈরশাসকের সমিতি হলে শেখ হাসিনা হবেন সভাপতি: অ্যাটর্নি জেনারেল

জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে করা মামলায় প্রথম একজন সাক্ষী সাক্ষ্য দিয়েছেন। গতকাল রোববার দুপুরে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এ সাক্ষ্য দেন খোকন চন্দ্র বর্মণ নামের একজন মাইক্রোবাসচালক।
জবানবন্দিতে খোকন চন্দ্র বর্মণ বলেন, ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকায় পুলিশ তার মাথা লক্ষ্য করে গুলি করে। গুলি তার চোখ, নাক ও মুখে লাগে। এ সময় সাক্ষী খোকন মাস্ক খুলে মুখ দেখান। দেখা যায়, তার বাঁ চোখ, নাক ও মুখ পুরোটাই বিকৃত হয়ে গেছে। 
খোকন বলেন, ‘যারা হাজার হাজার মানুষকে মেরেছিল, তাদের জন্য শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন ও সাবেক সংসদ সদস্য শামীম ওসমান দায়ী এবং আমি তাদের বিচার চাই।’


শেখ হাসিনার পাশাপাশি এই মামলায় সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালও আসামি। পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন এই মামলায় মানবতাবিরোধী অপরাধের দায় স্বীকার করে নিয়েছেন। সেই সঙ্গে তিনি এই মামলায় ‘অ্যাপ্রুভার’ (দোষ স্বীকার করে ঘটনার সত্য বিবরণ প্রকাশ করেন যে আসামি; সাধারণত তিনি রাজসাক্ষী হিসেবে পরিচিত) হয়েছেন।
এই মামলায় পলাতক শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালের পক্ষে রাষ্ট্র নিযুক্ত আইনজীবী মো. আমির হোসেন। সাক্ষী খোকন চন্দ্র বর্মণ জবানবন্দি দেওয়ার পর তাকে আমির হোসেন জেরা করেন। জেরায় সাক্ষীকে আমির হোসেন প্রশ্ন করেন, ‘আপনি যে শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালকে দায়ী করলেন, তার দলিল আছে?’ জবাবে খোকন চন্দ্র বর্মণ বলেন, ‘না।’
জেরায় সাক্ষীকে আমির হোসেন আরেকটি প্রশ্নে বলেন, ‘আন্দোলনকারী ছাত্র-জনতা পুলিশের ওপর আক্রমণ করে। এতে যাত্রাবাড়ী থানার ১৩ থেকে ১৪ জন পুলিশ সদস্য নিহত হন। আরও অনেক পুলিশ সদস্য আহত হন। পুলিশের ওপর হামলায় ছাত্র-জনতা দেশি অস্ত্র ও আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করেছিলেন এবং সেই অস্ত্রের আঘাতে আপনি আহত হয়েছেন।’ জবাবে খোকন চন্দ্র বর্মন বলেন, ‘এসব কথা অসত্য।’


শেখ হাসিনা সব অপরাধের নিউক্লিয়াস: চিফ প্রসিকিউটর
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে হত্যাসহ যত অপরাধ হয়েছে, শেখ হাসিনা এসব অপরাধের কেন্দ্রবিন্দু বা নিউক্লিয়াস ছিলেন বলে মন্তব্য করেছেন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘জুলাই আন্দোলনের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধগুলোর একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল শেখ হাসিনার ক্ষমতা ধরে রাখা। অন্য আসামিরা তার অধীনে থেকে বুঝতেন যে শেখ হাসিনার ক্ষমতায় থাকার ওপরই তাদের নিরাপত্তা ও পুরস্কার নির্ভর করছে।’


গতকাল বেলা সাড়ে ১১টার দিকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এ সূচনা বক্তব্যে এসব কথা বলেন তিনি। তাজুল ইসলাম বলেন, ‘আসামিদের অনুপস্থিতি মানেই ন্যায়বিচার বাধাগ্রস্ত হতে পারে না। শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে জুলাই আন্দোলন দমনে অপরাধের প্রমাণ এতটাই স্পষ্ট ও শক্তিশালী যে বিচারে বিন্দুমাত্র সন্দেহের অবকাশ থাকবে না। তিনি বলেন, ‘এই মামলা গত বছরের ১৬ আগস্ট তদন্ত শুরু হয়ে ১২ মে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হয়। ১ জুন তদন্ত প্রতিবেদন আমলে নেন ট্রাইব্যুনাল এবং ১৯ জুলাই আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠন করেন।’ 


পৃথিবীর সব স্বৈরশাসকের সমিতি হলে শেখ হাসিনা হবেন সভাপতিÑ অ্যাটর্নি জেনারেল: অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান বলেছেন, ‘মিথ্যার ওপর পিএইচডি করতে হলে শেখ হাসিনার কাছে শিখতে হবে। পৃথিবীর সব স্বৈরশাসকের যদি কোনো সমিতি করা হয়, শেখ হাসিনা হবেন তার সভাপতি।’ গতকাল আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে শেখ হাসিনাসহ অপরাধীদের সাক্ষ্য দেওয়ার আগে সূচনা বক্তব্যে এসব কথা বলেন অ্যাটর্নি জেনারেল।


মো. আসাদুজ্জামান বলেন, ‘বাংলাদেশের ভবিষ্যতের স্বার্থে, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের স্বার্থে স্বৈরাচার ও তার সহযোগীদের সর্বোচ্চ শাস্তি আমরা চাই।’ এ সময় অ্যাটর্নি জেনারেল পৃথিবীর কোন দেশের স্বৈরাচারের কী পরিণতি হয়েছে, তা আদালতের সামনে তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ‘আমরা ন্যায়বিচার চাই, দেশের মানুষের স্বপ্নের বিচার চাই। ন্যায়বিচারের মধ্য দিয়েই আমরা তার সর্বোচ্চ শাস্তি চাই। শুধু রাষ্ট্রপক্ষ নয়, সবাই ন্যায়বিচার পাবেন।’


মো. আসাদুজ্জামান বলেন, ‘বিগত আমলে গুম-খুনের পলিটিক্যাল কালচার সৃষ্টি হয়েছিল। বাংলাদেশের মানুষের জন্য, গণতন্ত্রের জন্য এমন একটি ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা দরকার, যেখানে খুনের রাজনীতি বন্ধ হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নামে গুম-খুন, চাঁদাবাজি, টাকা পাচার করা হয়েছে। আর এর বিরুদ্ধেই ছিল বৈষম্যবিরোধী জুলাই আন্দোলন।’ এ সময় চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম বলেন, ‘এই বিচার অতীতের হিসাব চোকানোর চেষ্টা নয়, এটি ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার দৃপ্ত পদক্ষেপ। কোনো ব্যক্তি যতই ক্ষমতাধর হোক, সে আইনের ঊর্ধ্বে নয়।’