ঢাকার ১নং কর অঞ্চলে চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী ছিলেন মো. শাহাদাত হোসেন কাজল মোল্লা। কর অঞ্চলে রাজস্ব চালান জালিয়াতির দায়ে চাকরি চলে যায় তার। এরপর চারটি করাঞ্চলের বিভিন্ন কর্মকর্তা-কর্মচারীর সহায়তায় ‘পুরো কর ফাইল’ সার্কেল থেকে বাইরে নিয়ে যেতেন। মূল ফাইল নষ্ট করে করদাতার ‘সম্পদ বৃদ্ধি’ করে ফাইল জমা ও ‘জাল চালান’ জমা দিতেন তিনি।
চালান জালিয়াতির অর্থে গ্রামের বাড়ি ও ঢাকায় গড়েছেন কয়েকটি বহুতল ভবন, ফ্ল্যাট ও বাণিজ্যিক স্পেস। সরকার তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিলেও কাজল মোল্লার সব ব্যাংক হিসাব জব্দ করেছে আয়কর গোয়েন্দা বিভাগ। ঘটনার দায়ে কর অঞ্চলÑ১ এর তিনজনকে বাধ্যতামূলক অবসর দিয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। তার ‘জাল চালান’ নিয়ে ও কর ফাঁকির কা-ে ফেঁসে গেছেন তিনটি কোম্পানির শীর্ষ কর্মকর্তা। এমন তিনজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার ফাইলে চালান জালিয়াতি করে ১৩ করবর্ষে ফাঁকি দিয়েছেন প্রায় ২২ কোটি ২৪ লাখ টাকা। অবশেষে তিন করদাতা আইনের প্রতি শ্রদ্ধা দেখিয়ে ইতোমধ্যে ১২ কোটি ৪৪ লাখ টাকা সরকারি কোষাগারে জমা দিয়েছেন। ইতোমধ্যে তিন করদাতা ঢাকার গুলশান-২ থানায় কাজল মোল্লার বিরুদ্ধে পৃথকভাবে সাধারণ ডায়রি করেছেন। ঘটনায় ঢাকার কর অঞ্চল-১, কর অঞ্চল-২, কর অঞ্চল-৩, কর অঞ্চল-১৪ এর অনেক কর্মচারী জড়িত। আয়কর গোয়েন্দাদের অনুসন্ধানে সেই ফাইল ইতোমধ্যে এই প্রতিবেদকের হাতে এসেছে।
কাজল মোল্লার জালিয়াতি: কর অঞ্চল-৩, সার্কেল-৪৮ এর করদাতা আসিফ মইন। সার্কেল কর্মকর্তা এই করদাতার ২০২৪-২৫ করবর্ষের রিটার্ন যাচাই করেন। যাচাইয়ে দেখতে পান, এই করদাতার বেতন থেকে প্রায় ৯০ লাখ টাকার উৎসে কর কর্তন করা হয়েছে। কিন্তু এই ৯০ লাখ টাকা সরকারি কোষাগারে জমার কোনো চালান রিটার্নের সঙ্গে দেওয়া হয়নি। তবে একটি টপশিটে ১২টি চালানের নম্বর লিখে দেওয়া হয়েছে, যাতে প্রতিটি চালানে সাড়ে ৭ লাখ টাকা করে সরকারি কোষাগারে জমা হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কর কর্মকর্তা ১২টি চালান যাচাই করেন।
দেখা গেছে, প্রতিটি চালানে সাড়ে ৭ লাখ নয়, মাত্র ৩ লাখ টাকা করে ১২টি চালানে ৩৬ লাখ টাকা সরকারি কোষাগারে জমা হয়েছে। অর্থাৎ বাকি ৫৪ লাখ টাকা গায়েব। ওই করদাতার ফাইলে একটি কোম্পানি থেকে ডিভিডেন্ট হিসেবে যে টাকা পেয়েছেন, তার ওপর ২ কোটি ৩৬ লাখ টাকা কর কর্তন করা হয়েছে। করের টাকা সরকারি যে কোষাগারে জমা দেওয়া হয়, তার চালান নেই।
টাকা জমা দেওয়ার প্রত্যয়নপত্র হিসেবে মিউচ্যুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের পে-অর্ডারের একটি ফটোকপি দেওয়া হয়েছে। তবে সেই পে-অর্ডারে জমা ও প্রাপ্য ট্যাক্সের সংখ্যার মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। এই করদাতার নামে কয়েকটি বিলাসবহুল গাড়ি রয়েছে। একের অধিক গাড়ি থাকলেও পরিবেশ সারচার্জ হিসেবে সাড়ে ৭ লাখ টাকা ট্যাক্স দেওয়া হয়নি। তার বেতন ও ডিভিডেন্ট খাতে প্রায় তিন কোটি টাকা কর নেওয়া হলেও রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দেওয়া হয়নি।
তিন করদাতার ২০ কোটি টাকা আত্মাসাৎ: কর অঞ্চল-৩, সার্কেল-৪৮ এর করদাতা আসিফ মইন, মাহমুদ বিন কাশেম ও সৈয়দ মাজহারুল হক। এর মধ্যে আসিফ মইন ফারইস্ট নিটিং অ্যান্ড ডায়িং ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। আর মাহমুদ বিন কাশেম ও সৈয়দ মাজহারুল হক পরিচালক। তিনজনই নিয়মিত রিটার্ন দাখিল ও কর প্রদান করে আসছেন। প্রতিবছর তিন করদাতা থেকে করের কথা বলে অন্তত ২-৩ কোটি টাকা নিয়ে আসতেন। কোষাগারে জমা দিতেন নামমাত্র, তার মধ্যে বেশির ভাগ জাল চালান দিতেন।
আয়কর গোয়েন্দার যাচাইয়ে দেখা গেছে, আসিফ মইনের ২০১২-১৩ থেকে ২০২৪-২৫ পর্যন্ত ১৩ বছরের আয়কর রিটার্ন যাচাই করা হয়েছে। যাতে দেখা গেছে, প্রায় ১৮ কোটি টাকা করফাঁকি হয়েছে। যার মধ্যে বেশির ভাগ টাকা ‘চালানে’ জমা দিয়েছেন মোল্লা। কিন্তু সেই চালানগুলো জাল।
আসিফ মইন আয়কর গোয়েন্দাকে জানিয়েছেন, তিনি প্রতিবছর কাজল মোল্লার দাবি করা করের সমপরিমাণ টাকা দিয়ে দিয়েছেন। আবার মাহমুদ বিন কাশেমের ২০১৭-১৮ থেকে ২০২১-২২ করবর্ষ পর্যন্ত রিটার্ন যাচাই করা হয়েছে। যাতে ৩ কোটি ৭৮ লাখ টাকা করফাঁকি বের হয়েছে। এই করদাতার ফাইলেও কর জমার যেসব চালান রয়েছে, তার বেশির ভাগ জাল।
আয়কর গোয়েন্দা সূত্র জানিয়েছে, ফারইস্ট নিটিংয়ের তিন কর্মকর্তার কর ফাইলে প্রাথমিকভাবে প্রায় ২২ কোটি ২৪ লাখ টাকা ফাঁকি বের হয়েছে। যার মধ্যে প্রায় ১৭ কোটি ২৬ লাখ টাকা কর ফাঁকি ও জরিমানা প্রায় ৪ কোটি ৯৭ লাখ টাকা। তিন করদাতা কাজল মোল্লার প্রতারণা ও জালিয়াতির শিকার হয়েছেন। তিন করদাতা নিরুপায় হয়ে আইনের প্রতি শ্রদ্ধা দেখিয়ে ইতোমধ্যে ১২ কোটি ৪৪ লাখ টাকা সরকারি কোষাগারে জমা দিয়েছেন। ঘটনায় চলতি বছরের ২৫ মে গুলশান থানায় মো. শাহদাত হোসেন কাজল মোল্লার নামে সাধারণ ডায়রি করেন তারা।
এপিএস গ্রুপের দুই কর্মকর্তার ফাইল জালিয়াতি: করদাতা মো. শামীম রেজা, ইনা রেজা, কনা রেজা, সাবরিনা রেজা ও সামরিনা রেজা। এর মধ্যে মো. শামীম রেজা এপিএস গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। একই গ্রুপের এই পাঁচ করদাতাও মো. শাহাদাত হোসেন কাজল মোল্লার প্রতারণার শিকার হয়েছেন। বিশেষ করে মো. শামীম রেজা ও ইনা রেজার আয়কর নথি মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে জালিয়াতি করেছেন কাজল মোল্লা। তাকে সহায়তা করেছেন কর অঞ্চলের কর্মকর্তারা।
আয়কর গোয়েন্দার অনুসন্ধান ও কর অঞ্চল-১, ঢাকার এক অভিযোগ বিবরণীতে বলা হয়েছে, মো. শামীম রেজা ও ইনা রেজা কর অঞ্চল-১, ঢাকার নিয়মিত করদাতা। এর মধ্যে মো. শামীম রেজা কর সার্কেল-৯ (কোম্পানিজ) ও ইনা রেজা সার্কেল-১ (কোম্পানিজ) এর করদাতা। এর মধ্যে মো. শামীম রেজার ২০০৪-০৫ ও ইনা রেজার ২০০৭-০৮ করবর্ষ থেকে নথি চালু হয় (প্রথম রিটার্ন দেন)। এই দুই করদাতার ফাইলে প্রথম অবস্থায় সম্পদের পরিমাণ কম দেখানো হয়েছে। সম্পদের পরিমাণ বাড়াতে কাজল মোল্লা সার্কেল কর্মচারীদের সহায়তায় জালিয়াতির আশ্রয় নেন।
এর মধ্যে শামীম রেজা ও ইনা রেজার ২০২১-২২ এর আগের করবর্ষের (শামীম রেজার ২০১৯-২০ ও ২০২০-২১ করবর্ষ এবং ইনা রেজার ২০১৩-১৪ থেকে ২০১৮-১৯ করবর্ষ) রিটার্নগুলো সার্কেল থেকে বাইরে নিয়ে যাওয়া হয়। মূল আয়কর ফাইল নষ্ট করে রিটার্নের তথ্য পরিবর্তন করে নতুন রিটার্ন তৈরি ও সই জাল করা হয়। সবচেয়ে বেশি যে জালিয়াতি কর আইটি ১০বি বা সম্পদ বিবরণীতে। দুটি ফাইলে অন্তত ৩০ কোটি টাকার সম্পদ বাড়িয়ে দেখানো হয়। যার মধ্যে প্রায় ১০ কোটি টাকা করে নগদ অর্থ সংযোজন করা হয়েছে।
কর অঞ্চলের তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন: কাজল মোল্লা মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে এই কাজ করেন। জালিয়াতিতে অংশ নেন কর অঞ্চল-২, ঢাকার কর পরিদর্শক মো. আব্দুল বারী, কর অঞ্চল-১, ঢাকার অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক সো. সেলিম শরীফ, নিরাপত্তা প্রহরী মো. নজরুল ইসলাম, কর অঞ্চল-১৪, ঢাকার নোটিশ সার্ভার সৈয়দ শাকিল হোসেন।
কাজল মোল্লা প্রথমে কর অঞ্চল-১৪, ঢাকার নিরাপত্তা প্রহরী সৈয়দ শাকিল হোসেন ও কর অঞ্চল-১, সার্কেল-২১ এর নিরাপত্তা প্রহরী মো. নজরুল ইসলামকে শামীম রেজা ও ইনা রেজার দুটি আয়কর নথির রেকর্ড পরিবর্তনের প্রস্তাব দেন। এতে তারা রাজি হন। নিরাপত্তা প্রহরী মো. নজরুল ইসলাম নথি দুটি সার্কেল থেকে সরাতে সার্কেল-৯ এর অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক সেলিমকে ৩ লাখ টাকা দেন। সেলিম শরীফ নথি দুটি বড় খামে করে নোটিশ সার্ভার গোলাম রাব্বানীর মাধ্যমে নিরাপত্তা প্রহরী সৈয়দ শাকিল হোসেনের কাছে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সামনে পৌঁছে দেন।
শাকিল হোসেন, আব্দুল বারী ও কাজল মোল্লা মিলে দুইজন করদাতার নথির রেকর্ড পরিবর্তন করে ২০২২ সালের ১৪ মার্চ সার্কেলে ফেরত দেন। তবে দুই করদাতার আয়কর নথির আদেশ, আইটি-১০বি’র তথ্য পরিবর্তন করা হয়। একইসঙ্গে মূল রেকর্ড নষ্ট করে কর্মকর্তার সই জাল করা হয়।
অভিযুক্তদের ভাষ্য অনুযায়ী, এই জালিয়াতির জন্য কাজল মোল্লার কাছ থেকে কর পরিদর্শক মো. আব্দুল বারী ৬০ লাখ টাকা নিয়েছেন। এর মধ্যে নিরাপত্তা প্রহরী সৈয়দ শাকিল হোসেনকে ১৬ লাখ টাকা দেন। বাকি ৪৪ লাখ টাকা নিজের কাছে রাখেন আব্দুল বারী। শাকিল এই ১৬ লাখ টাকা থেকে নিরাপত্তা প্রহরী নজরুল ইসলামকে ১২ লাখ ৫০ হাজার টাকা দেন। নজরুল ৩ লাখ টাকা সেলিম শরীফকে প্রদান করেন। অভিযুক্তদের মধ্যে তিনজনকে বাধ্যতামূলক অবসর, বাকিদের সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছেন।
প্রাথমিকভাবে কাজল মোল্লার ওয়ান ব্যাংক ও ডাচ-বাংলা ব্যাংকের নামে ৩০টি হিসাব স্থগিত করেছে এনবিআর। সব হিসাব জব্দ করলে তার সম্পদের বৈধতার কথা বলে আদালতে রিট করলে তা খারিজ করে দেন আদালত।
শাহাদাত হোসেন কাজল মোল্লার বক্তব্য: কর জালিয়াতি সম্পর্কে জানতে চাইলে নিজেকে নির্দোষ দাবি করেন শাহাদাত হোসেন কাজল মোল্লা। তিনি বলেন, ‘এসব বিষয়ে আমি জড়িত নই। আমি কর আইনজীবি নইÑ আমার ছোট একটা ব্যবসা আছে, সেটার আয়ে চলি। আমার বিষয়ে কে, কি ছড়িয়ে দিচ্ছে, তা আমি জানি না। ফারইস্ট নিটিং, এপিএস গ্রুপের কর জালিয়াতি সম্পর্কেও আমি জানি না।’ ১ কোটি ২৫ লাখ টাকা করফাঁকি সম্পর্কে তিনি রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘আমার কর ফাঁকি নেই। বাড়িঘর, ঋণ সব আয়কর ফাইলে তোলা আছে। তবে তারা কেন এটা করছে, তারাই ভালো বলতে পারবে। কেউ আমাকে ফাঁসিয়ে দিচ্ছে।’
কর জালিয়াতি সম্পর্কে কর আইনজীবি সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবু নাসের মজুমদার বলেন, ‘তার কথা আগেও শুনেছি। তার ঘটনায় করদাতাসহ কর আইনজীবিরও দায় রয়েছে। তাই প্রকৃত কর আইনজীবির কাছে গিয়ে কর দেওয়া উচিত।’ তিনি রূপালী বাংলাদেশকে আরও বলেন, ‘যেই প্রতারণা করুক তাকে শাস্তির আওতায় আনা দরকার। এসব কাজে বেশি তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী জড়িত। সরকারকে এ বিষয়ে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি গ্রহণের কথা বলেন’ আবু নাসের।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কর অঞ্চল-১ এর এক শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, ‘এটা আরও আগের ঘটনা। তবে তাদের বিষয়ে অনুসন্ধান চলমান এবং কয়েকজনকে শাস্তির আওতায় আনা হয়েছে।’
আপনার মতামত লিখুন :