ঐতিহাসিক জুলাই গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের মধ্য দিয়ে দেশে নতুন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট সৃষ্টি হয়। সেই প্রেক্ষাপটে বিপাকে বা কোণঠাসা অবস্থায় রয়েছে বিগত সরকারের আমলে সুবিধাভোগী জাতীয় পার্টিসহ আওয়ামী লীগের মিত্র ১৪ দলীয় রাজনৈতিক জোট।
প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে আগামী ফেব্রুয়ারিতে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজনের জন্য সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করতে নির্বাচন কমিশনকে চিঠি দেওয়ার পর বিএনপি, জামায়াতসহ প্রায় সব রাজনৈতিক দল ভোটের প্রস্তুতি শুরু করেছে। বিপরীতে বর্তমানে অনেকটা খেইহারা আওয়ামী লীগের মিত্র দলগুলো, যারা শেখ হাসিনার সরকারের আমলে ছিল সুবিধাভোগী। বলা চলে, রাজনীতির মাঠে অনেকটা একঘরে হয়ে পড়েছে এসব দল। রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা মনে করেন, আওয়ামী লীগের দীর্ঘ সাড়ে ১৫ বছরে গণতন্ত্র ধ্বংস, জনগণের ভোটাধিকার হরণ, রাজনৈতিক হত্যা, লুটপাট, প্রতিষ্ঠান ধ্বংসসহ সবকিছুর জন্য এই দলগুলোও সমান অপরাধী। তাদের বিচার নিশ্চিত হওয়া পর্যন্ত রাজনীতি ও ভোটে সুযোগ দেওয়া উচিত নয়।
বিশ্লেষকেরা মনে করেন, গণঅভ্যুত্থানের পর থেকে নানা ইস্যুতে চাপের মধ্যে রয়েছে জাপাসহ আওয়ামী লীগের আমলে সুবিধাভোগী দলগুলো। বারবার ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলেও ব্যর্থ হচ্ছে তারা। একই সঙ্গে, প্রতিষ্ঠার ৩৯ বছরের মধ্যে সবচেয়ে কঠিন সময় পার করছে জাতীয় পার্টি (জাপা)। নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানে রাষ্ট্রক্ষমতা হারালেও সংসদে প্রতিনিধিত্ব, সরকারের সঙ্গে সমঝোতা এবং বিদেশি বন্ধুত্বে টিকে ছিল দলটি। চরম বিতর্কিত নির্বাচনের সুযোগ নিয়ে গত তিন সংসদে প্রধান বিরোধী দল হলেও ভোটের মাঠে দিনে দিনে দুর্বল হয়ে পড়া জাপা স্বৈরাচারের দোসর আখ্যা পেয়ে পড়েছে অস্তিত্বের সংকটে। অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার পতনের পর আওয়ামী লীগের মিত্র জাপাকেও নিষিদ্ধের দাবি তোলে ছাত্র নেতৃত্ব। পাশাপাশি বিভিন্ন সময়ে অন্তর্বর্তী সরকারের সংলাপে ডাক না পেয়েও একঘরে হয়ে পড়েছে দলটি। রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, ১৪ দলসহ আওয়ামী লীগের মিত্ররা যদি হাসিনার অপকর্মের সঙ্গী না হতো, তাহলে দেশের এ অবস্থা হতো না।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক শামসুল আলম সেলিম রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের যে স্পিরিট, সেটি ধারণ করলে বিচার নিশ্চিতের আগে আওয়ামী লীগের সুবিধাভোগী রাজনৈতিক দলগুলোর কর্মকা- ও নির্বাচনে সুযোগ দেওয়া সমীচীন হবে না। আওয়ামী লীগের অন্যতম দোসর জাতীয় পার্টিসহ সুবিধাভোগী দলগুলোর কর্মকা-ের ভিতিত্তে বিচার নিশ্চিত করে তাদের নির্বাচনের সুযোগ দেওয়া যেতে পারে। আওয়ামী লীগ দীর্ঘ ১৫ বছর যে অত্যাচার, গুমসহ ’২৪-এর জুলাই গণঅভ্যুত্থানে গণহত্যা চালিয়েছে, তার জন্য সুবিধাভোগী দলগুলোও সমান অপরাধী।
তিনি আরও বলেন, এখনো জাপাসহ এই দলগুলোর সঙ্গে আওয়ামী লীগের যোগসূত্র থাকতে পারে। তাদের মাধ্যমেই আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতায় আসার চেষ্টা করবে। যদি তা-ই হয় এবং পার্লামেন্টে তাদের হাত ধরে ফ্যাসিস্ট জনপ্রতিনিধি সংসদে যায়, তাহলে জাতির জন্য দুর্ভাগ্যজনক হবে। তাদের সব রাজনৈতিক হত্যা, ব্যাংক লুট, মিথ্যা ও প্রতিষ্ঠান ধ্বংসÑ সবকিছুর জন্য বিচার নিশ্চিত হওয়া উচিত। একই সঙ্গে তাদের রাজনীতির বিষয়েও সচেতন থাকবে হবে।
দীর্ঘ সময় ধরে আওয়ামী লীগের জোটসঙ্গী ১৪ দলসহ মিত্র দলগুলোর রাজনৈতিক কার্মকা- না থাকলেও নির্বাচন ঘিরে ঘুরে দাঁড়াতে চেষ্টা চালাচ্ছে। তবে, আওয়ামী লীগের সুবিধাভোগী হিসেবে এরই মধ্যে গ্রেপ্তার হয়েছেন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) সভাপতি হাসানুল হক ইনু, ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন, জাতীয় পার্টির (জেপি) আনোয়ার হোসেন মঞ্জু, তৃণমূল বিএনপির চেয়ারম্যান শমসের মবিন চৌধুরীসহ বেশ কয়েকজন শীর্ষ নেতা। একই সঙ্গে মামলা থাকায় অন্য দলগুলোর শীর্ষস্থানীয় প্রায় সব নেতা দলীয় কার্যক্রম পরিচালনার কথা ভুলে গ্রেপ্তার আতঙ্কে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। তালাবদ্ধ রয়েছে দলগুলোর কেন্দ্রীয় কার্যালয়।
বর্তমান পেক্ষাপট তুলে ধরে জাতীয় পার্টির (জাপা) চেয়ারম্যান জি এম কাদের রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, সরকার জাতীয় পার্টিকে রাজনীতিতে কোণঠাসা করতে চাইছে। আমাদের সঙ্গে বৈষম্য শুরু হয়েছে। স্বাভাবিক রাজনীতিতে বাধা দেওয়া হচ্ছে, নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে হয়রানিমূলক মামলা দেওয়া হচ্ছে। সে হিসাবে আমরা নব্য ফ্যাসিবাদের শিকার বলেই মনে করি।
এদিকে গতকাল শনিবার নির্বাচন ইস্যুতে জাতীয় পার্টির দশম কাউন্সিলে একাংশের নির্বাহী চেয়ারম্যান হিসেবে মো. মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, ‘আওয়ামী সরকারের সঙ্গে নির্বাচনে অংশ নেওয়ায় দেশবাসীর কাছে নিঃশর্ত ক্ষমা চাইছি। দলীয়ভাবে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে কোনো বেআইনি কাজ করিনি। যদি নৈতিকভাবে কোনো ভুল হয়ে থাকে, কোনো ভ্রান্তি হয়ে থাকে, তাহলে দলের পক্ষ থেকে দেশবাসীর কাছে আমরা নিঃশর্ত ক্ষমা চাই। তিনি বলেন, বিগত সময়ে অনেকগুলো নির্বাচন করেছি। অনেক সময় অনেকে আমাদের বিভিন্নভাবে কটূক্তি করেন, বিভিন্ন দলের সহযোগী বা স্বৈরাচারের সহযোগী হিসেবে আমাদের আখ্যায়িত করেন। আমি গত প্রায় চার বছর জাতীয় পার্টির মহাসচিব হিসেবে ছিলাম। আমরা রাজনীতি করতে গিয়ে দলীয় সিদ্ধান্তে সব সময় হয়তো সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারিনি। ভুলভ্রান্তি থাকতে পারে।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওয়ার্কার্স পার্টির সম্পাদকীয় কমিটির এক নেতা বলেন, ‘আমাদের সবার বিরুদ্ধে মামলা না হলেও আটক করা হলে যেকোনো মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো সম্ভব। ফলে এখনো আতঙ্কের জন্যই দলীয় কার্যক্রম চালানো সম্ভব হয়নি। আমরা মাঠের পরিস্থিতি যাচাই করছি, নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার পর ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা থাকবে।’
আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ), ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ), বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ), গণফোরামসহ ১৪ দল মিলে গঠন করা হয় জোটটি। পরে নানা মতানৈক্যকে কেন্দ্র করে সিপিবি, বাসদ, গণফোরামসহ কয়েকটি দল বেরিয়ে যায়। ২০১৩ সালে জাতীয় পার্টি (জাপা) জোট ত্যাগ করে। ভাঙা-গড়ার জোটে যোগ দেয় আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি (জেপি) ও নজিবুল বশর মাইজভা-ারীর নেতৃত্বাধীন তরিকত ফেডারেশন।
বর্তমানে আওয়ামী লীগ ছাড়া জোটের অন্য শরিক দলগুলো হলো বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদ, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ), জাতীয় পার্টি (মঞ্জু), তরীকত ফেডারেশন, সাম্যবাদী দল (এমএল), গণতন্ত্রী পার্টি, গণআজাদী লীগ, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ-রেজাউর), গণতান্ত্রিক মজদুর পার্টি ও কমিউনিস্ট কেন্দ্র। এই ১৪ দলের মধ্যে দুই দল বলা যায় অস্তিত্বহীন।
সর্বশেষ জুলাই গণঅভ্যুত্থান চলাকালে শিক্ষার্থীদের ওপর দমন-নিপীড়ন আর পুলিশি বর্বর অ্যাকশনের মদতদাতাও ছিলেন এই ১৪ দলীয় জোটের নেতারা। অভিযোগ রয়েছে, আওয়ামী লীগের অধীনে অনুষ্ঠিত হওয়া তুমূল বিতর্কিত বিগত দশম, একাদশ ও দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজনে এসব দলের মুখ্য ভূমিকা রয়েছে।
উল্লেখ্য, ১৪ দলীয় জোটের প্রধান শরিক আওয়ামী লীগ এবং এর সব অঙ্গ সংগঠন, সহযোগী সংগঠন ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের যাবতীয় কার্যক্রম নিষিদ্ধ করার বিষয়টি উল্লেখ করে জোটের অপর দলগুলোর বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে অনুরোধ জানিয়ে আইনি নোটিশ পাঠানো হয়। প্রধান নির্বাচন কমিশনার, আইনসচিব এবং প্রধান উপদেষ্টার মুখ্য সচিব বরাবর ওই নোটিশ পাঠানো হয়।
জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) কর্মী হোসাইন মো. আনোয়ারের পক্ষে আইনজীবী মো. সালাহ উদ্দিন রিগ্যান নোটিশটি পাঠান। নোটিশের ভাষ্য, ৭৫ বছর বয়সি আওয়ামী লীগ ৩৬ দিনের আন্দোলনে গত ৫ আগস্ট পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। সব ধরনের রাজনৈতিক কার্যক্রম থেকে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। আওয়ামী লীগ শাসনামলের সহযোগী হিসেবে ১৪ দল একই অপরাধ করেছে অভিযোগ করে নোটিশে বলা হয়, আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ হলে অপর দলগুলো কেন নয়?
আপনার মতামত লিখুন :