- ডিমের ডজন ১৫০ টাকা
- সবজির কেজি অন্তত ৮০
- সস্তায় বিক্রি আলু-পেঁপে
ঢাকার বাজারে ১০টি ভোগ্যপণ্যের মধ্যে ৮টিরই দাম বেড়েছে। আলু ও পেঁপে ছাড়া সব ধরনের সবজির কেজি এখন অন্তত ৮০ টাকা। মূল্যবৃদ্ধির তালিকার শীর্ষে রয়েছে সব ধরনের সবজি। রাজধানীতে গত এক মাসের ব্যবধানে প্রতি কেজি সবজির দাম বেড়েছে অন্তত ২০ টাকা, যা গত বছরে একই সময়ে ছিল ৫০ থেকে ৬০ টাকা।
তবে শুধু আলু ও পেঁপের দাম বাড়েনি। মধ্যবিত্ত ও মজুর শ্রেণির প্রধান আমিষ ডিমের ডজনও এখন ১৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আমদানিনির্ভরতা না থাকলেও দেশীয় এসব খাদ্যপণ্যের দাম বছরের ব্যবধানে প্রায় দ্বিগুণ বেড়েছে। ফলে অতিমূল্যের আগুনে পুড়ছেন ভোক্তারা। অন্যদিকে অতিমূল্যের বাজারে দোকানে ক্রেতা কমায় অস্বস্তি প্রকাশ করছেন বিক্রেতারা।
গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানীর মগবাজারের চারুলতা মার্কেট, মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেট, টাউন হল বাজার, আগারগাঁও, শান্তিনগর, তালতলা ও কারওয়ান বাজার ঘুরে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। বাজারের কয়েকজন ক্রেতা জানান, দিন দিন কাঁচাবাজারে সব জিনিসের দাম বাড়ছে। সবজির দাম গত দুই সপ্তাহের তুলনায় এ সপ্তাহে ১০ থেকে ২০ টাকা এবং ডিমের দাম ২০ টাকা বেড়েছে। গরিবের খাবার মোটা চালের দাম গত এক বছরে প্রতি বস্তায় বড়েছে ১ হাজার টাকা।
ঢাকায় সবজির দাম বাড়লেও চট্টগ্রামে নি¤œমুখী দর। গত সপ্তাহে বৃষ্টিতে শাকসবজি ও পচনশীল পণ্যের সরবরাহ বিঘিœত হওয়ায় দাম বাড়তি থাকলেও বৃষ্টি কমার সঙ্গে সঙ্গে বাজারগুলোতে সবজির দাম কমতে শুরু করেছে।
ঢাকার বাজার পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, গত এক বছরে সামগ্রিক অর্থনীতির লক্ষণ ভালোর দিকে গেছে। তবুও ভর্তুকি মূল্যে খাদ্যপণ্য বিক্রি করা ট্রাকের পেছনে মানুষের ভিড় কমেনি। সামষ্টিক অর্থনৈতিক উন্নতির আড়ালে ক্ষুধা এখনো তীব্রভাবে আঁকড়ে ধরে আছে নি¤œআয়ের মানুষকে। মূল্যস্ফীতির দিকে ধাবিত হচ্ছে আরেক দফা পারদ। মূল্যবৃদ্ধির একই তথ্য প্রকাশ করেছে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি)।
মূল্যবৃদ্ধির আগুনে পুড়তে থাকা ভোক্তা ও ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, বছরের ব্যবধানে প্রতিটি পণ্যের দাম প্রায় দ্বিগুণ বেড়েছে। বাজারে সরবরাহ পরিমিত থাকলেও ধীরে বাড়ছে এসব পণ্যের দাম। ভোগ্যপণ্যের তালিকা তুলে ধরে টিসিবি গতকাল বৃহস্পতিবার জানিয়েছে, খোলা ময়দা, চিনি, আটা, মুগ ডাল, ছোলা, ব্রয়লার মুরগি ও ডিমের দাম সপ্তাহের ব্যবধানে বেড়েছে। অন্যদিকে সয়াবিন তেল (২ লিটার) ও আমদানি করা রসুনের দাম কমেছে।
ঢাকার বাজারে উত্তাপ ছড়ানো কাঁচা মরিচের দাম ২০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। প্রতি কেজি পটোল, মুখিকচু, চিচিঙ্গা, ধুন্দল, কচুর লতি ও বরবটি, ঢেঁড়স, করলা ও কাঁকরোলের কেজি এখন ৮০ থেকে ১০০ টাকা। এক মাস আগেও দাম ছিল সর্বোচ্চ ৬০ টাকা; যা গত বছরে বিক্রি হয়েছে ৪০-৬০ টাকা কেজি দরে। ঢাকার বাজারে শুধু পেঁপে ২০ টাকা ও আলু ২৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ৩০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হওয়া মিষ্টি কুমড়াও এখন ৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। লাউ প্রতি পিস বিক্রি হচ্ছে ৮০ টাকা এবং বেগুন মানভেদে ১৫০ থেকে ২০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
রাজধানীর শান্তিনগর বাজারে বেসরকারি চাকরিজীবী রহমান রাফি বলেন, ‘বাজারে সবজির দাম কয়েক দিন ধরে অনেক বেড়েছে। কিছুদিন আগেও সবজির দাম কম ছিল, দুই সপ্তাহ ধরে দাম বাড়তি। দোকানে ডিমের ডজন বিক্রি হচ্ছে ১৪৫ থেকে ১৫০ টাকায়।’ কারওয়ান বাজারের ডিম ব্যবসায়ী উজ্জ¦ল বলেন, ‘বাজারে এখন প্রতি ডজন ডিমের দাম ১৪০ থেকে ১৫০ টাকা। এর মধ্যে ১৪০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে সাদা ডিম আর ১৫০ টাকা বাদামি রঙের ডিম। ১০ দিন আগেও প্রতি ডজন ডিমের দাম ছিল ১২০ থেকে ১৩০ টাকা। সোনালি মুরগির দাম আরও বেড়ে কেজি এখন ৩৪০ টাকা। ব্রয়লার মুরগি বিক্রি হচ্ছে ১৭০ থেকে ১৮০ টাকা।
বিক্রেতারা বলছেন, বাজারে সবজি ও মাছের দাম অনেক বেশি। তাই নি¤œ আয়ের অনেক মানুষ বাধ্য হয়ে মাছ ও সবজির বদলে ডিমে বেশি আগ্রহী হয়েছেন। যার কারণে দাম বাড়ছে। একই সঙ্গে ‘দেশি মসুরের দাম কেজিতে ৪০ টাকা বেড়ে ১৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে’ বলে জানিয়েছেন কিচেন মার্কেটের এক ব্যবসায়ী।
মূল্যবৃদ্ধির তালিকায় থাকা চালের দাম সম্পর্কে কারওয়ান বাজার কিচেন মার্কেটের আল্লাহর দান রাইস এজেন্সির এম এ আউয়াল তালুকদার বলেন, ‘সরু চালের কেজি এখন ৮০ টাকা। তবে একটু ভালো মানের চিকন চালের বস্তা (৫০ কেজি) এখন ৪ হাজার ২০০ টাকা। গত বছরে যে চালের বস্তা ২৯০০ থেকে ৩১০০ টাকায় বিক্রি করতাম। বছরের ব্যবধানে বস্তায় বেড়েছে প্রায় ১১০০ টাকা।’ ঢাকার অধিকাংশ বাজারে সাগর, ডায়মন্ড, রশিদ, মোজাম্মেলসহ বিভিন্ন প্রকারের চাল রয়েছে।
তবে পণ্যের দাম বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন কারণে চলতি বছরে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বাড়বে। বিশ্বব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, ২০২২ সালে চরম দরিদ্র মানুষের সংখ্যা ছিল ৯৫ লাখ। যা এ বছর পৌঁছাবে ১ কোটি ৫০ লাখে। যাদের দৈনিক আয় ২ ডলার ১৫ সেন্ট (প্রতি ডলারের দাম ১২১ টাকা হিসাবে প্রায় ২৬০ টাকা) বা তার কম, তাদের জন্য দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে ৯ শতাংশের বেশি মূল্যস্ফীতি মানে হলো ক্ষুধা, আর অনেক ক্ষেত্রে অনাহার।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক সেলিম রায়হান বলেন, ‘বিশ্ববাজারে চালসহ খাদ্যের দাম উল্লেখযোগ্যভাবে কমলেও তার প্রতিফলন দেশের বাজারে নেই। দেশে মূল্যস্ফীতি কমলেও চাল ও অন্যান্য নিত্যপণ্যের দাম না কমায় খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির মুখে। গত এক বছরে এই অবস্থার বড় কোনো উন্নতি হয়নি।’
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক হিসেবে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে খাদ্য নিরাপত্তার চ্যালেঞ্জ অনেক দিন ধরেই রয়েছে। শুধু বাজারে খাদ্য থাকলেই সেটাকে খাদ্য নিরাপত্তা বলা যাবে না। মানুষের প্রয়োজন চাকরি এবং প্রকৃত আয় বৃদ্ধি দরকার। নিঃসন্দেহে বলা যায়, খাদ্য নিরাপত্তা অবনতির দিকে গেছে। গত দু-তিন বছরে আন্তর্জাতিক সংস্থার জরিপ ও প্রাক্কনেও একই চিত্র দেখাচ্ছে। দরিদ্রতম মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা আরও খারাপ হয়েছে।’
২০২৪-২৫ অর্থবছরে সরকার প্রায় সাড়ে ৩২ লাখ টন খাদ্যপণ্য ভর্তুকি মূল্যে বিতরণ করেছে, যা আগের বছরের প্রায় সমান। ২০২৫-২৬ অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রায় এই পরিমাণ বাড়িয়ে ৩৬ লাখ ৬১ হাজার টন ধার্য করা হয়েছে।
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন