- চুক্তি হয়নি, আসেনি যুদ্ধবিরতির ঘোষণাও
- বৈঠক ফলপ্রসূ, বলেছেন উভয় নেতাই
- ট্রাম্পের সঙ্গে কথা বলতে আগামীকাল যুক্তরাষ্ট্রে যাচ্ছেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট
- চুক্তি না হওয়ায় স্বস্তি, আগামী নিয়ে অনিশ্চয়তায় ইউক্রেনীয়রা
- ট্রাম্পের বিশ^াসে ফাটল, বৈঠকই পুতিনের বড় অর্জন
ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিনের মধ্যে আলাস্কা বৈঠক নিয়ে গত কয়েক দিন ধরেই বিশ^ব্যাপী ব্যাপক অলোচনা ছিল। যুদ্ধ বন্ধে ট্রাম্পের গভীর আত্মবিশ^াসের পাশাপাশি রাশিয়ার প্রতি হালকা হুঁশিয়ারি বৈঠক থেকে ইতিবাচক ফলাফল আসার বিষয়ে কিছুটা সম্ভাবনাও দেখছিলেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো। তবে বৈঠক বা চুক্তি নিয়ে ট্রাম্পের যতটা আশাবাদ ছিল, রাশিয়া ও প্রেসিডেন্ট পুতিনের মধ্যে তেমনটা দেখা যায়নি। অন্যদিকে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভøাদেমির জেলেনস্কি অনুষ্ঠিতব্য বৈঠকে তার অনুপস্থিতিতে কোনো ধরনের চুক্তি বা ইতিবাচক ফলাফল আসতে পারে না বলে আগেই আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন। বহুল আলোচিত এই বৈঠকে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভøাদেমির জেলেনস্কিকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি।
অবশেষে জেলেনেস্কির অনুমান সত্য করেই ট্রাম্প-পুতিনের বহুল আলোচিত প্রায় তিন ঘণ্টার দীর্ঘ আলাস্কা বৈঠক কোনো ধরনের চুক্তি ছাড়াই শেষ হয়েছে। বৈঠকের পর উভয় নেতাই আলাস্কা ছেড়েছেন। এতে ট্রাম্পের আত্মবিশ^াসে ফাটল দৃশ্যমান হলেও জয় পেয়েছেন পুতিন।
যুক্তরাষ্ট্রের আলাস্কা অঙ্গরাজ্যের অ্যাংকোরেজ শহরের একটি সামরিক ঘাঁটিতে স্থানীয় সময় গত শুক্রবার বৈঠক শেষে পুতিনের সঙ্গে যৌথ সংবাদ সম্মেলনে অংশ নেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট। পরে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প জানান, বৈঠকে আলোচনায় অগ্রগতি হলেও এখনো লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারেননি তারা। তবে পরবর্তী সময়ে এ নিয়ে অগ্রগতি অর্জনের জন্য খুব ভালো সুযোগ রয়েছে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন তিনি।
অন্যদিকে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন বলেছেন, ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধ হোক তিনিও তা আন্তরিকভাবে চান। তবে যুদ্ধ বন্ধের জন্য এই যুদ্ধের ‘মূল কারণগুলো’ নিরসনের ওপর জোর দিয়েছেন তিনি। সংবাদ সম্মেলনে দুই নেতা বক্তব্য দিলেও তারা সাংবাদিকদের কাছ থেকে কোনো প্রশ্ন নেননি।
এদিকে ট্রাম্পের সঙ্গে বৈঠকের বিষয়ে টেলিফোনে দীর্ঘ আলাপ হয়েছে বলে জানিয়েছেন ইউক্রেইনের প্রেসিডেন্ট ভøাদেমির জেলেনস্কি। তিনি জানান, আগামীকাল ট্রাম্পের সঙ্গে কথা বলতে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসিতে যাচ্ছেন।
চুক্তি ছাড়াই শেষ ট্রাম্প-পুতিন বৈঠক :
গত শুক্রবার বেলা ১১টার দিকে যুক্তরাষ্ট্রের আলাস্কার এলমেনডর্ফ-রিচার্ডসন সামরিক ঘাঁটিতে পুতিনকে বহনকারী উড়োজাহাজ অবতরণ করে। এর কিছুক্ষণ আগেই ট্রাম্পকে বহনকারী উড়োজাহাজও সেখানে এসে পৌঁছায়। বিমানবন্দরে পুতিনকে লালগালিচায় উষ্ণভাবে বরণ করে নেন ট্রাম্প। এরপর মার্কিন প্রেসিডেন্টের গাড়িতে করে দুই নেতা বৈঠকস্থলে যান।
তবে বৈঠকে যাওয়ার আগেই পুতিনকে নিজেদের সামরিক শক্তি দেখিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। পুতিন যখন লালগালিচায় ট্রাম্পের সঙ্গে হেঁটে যাচ্ছিলেন, তখন আকাশে হঠাৎ গর্জে ওঠে এক বিশাল বি-২ স্পিরিট স্টেলথ বোমারু বিমান। এটির সঙ্গে ছিল আরও কয়েকটি মার্কিন যুদ্ধবিমান। পুতিনও সেই মুহূর্তে আকাশের দিকে তাকান। বি-২ যুদ্ধবিমান সহজেই শক্তিশালী আকাশ প্রতিরক্ষা ভেদ করে নির্ভুল নিশানায় হামলা চালাতে সক্ষম। গত জুনে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোতে মার্কিন বাহিনী এই যুদ্ধবিমান দিয়েই হামলা চালিয়েছিল। এই প্রদর্শন আসলে রাশিয়ার সঙ্গে আলোচনার আগে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক শক্তির স্পষ্ট বার্তা বহন করছিল।
ইতিপূর্বে ট্রাম্প ও পুতিনের মধ্যে আলাস্কা বৈঠকে ‘ওয়ান টু ওয়ান’ হওয়ার কথা থাকলেও তা হয়নি। গতকালের বৈঠকে দুই দেশের পক্ষ থেকে আরও দুজন করে কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন। রুদ্ধদ্বার বৈঠকে ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধের বিষয়ে কী আলোচনা হয়েছে, তা বিস্তারিত প্রকাশ করা হয়নি। রুদ্ধদ্বার বৈঠক শেষে ট্রাম্প ও পুতিন যৌথ সংবাদ সম্মেলনে আসেন। তারা বৈঠক ‘ফলপ্রসূ’ হয়েছে বলে মন্তব্য করেন। তবে ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, ‘চুক্তি সই না হওয়া পর্যন্ত বলা যাবে না যে কোনো চুক্তি হয়েছে।’ ট্রাম্প জানান, বিষয়টি নিয়ে তিনি জেলেনস্কি ও ইউরোপীয় নেতাদের সঙ্গে ফোনে কথা বলবেন।
আর পুতিন বলেছেন, যুদ্ধ বন্ধে রাশিয়াও আন্তরিক। তবে এর আগে যুদ্ধের কারণগুলো সমাধানের ওপর জোর দেন তিনি। পুতিন বলেন, তাদের পরবর্তী বৈঠক হতে পারে মস্কোয়। সংবাদ সম্মেলনে শত শত সাংবাদিক উপস্থিত ছিলেন। তাদের কোনো প্রশ্ন না নিয়েই সংবাদ সম্মেলনস্থল ত্যাগ করেন উভয় নেতা। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট তাকে বহনকারী উড়োজাহাজে ওঠেন। পুতিন বিমানে ওঠার মিনিট দশেক পরে ট্রাম্পও তাকে বহনকারী বিমানে চড়েন। এর কিছুক্ষণের মধ্যেই উড়োজাহাজ দুটি নিজ নিজ গন্তব্যের উদ্দেশে রওনা করে।
পরবর্তীতে বৈঠক নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের গণমাধ্যম ফক্স নিউজকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বলেছেন, ‘খুব ভালো বৈঠক হয়েছে।’ অন্যদিকে বৈঠকের প্রতিক্রিয়ায় ক্রেমলিন মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ বলেছেন, ট্রাম্প ও পুতিন বৈঠকটি ছিল খুবই ইতিবাচক।
আগামীকাল যুক্তরাষ্ট্রে যাচ্ছেন জেলেনস্কি :
এদিকে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির জেলেনস্কি জানিয়েছেন, ট্রাম্পের সঙ্গে কথা বলতে সোমবার তিনি যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসিতে যাচ্ছেন। পরে টেলিগ্রামে খবরের আপডেট জানিয়ে তিনি ‘আমন্ত্রণ জানানোয়’ ট্রাম্পের প্রতি ‘কৃতজ্ঞতাও’ প্রকাশ করেছেন বলে জানিয়েছে বিবিসি।
গতকাল শনিবার জেলেনস্কি বলেছেন, তার সঙ্গে ভার্চুয়ালি ট্রাম্পের ‘লম্বা ও বিস্তারিত’ আলাপ হয়েছে। প্রথমে তারা ঘণ্টাখানেক একে অপরের সঙ্গে কথা বলেন, পরে ইউরোপের নেতারাও তাদের সঙ্গে যোগ দেন।
আলাস্কা বৈঠক থেকে বাদ পড়ায় ইউক্রেনীয়রা হতাশ ছিলেন। তবে সোমবার ট্রাম্পের সঙ্গে বৈঠককে ইতিবাচকভাবেই দেখছেন জেলেনস্কি।
জেলেনস্কি বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে মিলে নির্ভরযোগ্য নিরাপত্তা নিশ্চয়তা নিশ্চিত করতে প্রতিটি পর্যায়ে ইউরোপীয় নেতাদেরও থাকা জরুরি। এদিকে ট্রাম্পের সঙ্গে বৈঠকের পর জেলেনস্কি ও ইউরোপীয় নেতারা পরে নিজেদের মধ্যে আরেকটি বৈঠক করেছেন। এসব বৈঠকে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার, ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ, ইতালির প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনি, জার্মান চ্যান্সেলর ফ্রিডরিশ মার্ৎস, পোল্যান্ডের প্রেসিডেন্ট কারোল নাভ্রোৎস্কি, ফিনল্যান্ডের প্রেসিডেন্ট আলেক্সান্ডার স্টাব, নেটো মহাসচিব মার্ক রুটে এবং ইউরোপিয়ান কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ফন দার লায়েন উপস্থিত ছিলেন বলে জানিয়েছে বিবিসি।
পুতিন এবং পরে জেলেনস্কি ও নেটো-ইউরোপীয় নেতাদের সঙ্গে বৈঠকের পর ট্রাম্প বলেছেন, এ বিষয়ে সবারই সিদ্ধান্ত হচ্ছে, রাশিয়া ও ইউক্রেইনের মধ্যে ভয়াবহ যুদ্ধ শেষ করার সেরা উপায় হচ্ছে সরাসরি একটি শান্তিচুক্তির দিকে যাওয়া। এতে যুদ্ধ বন্ধ হবে এবং ‘কোনো রকমে যুদ্ধবিরতি চুক্তি’র তুলনায় অনেক ভালো কিছু হবেÑ ট্রুথ সোশ্যালে এমনটাই লিখেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট।
ইউক্রেনে স্বস্তি এলেও অনিশ্চয়তার ভয় :
আলাস্কা বৈঠকে কোনো চুক্তি না হওয়ায় দৃশ্যত ইউক্রেন কিছুটা স্বস্তিতে আছে এই ভেবে যে, তাদের এখনো কোনো ভূখ- ছাড়তে হয়নি। ইউক্রেনের জনগণ জানেন, অতীতে রাশিয়ার সঙ্গে করা প্রায় সব চুক্তিই ভেস্তে গেছে। তাই এখানে কোনো চুক্তি হলেও তারা তা নিয়ে সন্দিহান থাকতেন।
তবে একটা বিষয় তাদের নতুন করে আতঙ্কিত করেছে। গণমাধ্যমের সামনে ট্রাম্পের পাশে বসেই পুতিন বলেছেন, যুদ্ধের ‘মূল কারণগুলো’ দূর না হলে স্থায়ী শান্তি আসবে না। এই ভাষার অর্থ হচ্ছে, পুতিন এখনো তার ‘বিশেষ সামরিক অভিযান’-এর মূল লক্ষ্য থেকে সরে আসেননি। সেই লক্ষ্য হলো ইউক্রেনকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ভেঙে দেওয়া। পশ্চিমা বিশ্বের তিন-সাড়ে তিন বছরের প্রচেষ্টা তার মনোভাব বদলাতে পারেনি। আলাস্কার এই সম্মেলনও হয়তো তার ব্যতিক্রম নয়। বৈঠকের পর যে অনিশ্চয়তা রয়ে গেছে, সেটিই এখন সবচেয়ে উদ্বেগজনক। সামনে কী হবে? রাশিয়ার হামলা কি নিরবচ্ছিন্নভাবে চলতে থাকবে?
জর্জ ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের সুপার পাওয়ার সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ রবার্ট লিটওয়াক বলেছেন, ‘এটি একেবারেই কিমের বৈঠকের মতো। চমকপ্রদ আয়োজন বেশি, কিন্তু বিষয়বস্তুতে শূন্য। প্রস্তুতি ছিল খুবই সামান্য।’
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোনো চুক্তি না হলেও একটি বড় জয় হয়েছে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিনের। তিনি নিষেধাজ্ঞায় বন্দি এক স্বৈরশাসকের অবস্থান থেকে বেরিয়ে এসেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট তাকে স্বাগত জানিয়েছেন এক শান্তির দূত হিসেবে।
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন