সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার সাদাপাথর লুটের ঘটনায় গঠিত জেলা প্রশাসনের তদন্ত কমিটি প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। গতকাল বুধবার বিকেলে ৭ পৃষ্ঠার এ প্রতিবেদন জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে জমা দেওয়া হয়েছে। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন তদন্ত কমিটির প্রধান, সিলেটের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (উন্নয়ন ও মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা) পদ্মাসন সিংহ। তবে এ ব্যাপারে তিনি আর কিছু বলতে রাজি হননি। বলেন, বৃহস্পতিবার (আজ) সিলেটের নতুন জেলা প্রশাসক কর্মস্থলে যোগ দেওয়ার কথা। রিপোর্ট দেখে যা বলার তিনিই বলবেন।
জেলা প্রশাসনের একটি সূত্র অবশ্য জানিয়েছে, বদলির আদেশ পাওয়া জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শের মাহবুব মুরাদের হাতে প্রতিবেদন জমা দেয় কমিটি। তবে তার শেষ কার্যদিবস হওয়ায় তিনি এ নিয়ে কোনো পদক্ষেপে যাননি, এমনকি তা প্রকাশ করেননি। নতুন জেলা প্রশাসক দায়িত্ব নেওয়ার পর তিনি সেটি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠাবেন। প্রতিবেদনে গণমাধ্যমসহ একাধিক মাধ্যম থেকে পাওয়া বিভিন্ন ব্যক্তির একটি তালিকা সংযুক্ত করা হয়েছে। তালিকায় ১৩৭ জনের নাম রয়েছে। এ প্রতিবেদনে কারা কীভাবে পাথর লুট করে এবং পরিবেশ বিনষ্ট করে; সে বিষয়ে তুলে ধরা হয়েছে। পাশাপাশি ১০টি সুপারিশও করা হয়েছে।
সম্প্রতি সাদাপাথর পর্যটনকেন্দ্র এলাকা থেকে পাথর লুটের ঘটনায় দেশজুড়ে ব্যাপক সমালোচনা হয়। অভিযানে নামে যৌথবাহিনী। লুট হওয়া পাথর উদ্ধার অভিযান শুরু করে তারা। আলোচিত এ ঘটনার পর জেলা প্রশাসন তিন সদস্যের কমিটি গঠন করে। এতে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক পদ্মাসন সিংহকে প্রধান করে তিন সদস্যের কমিটিতে রাখা হয় কোম্পানীগঞ্জের ইউএনও আজিজুন্নাহার ও সিলেট পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক আফজালুল ইসলাম লিংকনকে। তবে পাথর লুটের ঘটনায় আজিজুন্নাহারের যোগসাজশের অভিযোগ থাকলেও তাকে তদন্ত কমিটির সদস্য করায় এই কমিটিকে নিয়ে কঠোর সমালোচনা শুরু হয়। ওই কমিটির গত ১৭ আগস্টের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিল করার কথা ছিল। পরে আরও তিন দিন সময় বাড়ানো হয়। তদন্ত শেষে গতকাল বুধবার প্রতিবেদন দাখিল করেন কমিটির সদস্যরা।
সম্প্রতি সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার ভোলাগঞ্জের সাদাপাথরের প্রায় ১০ লাখ ঘনফুট পাথর লুট করে নিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা। বিষয়টি জানাজানি হলে সারা দেশে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। রিট হয় উচ্চ আদালতে। আদালত লুণ্ঠিত পাথর উদ্ধার করে আবার যথাস্থানে প্রতিস্থাপনের নির্দেশ দেন। এরপর সিলেট এবং নারায়ণগঞ্জে শুরু হয় প্রশাসনের সাঁড়াশি অভিযান। বিভিন্ন স্থান থেকে উদ্ধার করা হয়েছে ৫ লক্ষাধিক ঘনফুট সাদাপাথর।
এদিকে গত ৮ জুলাই উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ে পরিবহন শ্রমিক নেতা ও রাজনৈতিক নেতাদের একটি বৈঠকে বিভাগীয় কমিশনার বলেন, দেশের অন্য সব এলাকায় পাথর উত্তোলন হলে সিলেটে কেন হবে না। এই বক্তব্যকে লুটপাটকারীরা তাদের মহোৎসব চালানোর হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে, যার পরিণতিতে সাদাপাথর লুটপাট হয়। এমন অভিযোগ নানান মাধ্যম থেকে আলোচনা হচ্ছে। তবে এর পরিপ্রেক্ষিতে সিলেটের বিভাগীয় কমিশনার খান মো. রেজা-উন-নবী নিজের দায় অস্বীকার করে বলেন, আমরা ইজারা নিয়ে কথা বলেছি। পাথর চুরি নিয়ে কিছু বলা হয়নি। পাথরচোরদের উৎসাহিত করার মতো কিছু আমি বলিনি। তেমন কিছু কেউ বললে বা ছড়ালে সেটা ভুল মেসেজ।
গতকাল বুধবার দুপুরের দিকে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা পরিষদ মিলনায়তনে কর্মরত-কর্মকর্তাদের সাথে মতবিনিময় সভা শেষে সাংবাদিকদের সাথে আলাপকালে তিনি এসব কথা বলেন।
তিনি জানান, সম্প্রতি সিলেটের কোম্পানীগঞ্জের ভোলাগঞ্জ সাদাপাথরের পাথর লুটকারীদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা তৈরি হচ্ছে। কাজ চলছে সতর্কতার সাথে। যাতে প্রকৃত দোষীদের নাম তালিকায় আসে এবং নির্দোষ মানুষ হয়রানির শিকার না হন। তালিকা তৈরির পর তা প্রকাশ করা হবে।
তিনি বলেন, সিলেটে চোরাচালান ও খনিজ সম্পদ রক্ষায় জনবল বাড়ানো হচ্ছে। বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ-বিজিবির আরও তিনটি ব্যাটালিয়ন স্থাপনের বিষয়ে আলোচনা চলছে। তবে এর মধ্যে একটি ব্যাটালিয়ন স্থাপনের প্রক্রিয়া চলমান। এ ছাড়াও পুলিশের জনবলও বাড়ানো হচ্ছে। এখানে একটি পুলিশ ফাঁড়ি স্থাপনের বিষয়টিও প্রক্রিয়াধীন। এ ছাড়া আরও ক্যাম্প এবং চেকপোস্টও বসানো হবে।
তিনি বলেন, এ ব্যাপারে গোয়েন্দা বাহিনীসহ বিভিন্ন সংস্থার সমন্বয়ে কাজ চলছে। যাতে প্রকৃত লুটপাটকারীদের নাম তালিকায় প্রকাশ হয় এবং নিরপরাধ মানুষ যাতে হয়রানির শিকার না হয়, সে ব্যাপারে লক্ষ্য রেখে কাজ হচ্ছে। সেজন্য একটু সময় দেওয়া প্রয়োজন বলে আমি মনে করি।
অপরদিকে সাদাপাথর লুটে দুদকের তালিকায় সিলেট মহানগর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি রেজাউল হাসান কয়েস লোদী, সাধারণ সম্পাদক ইমদাদ হোসেন চৌধুরী, সিলেট মহানগর জামায়াতে ইসলামীর আমির মো. ফখরুল ইসলাম ও সেক্রেটারি জয়নাল আবেদীন ও জেলা এনসিপির প্রধান দুই নেতা- সিলেট জেলা এনসিপির প্রধান সমন্বয়কারী নাজিম উদ্দিন ও মহানগর প্রধান সমন্বয়কারী আবু সাদেক মোহাম্মদ খায়রুল ইসলাম চৌধুরীসহ ৪২ জনের নাম এসেছে। গণমাধ্যমে এমন খবর প্রচারের পর তারা পাথর লুটের সাথে নিজেদের সংশ্লিষ্টতার কথা অস্বীকার করেন এবং পাথরে জড়িত নন বলে জানান। মহানগর বিএনপি বুধবার সন্ধ্যায় সংবাদ সম্মেলন করে নিজেদের সংশ্লিষ্টতার কথা আনুষ্ঠানিকভাবে অস্বীকার করে। তারা বলেন, অভিযোগ সঠিক নয়। মহানগরের আওতার বাইরে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা। ফলে সেখানকার কোনো নেতাকে নিয়ন্ত্রণ করার সুযোগ নেই বা প্রশ্নই আসে না।
সাদাপাথর ইস্যুতে ৫ সদস্যের উচ্চতর তদন্ত কমিটি গঠন: এদিকে সিলেটে সাদাপাথর লুটের ঘটনায় ৫ সদস্যের উচ্চতর তদন্ত কমিটি গঠন করেছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। এতে ১০ দিনের মধ্যে দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে প্রতিবেদন দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। মন্ত্রিপরিষদের উপসচিব মোহাম্মদ সাহেদুল ইসলাম স্বাক্ষরিত ওই অফিস আদেশে বলা হয়, সিলেট জেলার কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার ভোলাগঞ্জ সাদাপাথর পর্যটন স্পট ও রেলওয়ে বাংকার এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে অবৈধভাবে পাথর উত্তোলনের কারণে পরিবেশ ও পর্যটন স্থানের নান্দনিকতা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সম্প্রতি বিভিন্ন গণমাধ্যমে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার ভোলাগঞ্জ থেকে সাদাপাথর অবৈধভাবে উত্তোলনের বিষয়ে সংবাদ প্রকাশিত হয়। প্রকাশিত সংবাদের বিষয়ে সরেজমিন তদন্তপূর্বক মতামতসহ প্রতিবেদন দাখিলের জন্য এই তদন্ত কমিটি গঠন করা হলো।
কমিটিতে আহ্বায়ক করা হয়েছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সমন্বয় ও সংস্কারের সচিবকে। সদস্য সচিব হিসেবে আছেন সিলেট বিভাগের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (রাজস্ব)। এ ছাড়া সদস্য হিসেবে আছেন জননিরাপত্তা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব পদমর্যাদার একজন প্রতিনিধি, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব পদমর্যাদার একজন প্রতিনিধি ও জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব পদমর্যাদার একজন প্রতিনিধি।