বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেছেন, তাদের দল আগামী নির্বাচনে ক্ষমতায় যেতে পারলে দেশের পররাষ্ট্রনীতি হবেÑ ‘সবার আগে বাংলাদেশ’। আর আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর থেকে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের যে দূরত্ব তৈরি হয়েছে, সেটিকে ‘দেশের মানুষের সিদ্ধান্ত’ হিসেবে দেখাতে চাইছেন তিনি। বিবিসি বাংলার সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে তারেক রহমানকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, শেখ হাসিনা এখন দিল্লিতে, এক বছর ধরে ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের শীতলতা চলছে। বিএনপি ক্ষমতায় গেলে সম্পর্কোন্নয়নে পদক্ষেপ নেবে কি না। জবাবে তারেক রহমান বলেন, ‘এখন তারা যদি স্বৈরাচারকে সেখানে আশ্রয় দিয়ে বাংলাদেশের মানুষের বিরাগভাজন হয়, সেখানে তো আমাদের কিছু করার নেই। এটা বাংলাদেশের মানুষ সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তাদের সঙ্গে শীতল থাকবে। সো, আমাকে আমার দেশের মানুষের সঙ্গে থাকতে হবে।’
বিবিসি বাংলা জানতে চেয়েছিল, বিএনপি যদি সরকার গঠন করে, তখন কূটনীতির ক্ষেত্রে মূলনীতি কী হবে? উত্তরে দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেন, ‘বিএনপির মূলনীতি একটাইÑ সবার আগে বাংলাদেশ। কূটনীতির ক্ষেত্রে বিএনপির নীতি সবার আগে বাংলাদেশ। আমার জনগণ, আমার দেশ, আমার সার্বভৌমত্ব। এটিকে অক্ষুণœœ রেখে, এটি স্বার্থ বিবেচনা করে, এই স্বার্থকে অটুট রেখে বাকি সবকিছু।’ আরেক প্রশ্নের জবাবে তারেক রহমান বলেন, কথিত এক/এগারো সরকার অসৎ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ছিল।
তারেক রহমানের সঙ্গে বিবিসি বাংলার দীর্ঘ সাক্ষাৎকারের দ্বিতীয় ও শেষ পর্ব গতকাল মঙ্গলবার সকালে প্রকাশ করেছে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যমটি। এতে বিএনপির ভবিষ্যৎ রাজনীতির ভাবনা, ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক, আন্তর্জাতিক নদীর পানির হিস্যা, এক-এগারো সরকারসহ সমসাময়িক বিষয়ে তার ভাবনা উঠে এসেছে। এর আগে সোমবার এ সাক্ষাৎকারের প্রথম পর্ব প্রকাশিত হয়। ২০০৮ সাল থেকে লন্ডনে নির্বাসিত তারেক রহমান দেড় যুগের মধ্যে এই প্রথম কোনো সংবাদমাধ্যমকে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন।
‘পানির হিস্যা চাই’
বিবিসি বাংলা জানতে চেয়েছিল, বিগত সরকারের সময় প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে যে ধরনের সম্পর্ক ছিল তা নিয়ে অনেক সমালোচনা রয়েছে। ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়ে বিএনপির নীতি কী হবে? জবাবে তারেক রহমান বলেন, ‘আমার মনে হয়, আপনি একটু আগে যে প্রশ্নগুলো করেছেন, সেখানে বোধহয় আমি ক্লিয়ার করেছি পুরো ব্যাপারটা। সবার আগে বাংলাদেশ। এখানে তো আপনি পার্টিকুলার (সুনির্দিষ্ট) একটি দেশের কথা বলেছেন। এখানে ওই দেশ বা অন্য দেশ তো বিষয় না। বিষয় তো হচ্ছে, ভাই বাংলাদেশ আমার কাছে আমার স্বার্থ, আমি আগে আমার দেশের মানুষের স্বার্থ দেখব, আমার দেশের স্বার্থ দেখব। ওটাকে আমি রেখে আপহোল্ড করে আমি যা যা করতে পারব, আমি তাই করব।’
বিবিসি বাংলা আবারও প্রশ্ন রাখে, বাংলাদেশের তিন পাশেই ভারতের সীমান্ত রয়েছে। তাদের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক কেমন হওয়া উচিত বা কেমন থাকা প্রয়োজনÑ এ নিয়ে আপনার চিন্তা কী? উত্তরে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেন, ‘অবশ্যই, আমি আমার পানির হিস্যা চাই। অবশ্যই আমি দেখতে চাই না, আরেক ফেলানী ঝুলে আছে। অবশ্যই আমরা এটা মেনে নেব না।’
তারেক রহমানের কাছে জানতে চাওয়া হয়, পানির হিস্যা এবং সীমান্ত হত্যার মতো বিষয় নিয়ে বিএনপি কি সোচ্চার থাকবে? উত্তরে তিনি বলেন, ‘না না, আমি উদাহরণ দিয়ে বললাম। দুটো উদাহরণ দিয়ে বোঝালাম আপনাকে, আমাদের স্ট্যান্ডটা কী হবে। আমরা আমাদের পানির হিস্যা চাই। অর্থাৎ আমার দেশের হিস্যা, মানুষের হিস্যা আমি চাই, হিসাব আমি চাই। আমার যেটা ন্যায্য, সেটা আমি চাই। অবশ্যই ফেলানী হত্যাকা-ের মাধ্যমে আমি বোঝাতে চেয়েছি, আমার মানুষের ওপরে আঘাত এলে অবশ্যই সেই আঘাতকে এভাবে আমি মেনে নেব না।’
‘একমত না হলে কি গণতন্ত্র নয়?’
বিবিসি বাংলা জানতে চেয়েছিল, সংস্কারের কিছু বিষয়ে বিএনপির সঙ্গে জামায়াতে ইসলামীসহ বিভিন্ন দলের কিছুটা মতপার্থক্য বা মতবিরোধ দেখা যাচ্ছে। উত্তরে তারেক রহমান বলেন, ‘সবার প্রতি সম্মান রেখেই বলছি, এই যে বাংলাদেশে রাষ্ট্র মেরামতের ক্ষেত্রে বিভিন্ন বিষয়ে সংস্কার প্রয়োজন। একজন ব্যক্তি দুবারের বেশি প্রধানমন্ত্রী থাকতে পারবেন না, থাকবেন না। এরকম আরও যে বিষয়গুলো আছে, এগুলো বাংলাদেশে যখন স্বৈরাচার ছিল, তাদের মুখের ওপরে, তাদের চোখের দিকে চোখ রেখে আমরা বিএনপিই বলেছিলাম। এখন হয়তো অনেকে সংস্কারের কথা বলছেন। সে দিন কিন্তু সংস্কারের ‘স’-ও তারা বলেননি। তার পরেও সবার প্রতি পরিপূর্ণ শ্রদ্ধা রেখে আমি বলতে চাই, বিএনপি ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দিলে সেটি সমস্যা, অর্থাৎ বিএনপিকে অ্যাগ্রি (সম্মত) করতে হবে সবার সঙ্গে, তাহলে ঠিক আছে। কিন্তু বিএনপি যদি কোনোটার সঙ্গে একমত না হয়, তাহলে বেঠিক। এটি তো গণতন্ত্র হলো না।’
এরপর বিবিসি বাংলার প্রশ্ন ছিল, বিএনপির ৩১ দফা সংস্কার প্রস্তাবে রাষ্ট্রপতি-প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্য আনার কথা বলা হয়েছে। তাহলে এসব বিষয়ে আপত্তি কেন? জবাবে তারেক রহমান বলেন, ‘আমরা যেটাতে বলেছিলাম, আমরা সেখানে এখনো আছি। যতটুকু ভারসাম্য হওয়া উচিত, যে বিষয়ে যতটুকু বিবেচনা করা উচিত, আমরা সে বিষয়ের মধ্যে এখনো কমবেশি আছি। আমাদের অবস্থান থেকে তো আমরা অবস্থান পরিবর্তন করিনি।’
তারেক রহমানকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, বিএনপি যদি ক্ষমতায় আসে বা সরকার গঠন করে, তখন ৩১ দফা নাকি জুলাই সনদÑ কোনটা অগ্রাধিকার পাবে? জবাবে বিএনপি নেতা বলেন, ‘আমরা যেগুলোয় একমত হয়েছি, প্রথমে আমরা সেগুলোর ওপরেই জোর দেব। সেটা আপনি যে নামেই বলেন না কেন, স্বাভাবিকভাবে আমরা ঐকমত্য কমিশনে যেগুলোয় সবাই মিলে একমত হয়েছি, আমরা প্রথমে সেগুলোয় ইনশা আল্লাহ সরকার গঠনের সুযোগ পেলে প্রথমে সেগুলোতেই অবশ্যই জোর দেব। আর, তারপরে আপনি যেটা ৩১ দফার কথা বললেন, অবশ্যই ৩১ দফা আমাদের রাজনৈতিক কমিটমেন্ট জনগণের প্রতি। আমরা তো আমাদের ৩১ দফার মধ্যে যেগুলোর এটার সঙ্গে মিলে গিয়েছে, সেগুলো তো আমরা করবই। এর বাইরে যেগুলো থাকবে ৩১ দফায় আছে, সেগুলো বাস্তবায়ন করব।’
এক/এগারো সরকার অসৎ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ছিল:
বিবিসি বাংলা জানতে চেয়েছিল, এক-এগারোর সরকার বা সেনাসমর্থিত সরকারের সময় নিয়ে রাজনীতিতে অনেক আলোচনা আছে। সেই সময় ঘিরে আপনার মূল্যায়ন কী? উত্তরে তারেক রহমান বলেন, ‘এক বাক্যে বা সংক্ষেপে যদি বলতে হয়, এক-এগারোর সরকার তো একটি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, অসৎ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত একটি সরকার ছিল।’ ‘আমরা দেখেছি, সেই সরকার আসলে কীভাবে দেশের যতটুকু যেমনই হোক বিভিন্ন ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যে দিয়ে যতটুকুই রাজনীতি গড়ে উঠেছিল, গণতান্ত্রিক ভিত্তি ধীরে ধীরে গড়ে উঠছিল ভুলত্রুটি সবকিছুর ভেতর দিয়েই। কিন্তু আমরা দেখেছি, কীভাবে তারা সবকিছু ভেঙে গুঁড়িয়ে দিতে চেয়েছিল, বিরাজনীতিকরণ করতে চেয়েছিল। দেশকে একটি অন্ধকার দিকে নিয়ে যেতে চেয়েছিল। পরবর্তী সময়ে দেখেছি, খুব সম্ভবত তাদেরই ভিন্ন আরেকটি রূপ; অন্যভাবে দেখেছি আমরা ‘ইন দি নেম অব ডেমোক্রেসি’।’
‘বিএনপিতে জবাবদিহি আনা হবে’
বিবিসি বাংলা জানতে চেয়েছিল, গত দুই দশকে বিএনপির রাজনীতির কতটা পরিবর্তন হয়েছে, ভবিষ্যৎ বিএনপি কেমন হবে? উত্তরে দলটির শীর্ষস্থানীয় নেতা তারেক বলেন, ‘আমাদের রাজনীতির মূল লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য হচ্ছে, জনগণ, দেশ ও দেশের সার্বভৌমত্ব। আমরা দুটো বিষয় নিয়ে বাংলাদেশে খুবই গর্ব করি, অহংকার করি, একটি হচ্ছে বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্প, আরেকটি হচ্ছে প্রবাসীরা দিন-রাত পরিশ্রম করে যে কষ্টার্জিত বৈদেশিক মুদ্রা পাঠানÑ এ দুটোই কিন্তু বিএনপি শুরু করেছিল।’
‘আমরা দেখেছি, বিএনপির সময় শুরু হয়েছিল প্রবাসীদের বিদেশ যাওয়া, একই সঙ্গে গার্মেন্ট শিল্পের প্রসার। এর বাইরেও যদি আমরা দেখি, ১৯৭৪ সালে যে দুর্ভিক্ষটা হয়েছিল, পরবর্তী সময়ে শহিদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান যখন দেশ পরিচালনার দায়িত্ব পেলেন, আমরা দেখেছি কীভাবে ধীরে ধীরে দুর্ভিক্ষপীড়িত একটি দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করে শুধু স্বয়ংসম্পূর্ণ না, অল্প পরিমাণ করে হলেও আমরা কিন্তু সেই সময় বিদেশে খাদ্য রপ্তানি, চাল রপ্তানি করেছিলাম।’
তারেক রহমানের কাছে প্রশ্ন ছিল, দেড় যুগ ধরে আপনি নির্বাসনে থেকে দলকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। নেতৃত্ব নিয়ে আপনার চিন্তাধারায় কী ধরনের পরিবর্তন এসেছে? উত্তরে তিনি বলেন, ‘গত ১৭ বছর প্রবাস জীবনে আছি এবং অনেক বছর আমি বাংলাদেশের সঙ্গে পাঁচ থেকে ছয় ঘণ্টা টাইম ডিফারেন্স, ডিস্টেন্স ডিফারেন্স তো আছেই। রিচিং ডিফারেন্স তো একটা ডিফিকাল্টিস তো আছেই। এটি একটি বেশ কষ্টসাধ্য ব্যাপার। এ ক্ষেত্রে প্রথমেই আমি আমার পরিবার অর্থাৎ আমার স্ত্রী এবং আমার সন্তানকে এখানে ধন্যবাদ দিতে চাই। কারণ তাদের সহযোগিতা না থাকলে হয়তো এই ডিফিকাল্ট কাজটি করা আমার জন্য আরও ডিফিকাল্ট হতো। ওনাদের সহযোগিতা ছিল, সে জন্য আমার পক্ষে সম্ভব হয়েছে।
‘অপপ্রচার তো সংবাদ নয়’
বিবিসি বাংলা জানতে চেয়েছিল, বিগত সরকারের আমলে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপ নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা ছিল। বিএনপি ক্ষমতায় এলে এমন পরিস্থিতি হবে না, তার নিশ্চয়তা কি দিতে পারেন? উত্তরে তারেক বলেন, ‘জ্বি, ইয়েস পারি। একদম দিতে পারি। আপনি ২০০১ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত পত্রপত্রিকা খুলুন। আমি কারো নাম উল্লেখ করা না, কোনো পত্রিকার কথা উল্লেখ করব না। শুধু খুলে দেখুন কীভাবে অনেক খবর ছাপা হয়েছিল। যার সত্যতা কিন্তু ছিল না, অপপ্রচার ছিল। কিন্তু অপপ্রচারটা সংবাদ হিসেবে চালিয়ে দেওয়া হয়েছিল।
‘আপনি কি শুনেছেন, আপনি কি আমাকে প্রমাণ দিতে পারবেন- বলতে পারবেন যে বিএনপির সময়, আমি কিন্তু বলতে পারব অনেক সাংবাদিকের নাম যারা নির্যাতনের শিকার হয়েছেন স্বৈরাচারের সময় এবং পরবর্তী সময়ে দেশ ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়েছেন। ইভেন, এখনো অনেকে প্রবাস জীবনে আছেন, এরকম বহু সাংবাদিক।
বিবিসি বাংলা এবার প্রশ্ন রাখে, তাহলে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা বা মতপ্রকাশের স্বাধীনতার সীমাবদ্ধ করেÑ এ ধরনের আইন কি বিএনপি বাতিল করবে? উত্তরে তারেক রহমান বলেন, ‘অবশ্যই, আমরা সবাই মিলে বসব, আলোচনা করব। আপনাদের মত, সাংবাদিকসহ যারা আছেন, তাদের সঙ্গে আলোচনা করব। আলোচনা করে সেগুলোকে আমরা এরকম কালো আইন যা যা আছে, আমরা আস্তে আস্তে ঠিক করব।’
তবে এখানে বোধহয় একটি বিষয় আবার আমাকে উল্লেখ করতে হয়, যেটি আমি সোশ্যাল মিডিয়ার ক্ষেত্রে বলেছি। দেখুন, এটি তো সবাইকে মিলে করতে হবে। অপপ্রচারকে তো অবশ্যই সংবাদ হিসেবে তো প্রচার করা ঠিক নয়, তাই না? ‘আমাদের কাছে আপনাদের যে রকম চাওয়া থাকবে, ভবিষ্যৎ সরকারের কাছে, যারাই আসুক সরকারে, রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে আমাদেরও অনুরোধ থাকবে আপনাদের প্রতি, যে অপপ্রচার সংবাদ হিসেবে যেন প্রচারিত না হয়, বিষয়টিকে একটু সবাইকে সচেতন বা খেয়াল রাখতে হবে।’
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন