ঢাকা বৃহস্পতিবার, ০৬ নভেম্বর, ২০২৫

রাজনৈতিক দলগুলোর অনৈক্যে সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা আ.লীগের

এফ এ শাহেদ
প্রকাশিত: নভেম্বর ৫, ২০২৫, ১১:৩৪ পিএম

ছাত্র-জনতার তীব্র আন্দোলনের মুখে ’২৪-এর ৫ আগস্ট পতন হয় আওয়ামী সরকারের। অবসান ঘটে দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে চলা অপশাসনের। ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে অংশ নেওয়া বিভিন্ন রাজনৈতিক দলÑ বিএনপি, জামায়াতসহ ছাত্র-জনতার ঐক্য নতুন স্বপ্নের জন্ম দেয় দেশের মানুষের মনে। তবে অভ্যুত্থানের পরপরই সংস্কার, নির্বাচন, জুলাই সনদ, পিআর পদ্ধতি, গণভোটসহ বিভিন্ন ইস্যুকে কেন্দ্র করে বিএনপি, জামায়াতসহ তরুণদের দল এনসিপির মধ্যে বিভেদ প্রকাশ্যে আসতে থাকে। যার ফলে একদিকে হতাশ হয়েছে জনগণ; অন্যদিকে রাজনৈতিক অনৈক্যের সুযোগকে কাজে লাগিয়ে আওয়ামী লীগসহ নিষিদ্ধঘোষিত ছাত্রলীগের ঝটিকা মিছিল দেশে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি ও নাশকতার ভয়ংকর পরিকল্পনায় যুক্ত হচ্ছে তারাÑ এমনটাই মনে করেন বিশ্লেষকরা। বহুল প্রতীক্ষিত আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচন সুষ্ঠু করার লক্ষ্যে অন্তর্বর্তী সরকার ঘোষণা দিলেও, ইতোমধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বয়কটের ডাক দিয়েছে পতিত ফ্যাসিস্ট সমর্থিত শক্তি।

জুলাই অভ্যুত্থানের মাধ্যমে দেশের মানুষ স্বপ্ন দেখে সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের মধ্যে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার। প্রায় দেড় হাজার ছাত্র-জনতার জীবন ও হাজার হাজার মুক্তিকামী মানুষের রক্তের বিনিময়ে ৩৬ দিনের আন্দোলনে দেশে সৃষ্টি হয় নতুন ইতিহাস। তবে গণঅভ্যুত্থানের এক বছরের মাথায় ফ্যাসিবাদবিরোধীদের মধ্যে অনৈক্য দৃশ্যমান। এই সুযোগ নিতে তৎপর নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগসহ ফ্যাসিবাদী শক্তিগুলো। কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীরা প্রায়ই তার অংশ হিসেবে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে নাশকতা এবং ঝটিকা মিছিল করছে। অনেক সময় মিছিল থেকে ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনাও ঘটছে। এসব কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে চলতি বছরেই ৩ হাজারের বেশি নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। আগামী ১৩ নভেম্বর ঘিরে আওয়ামী লীগের কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে নাশকতার পরিকল্পনা থাকতে পারে, যে পরিকল্পনার মূল উদ্দেশ্যই নির্বাচন প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করা বলে ধারণা করা হচ্ছে। যদিও প্রতিরোধে পুলিশ সর্বোচ্চ সচেষ্ট রয়েছে বলে জানা গেছে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, গণঅভ্যুত্থানে বিজয়ে দেশজুড়ে ছিল উল্লাসমুখর জনতার জোয়ার। রাস্তায় রাস্তায় আবেগাপ্লুত মানুষ করেছিল আনন্দ মিছিল। তবে গণঅভ্যুত্থানের এক বছরের মাথায় ফ্যাসিবাদবিরোধীদের মধ্যে অনৈক্যের সুরে সেই আনন্দ আজ অনেকটা ফিঁকে হয়েছে। দেশজুড়ে চাঁদাবাজি, ছিনতাই, নিরাপত্তাহীনতা, জুলাই-মিত্র রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে চরম অনৈক্য; সংস্কার, পিআর, জাতীয় নির্বাচন, গণভোট এমনকি  জুলাই ঘোষণাপত্র নিয়েও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে দ্বিমত প্রকট। তাদের এই দ্বিমত-অনৈক্যের সুযোগ নিয়ে দেশকে অস্থিতিশীল করতে মগ্ন ফ্যাসিস্ট শক্তি ও তাদের দোসর।

একইসাথে তারা মনে করেন, সর্বশেষ জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের পেশকৃত সুপারিশ দলিল রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিভক্তি ও বিভেদ উসকে দিয়েছে। ফলে ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশের সূত্র ধরে ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তার আবহ আরও গাঢ় হয়েছে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ কামরুল আহসান বলেন, জুলাইয়ের চেতনা পরাজিত হলে, জুলাই ঐক্য বিভাজিত হলে, পরাজিত শক্তি জয়ী হবে। পুরো দেশে দস্যুপনা শুরু হয়েছে, এগুলো বন্ধ করতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোকেও সংস্কারের নামে বিভাজন থেকে বিরত থাকতে হবে।

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, সংস্কার ও তার বাস্তবায়ন, বিচার বিভাগ সংস্কার, নির্বাচন, জুলাই সনদ, পিআর পদ্ধতি, গণভোট বিষয়ে মতানৈক্য যত বাড়বে পরাজিত শক্তি ফিরে আসার পথ তত বেশি সহজ হবে। একই সাথে লক্ষ্য করছি অভিযুক্ত দল হিসেবে আওয়ামী লীগের যে ভোটব্যাংক আছে তা কোনদিকে যাবে সেই কেন্দ্রিক নানা সমীকরণও চলছে বলে অভিযোগ আছে। তিনি বলেন, জুলাই অভ্যুত্থানের যে চেতনা তা থেকে সরে আসা যাবে না। পরাজিত শক্তির বা অপরাধীদের বিচার ছাড়া যদি তাদের রাজনীতিতে সুযোগ দেওয়া হয়, সেটি গণঅভ্যুত্থানের চেতনার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা হবে। আমরা চাই গণঅভ্যুত্থানে পক্ষের রাজনৈতিক দল যারা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছে তাদের ভেতর দ্বিমত থাকলেও দেশের স্বার্থে তাদের এক থাকতে। অথবা পরাজিত শক্তি মাথা চাড়া দেবে, যা ইতোমধ্যে আমরা দেখতে পাচ্ছি। নানা মিছিল, মিটিং থেকে বিশালসংখ্যক নেতাকর্মীর গ্রেপ্তার হওয়া থেকে তা স্পষ্ট। তিনি আরও বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে দ্বিমত থাকবেই, তবে জন-আকাক্সক্ষার প্রশ্নে তাদের এক থাকতে হবে। এটাই সবার প্রত্যাশা। কোনো দল অন্য দলের প্রতি প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে যদি পরাজিত শক্তিকে সুযোগ দেয় তবে সেটি হবে বড় ভুল।

অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল বলেন, বিচার ছাড়া পরাজিত শক্তি সুযোগ পেলে তারা আগের চেয়ে ভয়ংকর হয়ে উঠবে। তারা যদি কোনোভাবে বিচারের সম্মুখীন না হয়ে রাজনৈতিক জায়গা করতে পারে তাহলে তা হবে ভয়াবহ।

উল্লেখ্য, ২০২৪ সালের মাঝামাঝি সময়ে সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে শুরু হওয়া ছাত্রদের আন্দোলন শেষমেশ সরকার পতনে রূপ নেয়। ৩৬ দিনের সেই আন্দোলনে ক্ষমতা ছেড়ে ভারতে পালাতে বাধ্য হন সাড়ে ১৫ বছর দোর্দ-প্রতাপে দেশ চালিয়ে আসা শেখ হাসিনা। ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর ৮ আগস্ট অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব নেয় বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার। অভ্যুত্থানের পক্ষের শক্তিগুলোর দাবি মেনে শুরু হয় রাষ্ট্র সংস্কারের উদ্যোগ।

মত-দ্বিমতের মধ্যেই জুলাই ঘোষণাপত্র পাঠ; জুলাই গণঅভ্যুত্থান দিবসে অভ্যুত্থানের শরিক রাজনৈতিক দল ও পক্ষগুলোকে পাশে নিয়ে ঘোষণাপত্র প্রকাশ করেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। জুলাই সনদ নিয়ে অভ্যুত্থানপন্থিদের মধ্যে অনৈক্যের সুর; অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতায় আসার পর দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান সংস্কারের পাশাপাশি পুরো রাষ্ট্রকাঠামো সংস্কারের দাবি ওঠে। একই সাথে প্রশাসন চালাতে গিয়ে অনেক ক্ষেত্রেই সরকারের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব ও সিদ্ধান্তহীনতা স্পষ্ট হয়েছে। প্রশাসনিক সংস্কারের ক্ষেত্রে দলীয় প্রভাবমুক্ত করার চেষ্টা করা হলেও বাস্তবে একদলীয়করণ থেকে সরে এসে আরেক দলীয় প্রভাব প্রতিষ্ঠার প্রবণতা দেখা গেছে। এতে প্রশাসনে অস্থিরতা ও কার্যকারিতা হ্রাস পেয়েছে। গণঅভ্যুত্থানে অংশ নেওয়া বিভিন্ন পক্ষের নিজস্ব এজেন্ডা সামনে আসায় মতবিরোধ তৈরি হয়েছে। ফলে রাষ্ট্র সংস্কারের আকাক্সক্ষা বাস্তবায়নের পথ আরও জটিল হয়ে পড়েছে। মৌলিক সংস্কারের প্রশ্নে বড় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতভেদও স্পষ্ট।

এদিকে, সম্প্রতি সংস্কার ও নির্বাচন নিয়ে আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় বিদেশি এক গণমাধ্যমের সাক্ষাৎকারে বলেছেন, আওয়ামী লীগ ছাড়া প্রকৃত সংস্কার এবং নির্বাচন অসম্ভব। তবে আওয়ামী লীগ বর্তমান পরিস্থিতিতে প্রকাশ্যে আসতে না পারলেও চেষ্টা করছে নানাভাবে। একইসাথে অনলাইনে সক্রিয় থাকার চেষ্টা করছে তারা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দলের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে প্রতিনিয়ত বিভিন্ন বিষয়ে পোস্ট দেওয়া হচ্ছে। এর মধ্যে কর্মীদের জন্য নির্দেশনা, সমর্থক ও দেশের মানুষের প্রতি বিভিন্ন আহ্বান, নেতাকর্মীদের ওপর হামলার তথ্য চিত্র তুলে ধরা হচ্ছে। ওই পেজ থেকে করণীয় প্রসঙ্গেও নেতাকর্মীদের বিভিন্ন পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। ফেসবুকের পাশাপাশি ইউটিউব, চ্যানেল, এক্স (টুইটার) অ্যাকাউন্ট, টেলিগ্রাম চ্যানেলÑ এসব সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো ব্যবহার করা হচ্ছে দলীয় কাজে। তথ্য দেওয়া-নেওয়ার জন্য দলের একটি হোয়াটসঅ্যাপ অ্যাকাউন্ট চালু করা হয়েছে।