আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিনই অনুষ্ঠিত হবে গণভোট। একই ব্যালটে ভোট দেবেন নাগরিকেরা। এই দিনে নির্ধারিত হবে ভবিষ্যৎ রাষ্ট্রকাঠামোর রূপরেখা। এই গণভোটে একটি মাত্র প্রশ্নের মাধ্যমে জনগণ জানাবেন তাদের মতামত, যার মধ্য দিয়ে নির্ধারিত হবে চারটি ঐতিহাসিক প্রস্তাবের ভাগ্য। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো দুই কক্ষবিশিষ্ট সংসদ গঠনের প্রস্তাব, যেখানে দলগুলোর প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতে ১০০ সদস্যবিশিষ্ট একটি উচ্চকক্ষ গঠিত হবে।
গতকাল বৃহস্পতিবার বেলা আড়াইটায় জাতির উদ্দেশে দেওয়া এক গুরুত্বপূর্ণ ভাষণে এ ঘোষণা দেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ভাষণে তিনি শুধু গণভোট ও জাতীয় নির্বাচনের সময়সূচি নয়, বরং জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের অগ্রগতি, সংবিধান সংস্কারের প্রস্তাব, বিচার ও অর্থনৈতিক পুনর্গঠনের পদক্ষেপ, সবকিছুর বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেন। তার ভাষণের আগে অনুষ্ঠিত উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে ‘জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ, ২০২৫’ আনুষ্ঠানিকভাবে অনুমোদন করা হয়। পরে রাষ্ট্রপতির আদেশে তা গেজেট আকারে প্রকাশ করা হয়েছে।
প্রধান উপদেষ্টার ভাষণে বলা হয়েছে, আগামী ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় নির্বাচন ও গণভোট কেবল একটি রাজনৈতিক ঘটনা নয়। এটি বাংলাদেশের নতুন সংবিধান, নতুন সংসদকাঠামো ও নতুন গণতান্ত্রিক চেতনার সূচনালগ্ন। জনগণের ভোটে নির্ধারিত হবে বাংলাদেশ এককক্ষীয় সংসদব্যবস্থা থেকে দ্বিকক্ষীয় কাঠামোয় প্রবেশ করবে কি না, আর জুলাই সনদের ঐকমত্যমূলক সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়নের পথে যাত্রা শুরু হবে কি না।
অধ্যাপক ইউনূসের ভাষণে তাই স্পষ্ট, বাংলাদেশ আজ এক ঐতিহাসিক মোড়ে দাঁড়িয়ে। একদিকে আসন্ন নির্বাচন, অন্যদিকে গণভোটÑ উভয়ই নির্ধারণ করবে ‘নতুন বাংলাদেশের’ দিকনির্দেশনা, যার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকবে জনগণ, তাদের ভোট ও তাদের সচেতন অংশগ্রহণ।
ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণে বাংলাদেশ
প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদদ ইউনূস তার ভাষণে বলেন, গত বছরের আগস্ট মাসে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের শক্তিবলে আমরা অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করেছিলাম। এখন আমরা সরকারের মেয়াদের এক গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে পৌঁছেছি।
তিনি স্মরণ করিয়ে দেন, সরকারের ওপর অর্পিত তিনটি প্রধান দায়িত্ব, জুলাই হত্যাকা-ের বিচার, জবাবদিহিমূলক গণতান্ত্রিক কাঠামো প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজনীয় সংস্কার এবং অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর।
অধ্যাপক ড. ইউনূস বলেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সময়কার হত্যাকা-ের বিচার প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল তাদের প্রথম রায় ঘোষণার প্রস্তুতি নিচ্ছে। পাশাপাশি গুম, নির্যাতন ও ফ্যাসিবাদী শাসনের সময় সংঘটিত অপরাধের বিচারও শুরু হয়েছে, যা বাংলাদেশের ইতিহাসে এক নজিরবিহীন পদক্ষেপ।
সংস্কার ও সুশাসনের পথে
ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার নিজ উদ্যোগে কিংবা সংস্কার কমিশনের সুপারিশের আলোকে বিচার বিভাগীয় স্বাধীনতা, আর্থিক খাতের স্বচ্ছতা, প্রশাসনিক কাঠামোর ডিজিটাল রূপান্তর এবং দুর্নীতি দমনসংক্রান্ত বেশ কিছু মৌলিক সংস্কার সম্পন্ন করেছে। এসব পদক্ষেপ ভবিষ্যতের নির্বাচিত সরকারকে একটি শক্তিশালী ভিত্তি দেবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন, ‘আমরা চাই আগামী সরকার সংসদে আলোচনার মাধ্যমে এসব সংস্কার গ্রহণ ও প্রয়োগ করবে। এই পরিবর্তনই ভবিষ্যতের সুশাসনের মূলে থাকবে।’
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের ভূমিকা ও রাজনৈতিক ঐক্য
ভাষণে অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের নয় মাসব্যাপী কাজের প্রশংসা করে বলেন, এই কমিশন জুলাই গণঅভ্যুত্থানে অংশ নেওয়া রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ধারাবাহিক আলোচনার মাধ্যমে সংবিধান সংস্কারসংক্রান্ত ৩০টি প্রস্তাবে ঐকমত্যে পৌঁছেছে, এটি এক ঐতিহাসিক অর্জন। তিনি আরও বলেন, যদিও কিছু প্রস্তাবে ভিন্নমত রয়েছে, তবু তা মূলত প্রক্রিয়াগত পার্থক্য। কেউ সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করতে চান, কেউ আইনের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করতে চান। কিন্তু সংস্কারের উদ্দেশ্য ও নীতিতে কোনো বিভাজন নেই।
গণভোট ও নির্বাচনের যুগপৎ আয়োজন
সবচেয়ে আলোচিত সিদ্ধান্ত আসে ভাষণের মাঝখানে। জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণভোট একই দিনে অনুষ্ঠিত হবে। প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘আমরা সব দিক বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নিয়েছি, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিনই গণভোটের আয়োজন করা হবে। অর্থাৎ, ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে একই দিনে নির্বাচন ও গণভোট অনুষ্ঠিত হবে। এতে সংস্কারের লক্ষ্য কোনোভাবে বাধাগ্রস্ত হবে না; বরং এটি হবে আরও সাশ্রয়ী ও উৎসবমুখর। এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য শিগগিরই প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়ন করা হবে বলেও জানান তিনি।
চার বিষয়ে এক প্রশ্ন
গণভোটে চারটি বিষয় একত্রে একটি প্রশ্নে রাখা হবে। প্রধান উপদেষ্টা ভাষণে সেই প্রশ্ন পাঠ করে শোনান, আপনি কি জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ, ২০২৫ এবং জুলাই জাতীয় সনদে লিপিবদ্ধ সংবিধান সংস্কার সম্পর্কিত নি¤œলিখিত প্রস্তাবগুলোর প্রতি আপনার সম্মতি জ্ঞাপন করছেন?
প্রশ্নে অন্তর্ভুক্ত চারটি মূল প্রস্তাব হলোÑ (ক) নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার, নির্বাচন কমিশন ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানসমূহ জুলাই সনদে নির্ধারিত প্রক্রিয়ায় গঠিত হবে।
(খ) বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো সংসদ হবে দুই কক্ষবিশিষ্ট। জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলগুলোর প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতে ১০০ সদস্যের একটি উচ্চকক্ষ (সিনেটধর্মী কাঠামো) গঠিত হবে। সংবিধান সংশোধনের ক্ষেত্রে এই উচ্চকক্ষের সংখ্যাগরিষ্ঠ অনুমোদন প্রয়োজন হবে।
(গ) সংসদে নারীর প্রতিনিধিত্ব বৃদ্ধি, বিরোধী দল থেকে ডেপুটি স্পিকার ও সংসদীয় কমিটির সভাপতি নির্বাচন, প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদসীমা নির্ধারণ, রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা বৃদ্ধি, মৌলিক অধিকার সম্প্রসারণ, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও স্থানীয় সরকারব্যবস্থার বিকেন্দ্রীকরণসহ ৩০টি ঐকমত্য প্রস্তাবের বাস্তবায়নÑ যেগুলো জুলাই সনদে অনুমোদিত হয়েছেÑ আগামী নির্বাচনে বিজয়ী দলগুলোর জন্য বাধ্যতামূলক হবে।
(ঘ) জুলাই সনদে বর্ণিত অন্যান্য সংস্কারও রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিশ্রুতি অনুসারে বাস্তবায়িত হবে।
গণভোটে নাগরিকেরা এই চার বিষয়ের ওপর একটি প্রশ্নের উত্তরে ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ ভোট দেবেন।
‘হ্যাঁ’ ভোটের পরিণতি ও সংবিধান সংস্কার পরিষদ
প্রধান উপদেষ্টা ব্যাখ্যা করেন, গণভোটে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোট যদি ‘হ্যাঁ’ সূচক হয়, তবে নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের নিয়েই একটি সংবিধান সংস্কার পরিষদ গঠন করা হবে। এই পরিষদ সংসদের অংশ হিসেবেই কাজ করবে এবং প্রথম অধিবেশন শুরুর পর ১৮০ কার্যদিবসের মধ্যে সংবিধান সংস্কারের কাজ শেষ করতে হবে।
পরিষদের কাজ শেষ হওয়ার ৩০ কার্যদিবসের মধ্যে ভোটের সংখ্যানুপাতে উচ্চকক্ষ গঠন করা হবে, যা নি¤œকক্ষের (জাতীয় সংসদ) মেয়াদ শেষ না হওয়া পর্যন্ত বহাল থাকবে।
অধ্যাপক ইউনূস জানান, জুলাই সনদের অঙ্গীকার অনুসারে সংবিধানে ‘জুলাই জাতীয় সনদ’ অন্তর্ভুক্ত করার প্রক্রিয়া শুরু করা হবে, যাতে এটি দেশের শাসনতান্ত্রিক কাঠামোর স্থায়ী অংশ হয়ে ওঠে।
অর্থনীতি ও বিনিয়োগে পুনরুদ্ধারের বার্তা
ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা অর্থনৈতিক অগ্রগতির চিত্রও তুলে ধরেন। তিনি বলেন, অভ্যুত্থানের পর অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধার করা ছিল সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। আমরা সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেছি।
তিনি জানান, গত ১৫ মাসে রপ্তানি, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ও বিনিয়োগে ইতিবাচক প্রবণতা ফিরে এসেছে। ব্যাংকিং খাত ঘুরে দাঁড়িয়েছে, জনগণের আস্থা ফিরেছে।
বিশেষভাবে উল্লেখ করেন, বৈদেশিক প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ (এফডিআই) ১৯ দশমিক ১৩ শতাংশ বেড়েছে, যা বৈশ্বিক প্রবণতার বিপরীতে বাংলাদেশের অর্থনীতিকে স্থিতিশীলতার পথে এনেছে।
অধ্যাপক ইউনূস আরও ঘোষণা করেন, আগামী সপ্তাহে ডেনমার্কভিত্তিক মায়ার্স্ক গ্রুপের এপিএম টার্মিনালস বিভির সঙ্গে লালদিয়া কনটেইনার টার্মিনাল প্রকল্পে ৩০ বছরের কনসেশন চুক্তি স্বাক্ষরিত হবে। ইউরোপীয় এই কোম্পানি ৫৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করবে, যা বাংলাদেশের ইতিহাসে ইউরোপের সর্বোচ্চ একক বিনিয়োগ। লালদিয়া হবে দেশের প্রথম বিশ্বমানের ‘গ্রিন পোর্ট’।
সুষ্ঠু নির্বাচন ও ঐক্যের আহ্বান
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, প্রায় দেড় যুগ জনগণ ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত ছিলেন। এবার তারা অধীর আগ্রহে নির্বাচনের অপেক্ষায় আছেন। তিনি রাজনৈতিক দলগুলোকে সতর্ক করে বলেন, ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে ২০২৪-এর জুলাইয়ে আমরা যে ঐক্য গড়ে তুলেছিলাম, তা যেন ক্ষুদ্র স্বার্থ ও বিবাদে ভেঙে না যায়। ১৩৩ শিশু, শত শত তরুণ-তরুণী ও অসংখ্য মানুষের আত্মত্যাগ বৃথা যেতে দেওয়া যাবে না।
তিনি দলগুলোকে আহ্বান জানান নির্বাচনি প্রক্রিয়ায় ঐক্য বজায় রাখতে, যাতে দেশ আর কোনো অস্থিরতায় না জড়ায়।
নতুন বাংলাদেশে প্রবেশের দ্বারপ্রান্তে
ভাষণের শেষে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, ‘আমরা নতুন বাংলাদেশ গড়ার দ্বারপ্রান্তে এসে পৌঁছেছি। এই গণভোট ও নির্বাচন শুধু রাজনৈতিক রূপান্তর নয়, এটি জাতির আত্মবিশ্বাস পুনর্গঠনের যাত্রা।
তিনি বিশ্বাস করেন, ফেব্রুয়ারির আসন্ন নির্বাচন ও গণভোট একত্রে বাংলাদেশের ইতিহাসে নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতির সূচনা করবে। যেখানে জনগণই হবে রাষ্ট্রক্ষমতার মূল ভিত্তি, আর সংস্কার হবে তাদেরই অনুমোদনে।

সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন