শনিবার, ১০ মে, ২০২৫

ফেসবুক


ইউটিউব


টিকটক

Rupali Bangladesh

ইনস্টাগ্রাম

Rupali Bangladesh

এক্স

Rupali Bangladesh


লিংকডইন

Rupali Bangladesh

পিন্টারেস্ট

Rupali Bangladesh

গুগল নিউজ

Rupali Bangladesh


হোয়াটস অ্যাপ

Rupali Bangladesh

টেলিগ্রাম

Rupali Bangladesh

মেসেঞ্জার গ্রুপ

Rupali Bangladesh


জালালউদ্দিন সাগর, চট্টগ্রাম

প্রকাশিত: মে ৯, ২০২৫, ০৭:৩২ পিএম

এক টুকরো জমির জন্য  আঞ্জুমানের ৪৬ বছর!

জালালউদ্দিন সাগর, চট্টগ্রাম

প্রকাশিত: মে ৯, ২০২৫, ০৭:৩২ পিএম

এক টুকরো জমির জন্য  আঞ্জুমানের ৪৬ বছর!

ছবি- সংগৃহীত।

১৯৭৯ সাল থেকে চলতি বছর ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত ‘ধার’ করা ভূমিতে ১১ হাজার ৫০০ বেওয়ারিশ মরদেহ কবর দিয়েছে আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম, চট্টগ্রাম। ৪৬ বছর ধরে জেলা প্রশাসন ও মন্ত্রণালয়ের দ্বারে দ্বারে ঘুরেও বেওয়ারিশ মরদেহ কবর দিতে জায়গার বন্দোবস্ত নিতে পারেনি আন্তর্জাতিকভাবে সমাদৃত স্বেচ্ছাসেবী এই সংগঠন। সর্বশেষ ২০১৭ সালে চট্টগ্রাম নগরীর বায়েজিদ বোস্তামী এলাকায় সরকারি খাসজমিতে গড়ে ওঠা একটি কবরস্থানকে বন্দোবস্ত চেয়ে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের কাছে আবেদন করে আঞ্জুমান মুফিদুল। অনেক টেবিল ঘুরে ফাইলটি ভূমি মন্ত্রণালয়ে পৌঁছালেও তৎকালীন ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ বেঁকে বসার কারণে কবরস্থানের জন্য ভূমি বরাদ্দ পায়নি আঞ্জুমান। যদিও আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামকে ‘আশ্বাস’ দিয়েছিলেন আওয়ামী লীগের সাবেক এই মন্ত্রী। আশ্বাসের পরও আবেদিত জমি সরকারি নথিতে ‘টিলা’ শ্রেণিতে অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় কবরস্থানের জন্য বন্দোবস্ত দিতে অস্বীকৃতি জানায় ভূমি মন্ত্রণালয়। গত আট বছর ধরে মন্ত্রণালয়ের বারান্দায় বারান্দায় আঞ্জুমানের কর্মকর্তারা ‘জুতোর সুকতলা’ খসালেও মন গলেনি মন্ত্রী ও সচিবদের।

এটাই শেষ নয়, এর আগে ২০১৫ সালের দিকে নগরীর হালিশহর এলাকায় বেড়িবাঁধ সংলগ্ন একটি খাসজমি কবরস্থানের জন্য বন্দোবস্ত চেয়ে হতাশ হতে হয়েছিল আঞ্জুমানকে। সে সময়ও জেলা প্রশাসনসহ ভূমি মন্ত্রণালয়ে ঘোরাঘুরি করেও বেওয়ারিশ মানুষের জন্য নিজস্ব একটা কবরস্থানের ব্যবস্থা করতে পারেনি আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম। যদিও আঞ্জুমানের চাওয়া সেসব ভূমিসহ হাজার হাজার একর ভূমি বিভিন্ন প্রকল্পের জন্য বরাদ্দ দেয় সরকার। বরাদ্দ দেওয়া হয় ব্যক্তি মালিকানাধীন প্রকল্পের জন্যও।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আঞ্জুমানের এক কর্মকর্তা আক্ষেপ প্রকাশ করে বলেন, এই চট্টগ্রামে লাখ লাখ একর সরকারি ভূমি খাস পড়ে আছে। ব্যক্তিপর্যায়ে ব্যবসা কিংবা ব্যবহার করার জন্য হাজার হাজার একর জমি বরাদ্দ দেওয়া হলেও ৪৬ বছর ধরে ঘোরাঘুরি করেও বেওয়ারিশ একটি মরদেহের জন্য ‘সাড়ে তিন হাত মাটি’ পাচ্ছে না আঞ্জুমান।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ১৯৭৯ সালে চট্টগ্রামে আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে চৈতন্যগলির কবরস্থানের একটি নির্দিষ্ট অংশ ‘ধার’ নিয়ে সে জায়গায় বেওয়ারিশ লাশ দাফন করে আঞ্জুমান মুফিদুল। দিন দিন বেওয়ারিশ মরদেহের সংখ্যা বৃদ্ধি এবং চৈতন্যগলিতে পর্যাপ্ত জায়গা না পাওয়ায় ছয় মাস পরপর পুরোনো জায়গায় নতুন করে কবর খুঁড়তে বাধ্য হয় আঞ্জুমান। আগের কবরে নতুন করে সমাহিত করা হয় অন্য কাউকে। বদলে যায় কবর দেওয়া সিরিয়াল নম্বরও। অনেক সময় নতুন কবরের জন্য ছয় মাসও সময় পায় না আঞ্জুমান। তার আগেই কবরের ওপর কবর দিতে হয় তাদের। অল্প সময়ের ব্যবধানে কবরের ওপর কবর খুঁড়তে হয় বিধায় কবর খুঁড়তে অনাগ্রহ দেখায় গোরখোদকরা। এ ছাড়া মাঝে মাঝে মৃতদেহের পরিচয় শনাক্তের প্রয়োজন হলে বিপাকে পড়তে হয় আঞ্জুমানকে। দালিলিকভাবে (তথ্য-উপাত্ত) মরদেহের পরিচয় পাওয়া গেলেও দেহাবশেষ স্থানান্তর করতে পারেন না স্বজনরা। ছয় মাস কিংবা বছর পর কিংবা তারও পরে পরিবারের কেউ একজন জানলেন, নিখোঁজ হওয়া মানুষটিকে কবর দিয়েছে আঞ্জুমান। মৃত্যুর কারণ খুঁজতে চান তারা। কবরের ওপর নতুন কবর হওয়ার কারণে সে সুযোগ থেকে বঞ্চিত হন স্বজনরা। এই ক্ষেত্রে সব চাইতে বেশি সমস্যায় পড়তে হয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে। মামলার প্রয়োজনে নিখোঁজ কোনো ব্যক্তিকে শনাক্ত এবং মৃত্যুর কারণ খুঁজতে গিয়ে মৃতদেহ কবর থেকে তোলা কিংবা পোস্টমর্টেম করা সম্ভব হয় না পুলিশের।

জানতে চাইলে আঞ্জুমানে মুফিদুল ইসলামে কর্মরত কর্মকর্তারা বলেন, ছয় মাস পরপর নতুন কবর খোঁড়া হয়। নতুন কবর খুঁড়তে গিয়ে আগের মরদেহের হাড্ডি-কংকাল যা-ই পাওয়া যায় সবকিছু সরিয়ে নেওয়া হয়। যে কারণে ৬ মাস পর মরদেহের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া সম্ভব হয় না।

আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম সূত্রে জানা গেছে, বেওয়ারিশ লাশ দাফনের উদ্দেশ্যে আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম নামে স্বেচ্ছাসেবী এই সংগঠন গঠিত হলেও অদ্যাবধি নিজস্ব কবরস্থানের ব্যবস্থা করতে পারেনি আঞ্জুমান। চট্টগ্রাম শাখার প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই নগর ২২ মহল্লা কমিটির চৈতন্যগলি কবরস্থানে ঠিকানাবিহীন এসব মরদেহ দাফন করা হয়। নগরীর বায়েজিদ থানাধীন শিল্প এলাকার পাশের একটি খাসজমি সংগঠনকে কবরস্থান হিসেবে ব্যবহারের বন্দোবস্ত দিতে ২০১৬ সালে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের কাছে একটি আবেদন করে আঞ্জুমান। আবেদন গ্রহণের সম্ভাবতা যাচাই-বাছাই করে ১৮ এপ্রিল ভূমি মন্ত্রণালয়কে একটি অবগতপত্র পাঠান তৎকালীন জেলা প্রশাসক মো. সামসুল আরেফিন। স্মারক নং ০৫.৪২.১৫০০.৩০২.১২.১১৫১৬.৮৮৭।

ওই সুপারিনামায় তিনি উল্লেখ করেন, আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম বেওয়ারিশ লাশ দাফনের মতো মহৎকার্য সম্পাদন করে বিধায় জনস্বার্থে ও অসহায় বেওয়ারিশ লাশ দাফনের জন্য মানবিক দিক বিবেচনায় কবরস্থান স্থাপনের জন্য হাটহাজারী উপজেলার জালালাবাদ মৌজার বিএস ১নং খতিয়ানের ১১৭৪ দাগের ২.৯০২৫ একর ‘পাহাড়’ শ্রেণির অকৃষি খাসজমি ব্যবস্থাপনা ও বন্দোবস্ত নীতিমালা ১৯৯৫-এর ৩(খ) উপধারা মোতাবেক আঞ্জুমান মফিদুল ইসলাম, চট্টগ্রামকে ১ কোটি ৮৭ লাখ ১৭ হাজার ৯৯১ টাকা সেলামিতে বন্দোবস্ত প্রদানের জন্য অনুরোধ করা হলো।

তৎকালীন ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী আবেদনকৃত খাসজমি আঞ্জুমান মুফিদুলের নামে বরাদ্দ দেওয়ার আশ্বাস দিলেও একই বছর ১৩ নভেম্বর আবেদিত খাসজমি ‘পাহাড় শ্রেণি’র কারণ দেখিয়ে আঞ্জুমানকে বন্দোবস্ত দিতে অস্বীকৃতি জানায় মন্ত্রণালয়। যদিও ওই ভূমি স্থানীয় এলাকার মানুষ কবরস্থান হিসেবে ব্যবহার করে আসছে যুগের পর যুগ। আবেদিত সেই জায়গায় বর্তমানে কবরস্থান আছে উল্লেখ করে বিষয়টি পুনর্বিবেচনার জন্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হলেও হলে গত ৮ বছরে মন্ত্রণালয় থেকে কোনো জবাব পায়নি আঞ্জুমান।

আঞ্জুমানের তথ্যানুসারে প্রতিবছর গড়ে ২৫০ জন বেওয়ারিশ মরদেহের কবর দেয় চট্টগ্রামের আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম। সে হিসেবে গত ৪৬ বছরে বেওয়ারিশ মরদেহ সমাহিত করার সংখ্যা ১১ হাজার ৫০০। ২০১৫ সাল থেকে চলতি বছর এপ্রিল পর্যন্ত পরিসংখ্যান বলছে (১০ বছর ৪ মাস) ২ হাজার ৬৭৫ জন বেওয়ারিশকে কবর দেয় আঞ্জুমান। এর মধ্যে ২০১৫ সালে ২৬২ জন, ২০১৬ সালে ৩১৬, ২০১৭ সালে ৩০১, ২০১৮ সালে ২৭৭, ২০১৯ সালে ২৮৪, ২০২০ সালে ২০৬, ২০২১ সালে ২২৪, ২০২২ সালে ২২২, ২০২৩ সালে ২৭১, ২০২৪ সালে ২১২ এবং ২০২৫ সালে এপ্রিল মাস পর্যন্ত ৪ মাসে ১০০ জন বেওয়ারিশের লাশ দাফন করে স্বেচ্ছাসেবী এই সংগঠন। সব মরদেহ দাফন করা হয় চৈতন্যগলি কবরস্থানের ধার করা ভূমিতে।

জানতে চাইলে আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম, চট্টগ্রামের সাধারণ সম্পাদক নজমুল হক চৌধুরী বলেন, আঞ্জুমানের জন্য নিজস্ব একটা কবরস্থান খুব জরুরি। অনেক বছর ধরেই আমরা চেষ্টা করছি সরকারি একটা খাসজমি বন্দোবস্তের জন্য। কিন্তু কোনোভাবেই পাচ্ছি না। এর আগে ভূমিমন্ত্রীর সাথে আমরা দেখাও করেছিলাম। উনি আমাদের আশ্বস্ত করেছিলেন। পরবর্তীতে ঠুনকো কারণ দেখিয়ে সে জমির আবেদন মন্ত্রণালয় নাকচ করে দেয়।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি আরও বলেন, পুরো চট্টগ্রাম শহরটাই তো পাহাড় আর টিলায় ভরা। ব্যক্তিগত কিংবার করপোরেশনের কবরস্থানগুলোও পাহাড় আর টিলার ঢালুতে। আমরা যে জমিটির জন্য আবেদন করেছিলাম সে ভূমিতে অলরেডি কবরস্থান আছে। তাহলে কবরস্থানের জন্য জমি বন্দোবস্ত দিতে বাধা কোথায়?

এ বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম জেলার বর্তমান জেলা প্রশাসক ফরিদা খানম এই প্রতিবেদককে বলেন, আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিপ্রাপ্ত একটি মানবিক সংগঠন। বেওয়ারিশ মরদেহ দাফনের জন্য ভূমি বন্দোবস্তের বিষয়টি আমার জানা নেই। সম্ভবত অনেক আগে আবেদন করেছিলেন। এক প্রশ্নের জবাবে জেলা প্রশাসক আরও বলেন, উনারা যদি পুরাতন ফাইলগুলো নিয়ে আসেন কিংবা নতুন করে আবেদন করেন তাহলে বিষয়টি আমরা গুরুত্বের সাথে দেখব।
 

রূপালী বাংলাদেশ

Link copied!