ঢাকা বৃহস্পতিবার, ২৯ মে, ২০২৫

থোক বরাদ্দে বড় ধরনের কাটছাঁট

হাসান আরিফ
প্রকাশিত: মে ২৮, ২০২৫, ০৬:৪৯ এএম
ছবি- রূপালী বাংলাদেশ

মন্ত্রণালয়, বিভাগ বা অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোকে আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে কোনো ধরনের থোক বরাদ্দ প্রস্তাব করতে নিষেধ করা হলেও খোদ অর্থ বিভাগেই থোক বরাদ্দ রাখা হতে যাচ্ছে। অথচ বিগত বছরগুলোতে এই বরাদ্দ থেকে এক টাকাও ব্যয় হয়নি। অপরদিকে অনুমোদন পাওয়া বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতেও (এডিপি) থোক বরাদ্দ রাখা হয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয় ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সূত্রে এই তথ্য জানা গেছে।

অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বাজেটে ধারাবাহিকভাবেই থোক বরাদ্দ রাখা হয়ে আসছে। কিন্তু করোনা মহামারির পর থেকে অর্থনৈতিক সংকটের যে ধাক্কা শুরু হয়েছিল তারপর থেকে এই বরাদ্দ রাখা হলেও কৃচ্ছ্রসাধনের জন্য সে অর্থ ব্যয় করা হতো না। এরপর দেশে ডলার সংকট শুরু হওয়ার পর থেকে সরকার কৃচ্ছ্রসাধনের পথেই রয়েছে। এর ধারাবাহিকতায় মন্ত্রণালয়, বিভাগ বা অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোকে বাজেট বরাদ্দ চাওয়ার ক্ষেত্রে কোনো প্রকার থোক বরাদ্দ না চাওয়ার জন্য বলা হয়েছে।

জানা গেছে, সরকার চলতি অর্থবছরের তুলনায় দুই হাজার ২৫৫ কোটি টাকা কমিয়ে আগামী অর্থবছরের জন্য থোক বরাদ্দ রাখতে যাচ্ছে চার হাজার কোটি টাকা। চলতি অর্থবছর এই খাতে প্রস্তাবিত বরাদ্দ হচ্ছে ছয় হাজার ২৫৫ কোটি টাকা, যা সংশোধন করে করা হয়েছে চার হাজার ৫০০ কোটি টাকা।

এর আগের ২০২৩-২৪ অর্থবছরে থোক বরাদ্দ ছিল সাত হাজার ২২৪ কোটি টাকা, যা সংশোধন করে করা হয়েছিল চার হাজার ৫৯৪ কোটি টাকা। তবে এই বরাদ্দের এক টাকাও ব্যয় করা হয়নি এবং ২০২২-২৩ অর্থবছরে বরাদ্দ ছিল চার হাজার ৬৯৪ কোটি টাকা, যা সংশোধন করে করা হয় দুই হাজার ১১১ কোটি টাকা। এই অর্থবছরেও এই খাত থেকে কোনো অর্থ ব্যয় হয়নি। এজন্য বাজেটে থোক বরাদ্দে বড় ধরনের কাটছাঁট করেছে অন্তর্বর্তী সরকার।

অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, অর্থবিভাগ যে থোক বরাদ্দ রাখে তা অর্থ বিভাগের জন্য নয়, জরুরি বা বিশেষ প্রয়োজনে ব্যয় করার জন্য বাজেটে অর্থ বিভাগে থোক বরাদ্দ রাখা হয়ে থাকে। দেশের অভ্যন্তরে ঘটে যাওয়া প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা অন্য কোনো কারণে থোক বরাদ্দের অর্থ খরচ করা হয়। অথবা কোনো মন্ত্রণালয় বা বিভাগের তাৎক্ষণিক অর্থের জোগান দেওয়া হয়।

এদিকে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় এডিপি অনুমোদন দেওয়ার সময়ও থোক বরাদ্দ রাখা হয়েছে। যার পরিমাণ ২০ হাজার ৯১ কোটি টাকা, যার মধ্যে ১৪ হাজার ৪৮৫ কোটি টাকা রাখা হয়েছে দুটি পৃথক খাতে ‘উন্নয়ন সহায়তা’ ও ‘বিশেষ প্রয়োজনে উন্নয়ন সহায়তা’ হিসেবে। এই বরাদ্দের মধ্যে ‘বিশেষ প্রয়োজনে উন্নয়ন সহায়তা’ খাতে রয়েছে ১০ হাজার ৭৫৫ কোটি টাকা। আর ‘উন্নয়ন সহায়তা’য় বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৩ হাজার ৭৩০ কোটি টাকা, যার একটি বড় অংশ ব্যয় হবে স্থানীয় সরকার বিভাগের অধীনে।

এই খাতের মধ্যে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে ইউনিয়ন, উপজেলা, পৌরসভা ও সিটি করপোরেশনের অবকাঠামো ও সেবা উন্নয়ন। এ জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে যথাক্রমে ৮৭০, ৭৭০, ৫৬০, ৪৮০ ও ৪২০ কোটি টাকা। পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আওতায় মোট ৫৩০ কোটি টাকার থোক বরাদ্দের মধ্যে সরাসরি উন্নয়ন ৩৩০ কোটি, স্থানীয় সরকার উন্নয়নে ১০০ কোটি ও উন্নয়ন বোর্ডের জন্য ১০০ কোটি টাকা রাখা হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম ছাড়া বিশেষ এলাকার জন্য অতিরিক্ত ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রয়েছে।

২০২৪-২৫ অর্থবছরে দুই ধরনের থোক বরাদ্দের পরিমাণ ছিল ৯ হাজার ৯৫৮ কোটি টাকা, যার মধ্যে বিশেষ প্রয়োজনে উন্নয়ন সহায়তা ছিল ৬ হাজার ৩২৮ কোটি এবং উন্নয়ন সহায়তা ছিল ৩ হাজার ৭৩০ কোটি টাকা। স্থানীয় সরকারের জন্য তখনো ৩ হাজার ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ থাকলেও বিভিন্ন স্তরে এবার তা কিছুটা বৃদ্ধি পেয়েছে।

পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা বলছেন, অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের প্রেক্ষাপটে থোক বরাদ্দ এবার শুধু তহবিল নয়, বরং নীতিগত প্রস্তুতির অংশ হিসেবে বিবেচিত। আর সে জন্যই স্থানীয় সরকার এবং সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের মতো প্রধান অবকাঠামোগত খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে যথাক্রমে ৩৬ হাজার ৯৮ কোটি ও ৩২ হাজার ৩২৯ কোটি টাকা।

সিপিডির বিশেষ ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, বাজেট বাস্তবায়নে সুশাসনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় থোক বরাদ্দ একটি যৌক্তিক সিদ্ধান্ত। কারণ, প্রকল্প ব্যয়ের সময় অনেক অনিশ্চয়তা দেখা যায়; যেটি নিরসনে এই ধারা সহায়ক হতে পারে।

সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার অভাবে ব্যয় করা যায় না বাজেটে দেওয়া থোক বরাদ্দ। এ কারণে অনেক সময় থোক বরাদ্দের অর্থ অপচয়ও হয়। চলে চুরি, লুটপাট। তারপরও প্রতিবছর বাড়ানো হয় থোক বরাদ্দ। চাহিদাও থাকে। বরাদ্দও দিতে হয়। যা বাজেটের মূল কাঠামোতে অনেকাংশেই উল্লেখ থাকে না।

সবচেয়ে বেশি থোক বরাদ্দ দেওয়া হয় স্থানীয় সরকার বিভাগের অধীন বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে। এ ছাড়া পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে এগিয়ে নিতেও নানামুখী কর্মকাণ্ড বাস্তবায়নে থোক বরাদ্দ দেওয়া হয়। সরকারের বিশেষ কোনো উদ্যোগ বাস্তবায়নে অর্থের জোগান দিতেও রাখা হয় থোক বরাদ্দের। একই সঙ্গে সরকার সমর্থকদের নানামুখী আবদার মেটাতে দেওয়া হয় এই বরাদ্দ। অর্থ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট বিভাগ সূত্রে এমন তথ্য জানা গেছে।

অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, সাধারণত প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর ও অর্থ মন্ত্রণালয় যৌথভাবে এই থোক বরাদ্দের অনুমোদন দেয়। বেশির ভাগ বরাদ্দ দেওয়া হয় জাতীয় সংসদ সদস্যদের নামে। এলাকার উন্নয়নে সাধারণ বরাদ্দের বাইরে এই বাড়তি বিশেষ বরাদ্দ দেওয়া হয়। কখনো কখনো সরকারদলীয় এমপিদের নামে বিশেষ কাজের জন্য বিশেষ এই বরাদ্দ দেওয়া হয়।

অভিযোগ রয়েছে, প্রায়ই এই বরাদ্দ কোনো কাজে আসে না। থোক বরাদ্দের অর্থ ঠিকমতো ব্যবহার করা হয় না। পুরোটা ব্যয় করতে পারেন না এমপিরা। সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা না থাকা এবং এ অর্থ ব্যয়ের ক্ষেত্রে যথাযথ জবাবদিহিতা না থাকায় থোক বরাদ্দের বড় অংশ অপচয় হয়।

তবে সমাজের নানাভাবে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে এগিয়ে নিতে সরকারের থোক বরাদ্দ অনেক বড় ভূমিকা রাখে। বড় অবদান রাখে নারী উদ্যোক্তাদের এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রেও। তাই অর্থনীতিবিদদের মতে, এ ধরনের কর্মকাণ্ড সচল রাখতে সরকারের থোক বরাদ্দ থাকা উচিত। এ ক্ষেত্রে থোক বরাদ্দের অর্থ ব্যয়ের সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনাও প্রয়োজন। প্রয়োজন সুষ্ঠু জবাবদিহিতার।

পরিপত্রে মধ্যমেয়াদি বাজেট কাঠামো পদ্ধতির আওতাভুক্ত সব মন্ত্রণালয় বা বিভাগকে বাজেট প্রণয়নের দ্বিতীয় পর্যায়ে আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বিস্তারিত বাজেট প্রাক্কলন এবং একই সঙ্গে পরবর্তী ২০২৬-২৭ ও ২০২৭-২৮ অর্থবছরের প্রক্ষেপণ প্রণয়নের নির্দেশ দিয়েছে অর্থ বিভাগ।

পরিপত্রে বাজেট প্রাক্কলন ও প্রক্ষেপণের ক্ষেত্রে মন্ত্রণালয়/বিভাগগুলোকে চারটি নীতি অনুসরণ করতে বলা হয়েছে। এগুলো হচ্ছে প্রথমত, মন্ত্রণালয়/বিভাগ ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠান যাতে মধ্যমেয়াদি বাজেট কাঠামোতে বর্ণিত কৌশলগত উদ্দেশ্য, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা, ‘রি-স্ট্রাটেজিসিং দ্য ইকোনমি অ্যান্ড মবিলাইজিং রিসোর্সেস ফর ইক্যুয়িটেবল অ্যান্ড সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট’বিষয়ক টাস্কফোর্স রিপোর্ট এবং মন্ত্রণালয়/বিভাগের নিজস্ব নীতিমালায় অন্তর্ভুক্ত সরকারের নীতি ও অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে কার্যক্রম পরিচালনা এবং মধ্যমেয়াদি দ্বিতীয়ত, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়/বিভাগ ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলো যাতে সরকারের মৌলিক নীতি নির্ধারণী দলিলগুলোর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে দারিদ্র্য নিরসন, নারী ও শিশু উন্নয়ন, জলবায়ু অভিঘাত মোকাবিলায় সহায়ক কার্যক্রমে বরাদ্দ বাড়াতে সক্ষম হয় এবং দরিদ্র জনগোষ্ঠী এবং নারী ও শিশু উন্নয়নে প্রদেয় সেবার মান ও পরিমাণ বাড়ে।