সীমান্ত দিয়ে ভারতীয় পণ্যের আমদানি এখন সীমিত। কিন্তু চোরাচালানের মাধ্যমে আসা ভারতীয় অবৈধ পণ্যের কমতি নেই বাজারে। সিলেটে কাপড়ের দোকান এখন ভারতীয় শাড়ি ও থ্রিপিসে সয়লাব।
বিস্কুট, কসমেটিকস পণ্য এবং শিশুখাদ্য থেকে সবই মিলছে। প্রয়োজনীয় ভারতীয় পণ্য এখন চাইলে সুপারশপ থেকে শুরু করে ফুটপাতের হকারের কাছেও পাওয়া যাচ্ছে।
ব্যবসায়ীরা জানান, বৈধ পথে আমদানি কমলেও অবৈধ পথে অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় এখন ভারতীয় পণ্য আসছে বেশি। সীমান্ত পাড়ি দিয়ে এসব পণ্য দেশে ব্যবসায়ীদের হাতে এসে পৌঁছাতে খুব একটা বেগও পেতে হচ্ছে না। এখান থেকেই পণ্যগুলো ছড়িয়ে পড়ছে সিলেটসহ আশপাশের বাজারগুলোতে।
সিলেট শহরে পাইকারি ও খুচরা মার্কেটে অবাধে; বাধাহীনভাবে বিক্রি হচ্ছে এসব পণ্য। দুর্বল বাজার মনিটরিংয়ের কারণে এই সুযোগ নিচ্ছে অসাধু ব্যবসায়ীরা। তবে সিলেটের জেলা প্রশাসক ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ শের মাহবুব মুরাদ অবশ্য ‘দুর্বল বাজার মনিটরিং’ মানতে নারাজ।
তিনি বলেন, প্রতিদিনই বাজার মনিটরিং হচ্ছে। তার কাছে শহরে ভারতীয় পণ্য বিক্রি হয় এমন বাজার ও মার্কেটের নাম উল্লেখ করে এগুলো মনিটরিং হয় কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা দেখব, কোথাও অবৈধভাবে আসা ভারতীয় পণ্য বিক্রি হচ্ছে কি না।’
একাধিক সূত্র জানিয়েছে, সীমান্ত দিয়ে পণ্য চোরাচালান ঠেকাতে যেখানে সবচেয়ে বেশি তৎপরতা দেখানোর কথা, সেখানেই বরং সবচেয়ে বেশি সুবিধা পাচ্ছে চোরাকারবারিরা। অর্থের বিনিময়ে সীমান্তের দুই পারেই চোরাকারবারিরা ‘লাইন ক্লিয়ার’ পেয়ে সহজে পণ্য নিয়ে আসতে পারছে দেশের ভেতরে।
গোয়াইনঘাট, জৈন্তাপুর ও কানাইঘাট সীমান্ত দিয়ে আসে সবচেয়ে বেশি পণ্য। সীমান্ত পেরিয়ে এগুলো সরাসরি এসে পৌঁছায় সিলেট শহরে, পরে নিরাপত্তার স্বার্থে হালদারপার, গোয়াইনঘাট, জৈন্তাপুর, দরবস্ত, হরিপুর, খাদিমনগর, শাহপরাণ এলাকায় এনে গুদামজাত করা হয়। সেখান থেকেই চাহিদা মত পণ্য সরবরাহ করা হয় ব্যবসায়ী ও ক্রেতার কাছে।
সিলেটে চোরাচালানের নিরাপদ রুট হল জৈন্তাপুর। এই রুটে আসা পণ্যের মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের মদ, ভারতীয় সুপারি, সাতকরা, চিনি, শাড়ি, লেহেঙ্গা, ভারতীয় বিভিন্ন ব্যান্ডের ঔষধ ও প্রসাধনী সামগ্রি, নারিকেল, চকলেট, ফুচকা, মটর সাইকেল পার্টস। চোরাচালানের মালামাল পরিবহনে ব্যবহৃত হয় ট্রলি এবং নৌকা।
স্থানীয় ব্যবসায়ীরা জানান, গত ৫ আগস্টের আগে এতটা সহজ ছিল না সীমান্ত চোরাচালান। চোরাচালান হতো নিয়মিত, কিন্তু এর জন্য অনেক কাঠখড় পোড়াতে হতো। ৫ আগস্টের পর এখন সীমান্ত অনেকটাই সহজ। চোরাচালান বেড়ে যাওয়ায় ভারতের মেঘালয় রাজ্য বাংলাদেশ সীমান্তে সান্ধ্যকালীন কারফিউ দিতে বাধ্য হয়েছে। তবুও ঠেকানো যাচ্ছে না।
কেননা, তারা ভারত অংশে কারফিউ দিলেও বাংলাদেশের প্রশাসন থেকে সীমান্তকে কঠিন নজরদারিতে আনা হচ্ছে না। মাঝেমধ্যে অভিযান পরিচালনা করলেও বাস্তব চোরাচালানের তুলনায় এসব কিছুই না। প্রতিদিন অসংখ্য চালান সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে ঢুকছে, তবে আটক হচ্ছে কদাচিৎ।
স্থানীয়দের অভিযোগ, চোরাকারবারিদের সুযোগ দেয়া হচ্ছে সীমান্ত ও আইনশৃক্সক্ষলা বাহিনী এবং প্রশাসনের ভেতর থেকেই।
সূত্রের দাবি, প্রশাসনের অসাধু দায়িত্বশীলদের ভেতরে বলাবলি হচ্ছে, ‘এখন রাজনৈতিক সরকার নেই, তাই দেখার কেউ নেই। এই সুযোগে আখের গুছিয়ে নাও।’
প্রশাসনকে হাত করে স্থানীয় রাজনৈতিক পরিচয়ধারীদের দৌরাত্ম্য এখন সীমান্তে। পেশাদার চোরাকারবারির সাথে তারা যোগ দিয়ে সিলেট সীমান্তকে ভারতীয় পণ্য চোরাকারবারির শীর্ষ রুটে পরিণত করেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অবৈধপথে ভারত থেকে আসা পণ্যের প্রথম ঠিকানা হয় সিলেট শহরের কালিঘাট ও বন্দর বাজারে। এখানকার পাইকারি ব্যবসায়ীরা চোরাইপণ্যের প্রধান ক্রেতা। তবে নির্দিষ্ট চোরাকারবারির মাধ্যমে সুপারশপ এবং বড় বড় দোকানগুলোও পণ্য আনে।
চোরাইপথে আসা ভারতীয় পোশাকপণ্যের ক্রেতা অভিজাত মলগুলোর ব্যবসায়িরা। অতীতে বৈধপথে পোশাক আমদানি করলেও এখন দামে কম পাওয়ায় এবং সহজলভ্য হওয়ায় ব্যবসায়িদের অনেকেই সরাসরি চোরাকারবারিদের কাছ থেকে পণ্য সংগ্রহ করছে।
এই সুযোগে সীমান্ত এলাকায় পেশাদার চোরাকারবারির পাশপাশি অসংখ্য অপেশাদার সৌখিন লোক অবৈধ পেশায় যোগ দিয়েছে। প্রতিদিন তারা ছোটছোট ব্যাগে করে পণ্য সিলেট শহরে সরবাহ করে আবার বাড়ি ফিরে যায়।
এ পেশায় তারা নিয়মিত না হলেও চাহিদা অনুযায়ী ক্রেতার কাছে পণ্য সরবরাহ করে। অবৈধ চোরাইপণ্যের ব্যবসা করে গোয়াইনঘাট, জৈন্তাপুর ও কানাইঘাট এলাকার অনেকেই অল্প দিনে আঙুল ফুলে কলাগাছে পরিণত হয়েছে। সীমান্তে তাদের ‘লাইন বাহিনী’ হিসেবে সবাই চেনেন।
স্থানীয়রা জানান, অনেক স্কুল ও কলেজ পড়ুয়া পড়াশোনা বাদ দিয়ে এ পেশায় যোগ দিয়েছে। তারা বড় চোরাকারবারির এজেন্ট হিসেবে কাজ করে। কেউ কেউ কমিশনের বিনিময়ে পণ্য পৌঁছে দেয় সিলেট শহরের ক্রেতার কাছে।
গোয়াইনঘাটের একজন সংবাদকর্মী বলেন, স্থানীদের অনেকেই এখন চোরাচালানকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন। অধিক লাভজনক হওয়ায় পড়াশোনা ও চাকরির আশা না করে তারা জড়িয়ে পড়ছেন চোরাচালানে। এমনকি সিলেটের বাইরে থেকে এসে এখানে চোরাকারবারিতে নাম লেখাচ্ছেন অনেকে। তারা শূন্য থেকে হচ্ছেন গাড়ি-বাড়ির মালিক।
আপনার মতামত লিখুন :