চালের বাজার আবার উত্তপ্ত। সরকার আমদানি শুল্ক কমিয়ে ব্যবসায়ীদের সুবিধা দিলেও কাজে আসছে না। নতুন সিন্ডিকেটের কারণে ঢাকায় প্রতি বস্তায় সব ধরনের চালের দাম বেড়েছে অন্তত ৫০০ টাকা। তবে দাম বৃদ্ধির পেছনে ‘দেশের করপোরেট সিন্ডিকেটকেই’ দুষছেন ব্যবসায়ীরা। যার কারণে বিপাকে পড়েছেন মধ্যবিত্ত থেকে শুরু করে নিম্ন আয়ের খেটে খাওয়া মানুষ।
চাল ব্যবসায়ী অনেকে জানিয়েছেন, গরিবের আহার মোটা চালের দাম ঢাকায় স্থানভেদে গত ১৫ দিনে খুচরায় কেজিতে দাম বেড়েছে ৪-৬ টাকা। পাশাপাশি অন্য সব ধরনের চালের দাম কেজিতে বেড়েছে ৫-৬ টাকা। শুল্কমুক্ত আমদানি হলেও অন্তর্বর্তী সরকারের ৬ মাসে ৫০ কেজির প্রতি বস্তা চালের দাম বেড়েছে অন্তত ৪০০ টাকা এবং এক বছরে ৫শর কম নয়। যার দাম গত বছরে ছিল মাত্র ২৯০০ থেকে ৩১০০ টাকা।
বাজার পরিসংখ্যান বলছে, চলতি বছরের শুরুতে অর্থাৎ জানুয়ারি মাসে আমনের মৌসুমেই চালের দাম বাড়তে থাকে। ৫০ কেজির চিকন চালের এক বস্তা সে সময়ে ৩ হাজার থেকে সর্বোচ্চ ৩৪০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। তার আগে আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাসে ২৯০০ থেকে ৩১০০ টাকা বিক্রি হয়। বতর্মানে প্রকারভেদে সেই চাল ৩৯০০ থেকে ৪ হাজারে বিক্রি হচ্ছে। তবে সরকার চালের দাম নিয়ন্ত্রণে আমদানির কথা ভাবছে সরকার।
দাম বৃদ্ধির কারণ হিসেবে ব্যবসায়ীরা বলেন, কৃষকের কাছ থেকে বেশি দামে ধান কিনেছেন মৌসুমি ব্যবসায়ী ও করপোরেট কোম্পানির প্রতিনিধিরা। চাল উৎপাদনকারী মিলার ও সাধারণ ব্যবসায়ীদের হাতে ধান-চাল নেই বললেই চলে। ফলে চালের ব্যবসায় ঢুকে পড়েছেন করপোরেট ব্যবসায়ীরা।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের ২০ অক্টোবর আমদানি শুল্ক ২৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১৫ শতাংশ, রেগুলেটরি শুল্ক ২৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ করা হয়। তারপর আগাম কর ৫ শতাংশ সম্পূর্ণ প্রত্যাহার করে এনবিআর। এতেও চালের দাম না কমায় গত ৩১ অক্টোবর আরেক দফা চাল আমদানিতে শুল্ক পুরোপুরি তুলে নেয় সরকার। শুল্কমুক্ত আমদানি করলেও ফের চালের বাজার উত্তপ্ত হতে শুরু করেছে।
চলতি বছর জানুয়ারি মাসে আমনের ভরা মৌসুমে চালের দাম দফায় দফায় বেড়েছে। জানুয়ারির দুই সপ্তাহে বস্তাপ্রতি চালের দাম বাড়ে ২০০-২৫০ টাকা পর্যন্ত। তবে দাম বৃদ্ধির পেছনে ছিল চড়া দামে কৃষকের কাছ থেকে ধান কেনা। চলতি বছর রংপুর জেলার পীরগঞ্জ উপজেলার শানেরহাটে প্রতি মণ ধান বিক্রি হয়েছে ১৩৫০ টাকায়। হাটে আসা কৃষক আনিছার রহমান বলেন, ‘স্বাধীনতার পর ধানের সর্বোচ্চ দাম পেয়েছি।’ পরে দাম আরও বাড়লে কৃষকের হাতে আর বেশি ধান নেই। একই উপজেলার ধান ব্যবসায়ী লালমিয়া রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘হাটেই এক মণ ধানের দাম ১৩৫০ টাকা। চাল হয় ২৮ কেজি। কিনেই প্রতি কেজি চালের দাম পড়ে ৪৮ টাকার বেশি। তার সঙ্গে অন্য খরচ যোগ করে টিকে থাকা অসম্ভব।’
জানতে চাইলে ঢাকার কারওয়ান বাজারের চাটখিল এজেন্সির মালিক বেলাল হোসেন করপোরেট কোম্পানিগুলোর প্রতি আঙুল তোলেন। তিনি রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘আমরা কম দামে কিনে সামান্য লাভে বিক্রি করি। এবার ভরা মৌসুমে চালের বস্তা সর্বোচ্চ ৩৪০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। সে সময়ে প্রতি বস্তায় বেড়েছে ৩৫০-৪০০ টাকা। নতুন করে প্রতিদিন বাজার বাড়া-কমার ভেতরে রয়েছে।’
ঢাকার কারওয়ান বাজার, মগবাজার ও মালিবাগ ঘুরে জানা গেছে, সাগর, মোজাম্মেল, মঞ্জু ও ডায়মন্ডের ৫০ কেজির চিকন চালের বস্তা এখন সর্বনি¤œ ৩৯০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। প্রতি বস্তায় অন্তত ২০০ টাকা বেড়েছে, যা কেজিতে প্রায় ৪ টাকা। ঈদের আগে ৫০ কেজি চালের দাম ছিল ৩৬০০-৩৭০০ টাকা। অন্যদিকে বিআর-২৮ প্রতি কেজি ৫৮ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
চালের দাম সম্পর্কে জানতে চাইলে কারওয়ান বাজারের কিচেন মার্কেটের আরেক ব্যবসায়ী বলেন, ‘চালের সরবরাহ ঠিক আছে, তবুও ঈদের পর থেকে দাম বাড়তে শুরু করেছে। এখন কেজিতে বেড়েছে প্রায় ২ টাকা, এটা খুচরা পর্যায়ে আরও বাড়ছে। সব ধরনের চালের দাম বেড়েছে।’ একই মার্কেটের মেসার্স নূর রাইস এজেন্সির চাল ব্যবসায়ী বলেন, ‘মোটা চাল এখন কম পাওয়া যায়। তবুও প্রতি কেজি ৫৮ টাকা। ৫০ কেজির বস্তা, চিকনÑ সব ধরনের চালের দামই এখন প্রায় ৩৯০০ টাকা। বস্তায় দাম বেড়েছে অন্তত ২০০ টাকা’, বলেন তিনি।
রাজশাহী জেলার চালকলগুলোতে বেশি উৎপাদিত হয় কাটারি, জিরাশাইল, নাজিরশাইল ও মিনিকেট চাল। মিলারের উৎপাদিত মোটা ও চিকন চালের দাম কেজিতে বেড়েছে ৬ থেকে ১০ টাকা। এক সপ্তাহে প্রতি বস্তায় দাম বেড়েছে ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা। তবে দাম বৃদ্ধির পেছনে মৌসুমি ব্যবসায়ীদের দুষছেন মিলাররা।
রাজশাহীর সাহেববাজারের চাল ব্যবসায়ী সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘মানভেদে ৫০ কেজি চালের প্রতি বস্তায় ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। এখানে আমাদের কোনো হাত নেই। কারণ আমরা পাইকারি দরে কিনে সামান্য লাভ করে বিক্রি করে দিই। রাজশাহী চালকল মালিক সমিতির সভাপতি রফিকুল ইসলামও ধানের দামকে দায়ী করছেন। তিনি বলেন, ‘চালের দাম বাড়লেই আমাদের দোষ হয়। কিন্তু এখন ধানের দাম বাড়তি থাকায় চাল করতে বেশি খরচ পড়ছে।’
চাল উৎপাদনে শীর্ষে দিনাজপুরের বিরলের রূপালী ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, ‘এখানেও ধানের দাম বেশি। যার কারণে উৎপাদন খরচও বেড়েছে।’ একই কথা বলেন চালকল মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ অটো মেজর অ্যান্ড হাসকিং মিল মালিক সমিতির কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক এইচ আর খান পাঠান।
তবে ভিন্ন কথা বলেন বাংলাদেশ অ্যাগ্রিকালচার রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (বারি) সাবেক মহাপরিচালক কৃষিবিজ্ঞানী ড. রফিকুল ইসলাম ম-ল। তিনি রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘দেশের মোট ধান উৎপাদনের পরিসংখ্যানে ফারাক রয়েছে। এটি আগে সরকারকে নিশ্চিত করা দরকার। একই সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আমাদের দেশের কৃষি উৎপাদনে ব্যাপক প্রভাব পড়েছে। এখন বর্ষাকালে আর বর্ষা হয় না। বর্ষায় অনাবৃষ্টি হচ্ছে। ধানের জমিতে সেচ দিতে চাইলেও পারছেন না কৃষক।’
সরকারের প্রতি সুপারিশ হিসেবে বীর মুক্তিযোদ্ধা ড. রফিকুল ইসলাম ম-ল বলেন, ‘উৎপাদন বাড়াতে সারা বছর সেচ দরকার। তাই কৃষি খাতে সরকারকে ছাড় দিতে হবে। জলবায়ু পবির্তনের প্রভাব মোকাবিলায় তাহলে কৃষক সারা বছর উৎপাদনে থাকবে। এতে করে কৃষি অর্থনীতির আওতা বাড়বে এবং মূল্যস্ফীতি কমবে’ বলেন এই কৃষিবিজ্ঞানী।
এদিকে, সরকার চালের দাম নিয়ন্ত্রণে আমদানির কথা ভাবছে সরকার। এ বিষয়ে গত ৫ জুলাই যশোর সার্কিট হাউজে খাদ্য উপদেষ্টা আলী ইমাম মজুমদার বলেছেন, দেশে পর্যাপ্ত খাদ্য মজুত রয়েছে। খুব শিগগিরই চালের দাম সহনীয় পর্যায়ে আসবে। তিনি বলেন, চলতি মৌসুমে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলোতে অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় বেশি পরিমাণ খাদ্যশস্য মজুত রয়েছে। দেশে খাদ্য মজুত বর্তমানে অত্যন্ত সন্তোষজনক পর্যায়ে রয়েছে।