বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের জুলাই গণঅভ্যুত্থান চলাকালে ২০২৪ সালের ২৮ জুলাই রোববার সারা দেশে গ্রাফিতি ও দেয়াল লিখন এবং অনলাইন-অফলাইনে গণসংযোগ কর্মসূচি পালন করে। এদিন রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে দেয়াল লিখন ও গ্রাফিতিতে ফুটিয়ে তোলা হয় অগ্নিঝরা প্রতিবাদ।
তবে রাজধানীতে দেয়াল লিখনের সময় পুলিশি বাধার মুখে পড়তে হয় তাদের। কোটা সংস্কারে শিক্ষার্থীদের সমন্বয়ে গঠিত কমিশনের সুপারিশের ভিত্তিতে সংসদে আইন পাসসহ তিন দফা দাবিতে ২৭ জুলাই শনিবার ২৪ ঘণ্টার আলটিমেটাম দেন আন্দোলনের সমন্বয়করা।
একই সময় দেয়াল লিখন ও গ্রাফিতি আঁকার কর্মসূচিও দেওয়া হয়। ২৮ জুলাই রাজধানীর পলাশীতে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) দেয়াল লিখন ও গ্রাফিতি কর্মসূচি পালন করেন কার্টুনিস্ট এবং চারুকলার শিক্ষার্থীরা। তবে পুলিশি বাধায় তাদের ওই কর্মসূচি আর শেষ করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। পুলিশ তাদের রংতুলি জব্দ করে। এ ছাড়া চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, ইস্ট-ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটিসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে দেয়াল লিখন ও গ্রাফিতি করা হয়।
দেয়ালগুলোর গ্রাফিতিতে ‘সোনার বাংলা আজ মৃত্যুপুরী কেন?’, ‘আমার ভাইদের মারলি কেন?’, ‘সেভ দ্য কান্ট্রি জয়েন দ্য ফাইট’, ‘পুলিশি হত্যার বিচার চাই’, ‘একদিকে নাটক করে অন্যদিকে গুম করে’, ‘৫২ দেখিনি ২৪ দেখেছি’, ‘সম্পদের হিসাব পরে লাশের হিসাব আগে’, ‘হামার বেটাক মারলু ক্যান’ ইত্যাদি লেখা হয়। গ্রাফিতিতে স্থান পায় ছাদে গিয়ে গুলিতে নিহত ছোট্ট রিয়ার কথাও। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবি) শিক্ষার্থীরা আবু সাঈদের হাত উঁচিয়ে গুলির সামনে বুক পেতে দেওয়ার গ্রাফিতি আঁকেন।
এ ছাড়াও গোয়েন্দা পুলিশের হেফাজতে থাকা অবস্থায় রোববার রাতে কর্মসূচি প্রত্যাহার করার একটি ভিডিও বার্তা দেন কোটা সংস্কারের দাবিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম। তবে অন্য দুইজন সমন্বয়ক অভিযোগ করেন, জিম্মি করে নির্যাতনের মুখে এই বক্তব্য দেওয়ানো হয়। পরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক আব্দুল কাদেরের গণমাধ্যমে পাঠানো বার্তায় সারা দেশে সোমবার ছাত্র-জনতার বিক্ষোভ কর্মসূচি ও প্রতিবাদ সমাবেশ ঘোষণা করা হয়। ডিবি হেফাজতে থাকা সমন্বয়কদের কয়েকজনের পরিবার মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের কার্যালয়ে গেলেও তাদের পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে দেয়নি। এদিন ভোরে কোটা সংস্কার আন্দোলনের আরেক সমন্বয়ক নুসরাত তাবাসসুমকে ডিবি হেফাজতে নেওয়া হয়। মিরপুরের একটি বাসার গেট ভেঙে তাকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয় বলে পরিবারের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়।
দেশে মোবাইল ফোনে ইন্টারনেট সেবা ১০ দিন বন্ধ থাকার পর ২৮ জুলাই চালু করা হয়। তবে ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, টিকটকসহ বিভিন্ন সেবা বন্ধ রাখা হয়। বিকেল ৪টা থেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের তুলে নেওয়ার প্রতিবাদে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা সমাবেশ-বিক্ষোভ করে। তারা অবিলম্বে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার অন্যতম সমন্বয়ক আরিফ সোহেলকে মুক্তির দাবি জানায়। রাত ১১টার দিকে সমন্বয়কদের জিম্মি ও নির্যাতন করে বিবৃতি দেওয়ানোর প্রতিবাদে পরদিন ২৯ জুলাই আবারও রাজপথে আসার ঘোষণা দেয় দেশের প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকার বিভিন্ন কলেজের শিক্ষার্থীরা।
এক্ষেত্রে, দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষার্থীরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিবৃতি দেয়। এতে বলা হয়, ৯ দফা দাবি বাস্তবায়ন না হওয়া পর্যন্ত তারা এই আন্দোলন চালিয়ে যাবে।
প্রায় দুইদিন গোয়েন্দা হেফাজতে থাকার পর রোববার রাতে একটি খাবার টেবিলে তাদের সামনে খাবার দিয়ে ছবি তোলেন ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার হারুন-অর-রশীদ। রোববার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রচারিত এক বিবৃতিতে বলা হয়, বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সহিংসতা এবং সন্ত্রাসী কর্মকা-ের ঘটনায় নাগরিক সমাজের সংগঠন এবং গণমাধ্যমসহ কিছু আন্তর্জাতিক অংশীদারদের উদ্বেগ প্রকাশের বিষয়টি সরকার লক্ষ্য করেছে।
বিশেষ করে অপপ্রচার, ভুল তথ্য এবং বিভ্রান্তির ব্যাপক প্রচারের প্রেক্ষাপটে অকুণ্ঠ সমর্থন ও পরিস্থিতি সম্পর্কে সম্যক ধারণার জন্য সরকার আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে কৃতজ্ঞ। কোটা আন্দোলনকে ঘিরে সংঘাত-সহিংসতা ও সংকট শান্তিপূর্ণভাবে নিরসনের জন্য বাংলাদেশের জ্যেষ্ঠ নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে বলে জানান যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি ডোনাল্ড লু। বাংলাদেশে সহিংসতার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ সরকারের কারফিউ জারি ও নাশকতাকারীদের গুলি করতে পুলিশকে নির্দেশ দেওয়ার কথাও জানান ডোনাল্ড লু। তিনি বলেন, গুলির নির্দেশের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্রের মাধ্যমে উদ্বেগ জানানো হয়েছে।
২৮ জুলাই কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সহিংসতায় আহত পুলিশ সদস্যদের দেখতে রাজারবাগ কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতাল পরিদর্শন করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী। পরে তিনি সাম্প্রতিক সহিংসতায় আহতদের দেখতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে যান। সেখানে চিকিৎসাধীন আহতদের খোঁজ-খবর নেন। এর আগে সকালে গণভবনে আন্দোলনে নিহত আবু সাঈদসহ ৩৪ জনের পরিবারকে আর্থিক সহায়তা প্রদান করেন।
এদিকে সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে বিক্ষোভ, সংঘর্ষ, সংঘাত, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় সারা দেশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গ্রেপ্তার অভিযান অব্যাহত থাকে।
সব মিলিয়ে রোববার পর্যন্ত রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে গ্রেপ্তার হন ১০ হাজার ২৮ জন। এদিন রাজধানীতে সহিংসতার বিভিন্ন ঘটনায় আরও ২২টি মামলা হয়। এ নিয়ে রাজধানীতে মোট মামলার সংখ্যা দাঁড়ায় ২২৯ এবং গ্রেপ্তার সংখ্যা দাঁড়ায় ২ হাজার ৭৬৪ জনে।
কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে সংঘাত-সংঘর্ষে হতাহতদের তালিকা প্রকাশের দাবি জানায় বাম গণতান্ত্রিক জোট, ফ্যাসিবাদবিরোধী বাম মোর্চা ও বাংলাদেশ জাসদ। একই সঙ্গে হত্যায় জড়িতদের বিচার দাবি করেন তারা। রোববার সচিবালয়ে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান জানান, সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকে ঘিরে সংঘাত-সংঘর্ষে এখন পর্যন্ত ১৪৭ জন মারা গেছেন। এইদিন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বলা হয়, নির্বিচারে হত্যাকা-, মামলা ও গ্রেপ্তার চলতে পারে না।