ঢাকার পল্টনের মতো বিলেতে বাংলাদেশি রাজনীতির শক্তি প্রদর্শনের মঞ্চ হয়ে উঠেছে লন্ডনের ঐতিহাসিক আলতাব আলী পার্ক। ইস্ট লন্ডন মসজিদের পাশে নির্মিত এই পার্কেই বিএনপি, আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক দলের সভা-সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। প্রায় প্রতিদিনই কোনো না কোনো ইস্যুতে এখানে সমবেত হন রাজনৈতিক ও সামাজিক দলের নেতারা। পরিস্থিতি উত্তপ্ত হলে অনেক সময় স্থানীয় কাউন্সিল ও পুলিশ হিমশিম খায় সামাল দিতে। আশপাশের বাংলাদেশি ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, বাংলাদেশি স্টাইলে এখানে রাজনৈতিক দলগুলো সমাবেশ ও পালটা সমাবেশ করে থাকে। একই সময়ে বিএনপি-আওয়ামী লীগের সমাবেশের ঘটনাও আছে।
জানা যায়, ১৯৯৮ সালে পূর্ব লন্ডনের ওয়াইট চ্যাপল হাই স্ট্রিটের সেন্ট মেরিস পার্ককে আলতাব আলী পার্ক নামকরণ করা হয়। ১৯৯৯ সালে পার্কের দক্ষিণ অংশে নির্মাণ করা হয় শহিদ মিনার, যা দেশের বাইরে বানানো প্রথম শহিদ মিনার। এটি আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেন বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের তৎকালীন স্পিকার হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী।
প্রবীণ বাংলাদেশি কমিউনিটি নেতা আবুল ফজল জানান, আলতাব আলী পার্কে লন্ডনে অবস্থানকারী বাংলাদেশিরা ঘুরতে আসেন। বসে আড্ডা দেন। বাংলাদেশে চলমান নানা রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক ঘটনার প্রতিক্রিয়ায়ও অভিবাসী বাংলাদেশিরা জড়ো হন লন্ডনের এই পার্কে। এ ছাড়া বাঙালিদের বিভিন্ন সভা-সমাবেশের অন্যতম কেন্দ্রস্থলও এই আলতাব আলী পার্ক। লন্ডনে এই একখ- বাংলাদেশ একদিকে যেমন প্রবাসে বাঙালির সংগ্রামের প্রতীক, তেমনি তা দেশ আর দেশের মানুষের সঙ্গে অভিবাসী বাঙালির নিবিড় যোগসূত্রেরও প্রতীকে পরিণত হয়েছে।
যুক্তরাজ্য বিএনপির যুগ্ম সম্পাদক মিছবাহুজ্জামান সুহেল রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, আলতাব আলী পার্ক আমাদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান। বিভিন্ন দিবসে আমরা এখানে এসে সমবেত হই।
একুশে ফেব্রুয়ারি, ২৬ মার্চ, ১৬ ডিসেম্বরসহ দেশের অভ্যুত্থান এবং বিভিন্ন দাবিদাওয়াসহ আন্দোলন-সংগ্রামে আলতাব আলী পার্কের নাম জড়িয়ে আছে। বৃহৎ কোনো সমাবেশ হলে আমরা হাইড পার্ক, পার্লামেন্ট ভবনের সামনে জড়ো হই। ১৯৭১ সালে আমাদের কমিউনিটির মানুষ হাইড পার্কে সমবেত হয়ে পার্লামেন্ট ভবনে আসেন। ২০২৩ সালের নভেম্বরে প্রহসনের জাতীয় নির্বাচনের তপশিল বাতিল এবং নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন ও জনগণের ভোটের অধিকারের দাবিতে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সামনে বিশাল সমাবেশ করে যুক্তরাজ্য বিএনপি।
যুক্তরাজ্য যুবলীগের যুগ্ম সম্পাদক জামাল খান বলেন, বর্তমানে দেশের বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে আমাদের সব অঙ্গসংগঠন, সহযোগী সংগঠন, ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের কার্যক্রম সপ্তাহজুড়েই আলতাব আলী পার্কে অবস্থান করে। প্রতিটা সমাবেশ বা কার্যক্রমের আগে অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে পুলিশ প্রশাসনের অনুমতি নিতে হয়। একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস স্থানীয় টাওয়ার হেমলেটস কাউন্সিলের উদ্যোগে এই পার্কে অনুষ্ঠিত হয়।
প্রসঙ্গত, ’৮০-র দশকে বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনে শহিদ বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত আলতাব আলীর নামে নামকরণ করে পূর্ব লন্ডনের হোয়াইট চ্যাপেল রোডের পার্কে অস্থায়ীভাবে একটি শহিদ মিনার স্থাপন করে ভাষা আন্দোলনের শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়। প্রথম খোলা আকাশের নিচে শহিদ মিনার তৈরি করে ভাষা-শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের এই কর্মসূচি স্থায়ী শহিদ মিনার সৃষ্টির আন্দোলনকে আরও বেগবান করে। টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলের সঙ্গে এ বিষয়ে দেন-দরবারের একপর্যায়ে একটি স্থায়ী শহিদ মিনার নির্মাণে কাউন্সিল-কমিউনিটি ঐকমত্যে পৌঁছাতে সম্মত হয়। কাউন্সিলের পক্ষ থেকে কমিউনিটিকে প্রস্তাব দেওয়া হয়Ñ জায়গা বরাদ্দ দেবে কাউন্সিল, কিন্তু শহিদ মিনার তৈরির খরচ বহন করতে হবে কমিউনিটিকে। এই প্রস্তাবে কমিউনিটির সম্মতির ভিত্তিতে বাংলাদেশ ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন শুরু করে ফান্ড সংগ্রহ তৎপরতা।
এ তৎপরতায় এগিয়ে আসে বাংলাদেশ হাইকমিশন, সোনালী ব্যাংক, আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি, কমিউনিস্ট পার্টি, একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি, জাসদ ও উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীসহ ৫৪টির মতো সংগঠন। আর এই ৫৪ সংগঠনের যৌথ অংশগ্রহণে গঠন করা হয় কেন্দ্রীয় শহিদ মিনার কমিটি। টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলের পক্ষ থেকে আলতাব আলী পার্কে স্থায়ী শহিদ মিনার নির্মাণের প্রস্তাব দেওয়া হলে কেন্দ্রীয় শহিদ মিনার কমিটি এর ব্যয় নির্বাহে সম্মতি জানায়। ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনসহ ৫৪টি সংগঠনের পক্ষ থেকে শহিদ মিনার নির্মাণের ব্যয় হিসেবে কাউন্সিলের কাছে তুলে দেওয়া হয় প্রায় ২২ হাজার পাউন্ড। এভাবেই আলতাব আলী পার্কে স্থায়ীভাবে নির্মিত হয় বাঙালির আত্মপরিচয়ের প্রতীক শহিদ মিনার।
আপনার মতামত লিখুন :