শনিবার, ০৯ আগস্ট, ২০২৫

ফেসবুক


ইউটিউব


টিকটক

Rupali Bangladesh

ইনস্টাগ্রাম

Rupali Bangladesh

এক্স

Rupali Bangladesh


লিংকডইন

Rupali Bangladesh

পিন্টারেস্ট

Rupali Bangladesh

গুগল নিউজ

Rupali Bangladesh


হোয়াটস অ্যাপ

Rupali Bangladesh

টেলিগ্রাম

Rupali Bangladesh

মেসেঞ্জার গ্রুপ

Rupali Bangladesh


আরিয়ান স্ট্যালিন

প্রকাশিত: আগস্ট ৯, ২০২৫, ১২:৩৯ এএম

দাবদাহ-বন্যায় বিপর্যস্ত এশিয়া মহাদেশ

আরিয়ান স্ট্যালিন

প্রকাশিত: আগস্ট ৯, ২০২৫, ১২:৩৯ এএম

দাবদাহ-বন্যায় বিপর্যস্ত এশিয়া মহাদেশ

বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলার জুমচাষি জ্যোতিপ্রভা। তিনি চার নাতি-নাতনির দাদি। জ্যোতিপ্রভা ভেবেছিলেন, জীবনের শেষবেলাটা হবে বিশ্রামের; আরও থাকবে গান, নাচ আর উৎসবের সময়। কিন্তু বাস্তবতা একেবারেই ভিন্ন। এখনো প্রতিদিন জুমের জমি দেখতে পাহাড়ে যেতে হয় তাকে। পরিশ্রম করতে হয় বেশ।

এ বছর তার জীবনের অন্যতম কঠিন বছর। জুমে শসার আবাদ করেছেন জ্যোতিপ্রভা। তিনি বললেন, শুরুতে বৃষ্টি কম ছিল। তাই শসাখেতে বেশি সার দিতে হয়েছিল। এরপর হুট করে কয়েক দিনের মধ্যে এত বেশি বৃষ্টি হলো যে পুরো আবাদই নষ্ট হয়ে গেল। এখন তার আশঙ্কা, এত কষ্টের ধানও বুঝি একইভাবে নষ্ট হয়ে যাবে। বৈরী প্রকৃতি, আবহাওয়ার এলোমেলো আচরণ, হঠাৎ বৃষ্টি কিংবা তীব্র খরা এসব জ্যোতিপ্রভার মতো কৃষিনির্ভর মানুষদের বেশি ভাবাচ্ছে। শুধু পাহাড়ের বাসিন্দারাই নন, উপকূলীয় কিংবা খরাপ্রবণ বরেন্দ্র অঞ্চলের মানুষও প্রকৃতির এই বৈরী আচরণের মুখোমুখি হচ্ছেন প্রতিনিয়ত। এ সমস্যা শুধু বাংলাদেশরই নয়, বৈশ্বিক। পুরো বিশ্ব এখন উষ্ণায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় ব্যস্ত। আমাদের এশিয়া মহাদেশের ক্ষেত্রে পরিবেশের বৈরী আচরণের প্রভাবটা সাম্প্রতিক সময়ে বেশ চোখে পড়ছে। এই মহাদেশের এক প্রান্তে যেমন তীব্র দাবদাহ চলছে, অন্য প্রান্তে ভারি বৃষ্টি আর বন্যা।  এসব কারণে বিপর্যস্ত এশিয়ার জনজীবন। 

বিশ্বব্যাংকের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০৫০ সালের মধ্যে বিশ্বজুড়ে অতিরিক্ত ৪ কোটি ১০ লাখ মানুষ দরিদ্র হয়ে পড়তে পারে, যারা মূলত ‘জলবায়ু প্ররোচিত’ আয়ের ক্ষতির কারণে দারিদ্র্যের নতুন শিকার হবে। ‘দ্য ফিউচার অব পোভার্টি: প্রজেক্টিং দ্য ইমপ্যাক্ট অব ক্লাইমেট চেঞ্জ অন গ্লোবাল পোভার্টি থ্রু ২০৫০’ শীর্ষক বিশ্লেষণভিত্তিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যদি বৈশ্বিক উষ্ণতা বর্তমান গতিতে বাড়তে থাকে, তাহলে বিশ্বের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যেতে পারে। এ ছাড়া বিশ্বব্যাংকের এক হিসাব বলছে, শুধু দক্ষিণ এশিয়াতেই ২০৩০ সালের মধ্যে প্রায় ৪ কোটি ৮৮ লাখ মানুষ চরম দারিদ্র্যের মধ্যে পড়তে পারে। আর ২০৫০ সালের মধ্যে বিশ্বজুড়ে এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াতে পারে ১৪ কোটি ৮৮ লাখে।

বাংলাদেশের কথাই যদি বলি, চরম আবহাওয়াজনিত ঘটনাবলির কারণে ২০২৪ সালে দেশের ৩ কোটি ৩০ লাখ শিশুর শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হয়েছে। ইউনিসেফের এক বিশ্লেষণে এ চিত্র উঠে এসেছে। প্রতিবেদনে বাংলাদেশে আবহাওয়াজনিত শিশুদের শিক্ষায় ব্যাঘাত ঘটানোর বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে। এতে দেখা গেছে, বিশ্বজুড়ে তাপপ্রবাহ, ঘূর্ণিঝড়, বন্যা ও অন্যান্য চরম আবহাওয়াজনিত ঘটনাবলির কারণে দফায় দফায় স্কুল বন্ধ দিতে হয়েছে। সারা বিশ্বে ২০২৪ সালে তাপপ্রবাহ, ঝড়, বন্যা ও খরার কারণে স্কুল বন্ধ হয়ে ৭৭টি দেশের অন্তত ২৪ কোটি ৭০ লাখ শিশুর শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হয়। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চল ছিল দক্ষিণ এশিয়া।

বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থার তথ্যানুযায়ী, বিশ্বব্যাপী গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধির তুলনায় এশিয়া দ্বিগুণ গতিতে উষ্ণ হয়ে উঠছে। সম্প্রতি জলবায়ু ঝুঁকি সূচক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত তিন দশকে বন্যা, তাপপ্রবাহ ও খরার মতো চরম আবহাওয়া পরিস্থিতির কারণে এশিয়া অঞ্চলের আর্থিক ক্ষতি দাঁড়িয়েছে প্রায় ২ ট্রিলিয়ন ডলার। এই তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে চরম আবহাওয়া, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও পরিবেশগত বিপর্যয় দিনে দিনে বাড়ছে। ২০২৪ সালের জলবায়ু পরিস্থিতি নিয়ে সম্প্রতি প্রকাশিত বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থার (ডব্লিউএমও) ‘স্টেট অব দ্য ক্লাইমেট ইন এশিয়া ২০২৪’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২৪ সাল ছিল এশিয়ার ইতিহাসে সবচেয়ে উষ্ণ অথবা দ্বিতীয় সর্বোচ্চ উষ্ণ বছর। এ সময় দীর্ঘমেয়াদি তাপপ্রবাহ এবং ভয়াবহ সমুদ্র তাপমাত্রার কারণে এ অঞ্চলের অর্থনীতি, বাস্তুতন্ত্র ও সমাজে ব্যাপক প্রভাব পড়েছে।

এশিয়ার বিভিন্ন দেশের সাম্প্রতিক আবহাওয়ার পরিস্থিতির দিকে চোখ বুলালে দেখা যাচ্ছে, একদিকে রুদ্ররোষে জ¦লছে জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, ভিয়েতনাম; অন্যদিকে চীন, পাকিস্তান ও ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে চলছে টানা বর্ষণ ও ভয়াবহ বন্যা। আবহাওয়াবিদেরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে এই চরম আবহাওয়ার ঘটনা আগের চেয়ে অনেক বেশি ঘনঘন, তীব্র ও অপ্রত্যাশিতভাবে ঘটছে। বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থার (ডব্লিউএমও) তথ্য অনুযায়ী, এশিয়া বিশ্ব গড়ের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ হারে উষ্ণ হয়ে উঠছে। গত তিন দশকে এই অঞ্চলে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ২ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার।

গত ৫ আগস্ট মঙ্গলবার রেকর্ড গরমে পুড়েছে জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া। সেদিন জাপানের ইসেসাকি শহরে তাপমাত্রা পৌঁছায় ৪১ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। দেশটির ইতিহাসে এটি সর্বোচ্চ রেকর্ড। এর আগে জুন ও জুলাই মাসেও রেকর্ড গরম অনুভূত হয়। মধ্য জুন থেকে জুলাইয়ের শেষ পর্যন্ত হিটস্ট্রোকে অন্তত ৫৬ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছেন টোকিওর চিকিৎসা বিভাগের কর্মকর্তারা। চরম গরমে রেললাইন বেঁকে যাওয়ার শঙ্কায় কিছু ট্রেন চলাচল সাময়িকভাবে বন্ধ রাখা হয়। দক্ষিণ কোরিয়ার অবস্থা ভিন্ন নয়। জুলাই মাসে টানা ২২ রাত দেশটির তাপমাত্রা ছিল ২৫ ডিগ্রির ওপরে, যা রেকর্ড ‘ট্রপিক্যাল নাইট’। এতে হিটস্ট্রোক ও ডিহাইড্রেশনের ঘটনা ব্যাপক হারে বেড়েছে। সরকার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে পোশাকের নিয়ম শিথিল করেছে, যেন শীতাতপ নিয়ন্ত্রণে নির্ভরতা কমে। ভিয়েতনামের রাজধানী হ্যানয় চলতি আগস্টে প্রথমবারের মতো ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের গরমে পুড়েছে। 

এ ছাড়া দক্ষিণ চীনের গুয়াংডং প্রদেশে বৃষ্টি ও বন্যার সঙ্গে ছড়াচ্ছে মশাবাহিত চিকুনগুনিয়া রোগ। মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগে বেইজিংয়ের পার্বত্য এলাকায় হঠাৎ বন্যায় প্রাণ গেছে বহু মানুষেরÑ শুধু একটি প্রবীণ নিবাসেই প্রাণ হারিয়েছেন ৩১ জন। চীনের আবহাওয়া সংস্থা জানিয়েছে, এক মাস আগেও যখন ঝড়-জলোচ্ছ্বাস প্রায় ছিল না বললেই চলে, তখন গত সপ্তাহেই পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরে একযোগে তিনটি সক্রিয় ঝড় দেখা যায়। হংকংয়ে গত মঙ্গলবার এক দিনেই ৩৫০ মিলিমিটার বৃষ্টি রেকর্ড করা হয়, যা ১৮৮৪ সালের পর সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত। এ ছাড়া ভারতের উত্তরাখ- রাজ্যে আকস্মিক মেঘভাঙা বৃষ্টিতে সৃষ্ট বন্যায় নিখোঁজ শতাধিক মানুষ। পাহাড়ি এলাকায় হঠাৎ জলঢল ও ভূমিধসে ভয়াবহ অবস্থা তৈরি হয়েছে। দেশটির কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ভারতে চলমান বর্ষায় ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগে ১ হাজার ৬২৬ জন প্রাণ হারিয়েছে। জুলাই মাস শেষ হতেই দেশের বিভিন্ন রাজ্যে এই প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। মন্ত্রণালয়ের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত রাজ্য অন্ধ্র প্রদেশ, সেখানে মৃত্যু হয়েছে ৩৪৩ জনের। দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে মধ্যপ্রদেশ, মৃত ২৪৩ জন। তৃতীয় হিমাচল প্রদেশ, মৃত্যু হয়েছে ১৯৫ জনের। চতুর্থ স্থানে কর্ণাটক (১০২ জনের মৃত্যু) ও পঞ্চম বিহার (১০১ জন)। কেন্দ্র জানিয়েছে, এই পাঁচ রাজ্যেই দেশের মোট মৃত্যুর ৬০ শতাংশ ঘটেছে। 

এ ছাড়া পাকিস্তানের কথা যদি বলা হয়, দেশটিতে জুন থেকে এ পর্যন্ত বৃষ্টিজনিত দুর্ঘটনায় ৩০০ জনের মৃত্যু হয়েছে, যার মধ্যে শতাধিক শিশু। বন্যায় ধ্বংস হয়েছে বহু ঘরবাড়ি ও অবকাঠামো। ব্রিটিশ সাহায্য সংস্থা সেভ দ্য চিলড্রেন জানিয়েছে, পাঞ্জাব প্রদেশে প্রায় এক-চতুর্থাংশ স্কুল আংশিক বা সম্পূর্ণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যত দিন না জলবায়ু পরিবর্তনের মূল কারণগুলো যেমনÑ জীবাশ্ম জ¦ালানি ব্যবহার, বন উজাড় ও অতিমাত্রায় নগরায়ণ নিয়ন্ত্রণে না আনা যায়, তত দিন এ ধরনের চরম আবহাওয়ার ঝুঁকি ও প্রাণহানি বাড়তেই থাকবে। এ ছাড়া বিশ্বের তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে সমুদ্রে গ্যাস বেড়ে যাবে। এতে অনেক মৎস্য ও সামুদ্রিক প্রাণী চিরতরে হারিয়ে যাবে। বনভূমির উদ্ভিদ ও বন্য প্রাণীর ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটতে পারে। ফলে শুধু সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা নয়, উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলেও অনেক স্থায়ী ক্ষতি হতে পারে। সেই ক্ষতি মোকাবিলা করার সুযোগ নেই। ফলে এসব প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর নির্ভরশীল জনগোষ্ঠীর জীবিকার স্থায়ী ক্ষতি হতে পারে।

রূপালী বাংলাদেশ

Shera Lather
Link copied!