মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে প্রশাসনের কঠোর নজরদারিতেও বন্ধ হচ্ছে না পাহাড়ি ছড়া থেকে অবৈধভাবে সিলিকাবালু উত্তোলন। কেউ প্রভাব খাটিয়ে, কেউ প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে, কেউবা বাড়িঘরের কাজের কথা বলে প্রতিনিয়তই বালু উত্তোলন করে যাচ্ছেন। এতে সরকারের রাজস্ব হারানোর পাশাপাশি অপরিকল্পিতভাবে বালু উত্তোলনের ফলে পরিবেশের ক্ষতিসহ ছড়ার পাড় ভাঙন, বালু পরিবহনে রাস্তা ভাঙনসহ নানাভাবে দুর্ভোগে পড়েন এলাকাবাসী।
কঠোর নজরদারি সত্ত্বেও অবৈধভাবে বালু উত্তোলন ঠেকাতে হিমশিম খাচ্ছে প্রশাসন। গত শনিবার সন্ধ্যায় শ্রীমঙ্গল শহরের শান্তিবাগ এলাকায় ভুড়ভুরিয়া ছড়া থেকে বালু উত্তোলনের অভিযোগ আসে শ্রীমঙ্গল পৌর বিএনপির আহ্বায়ক শামীম আহমদের বিরুদ্ধে। এ রকম একটি ভিডিও ভাইরাল হয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয় দলীয় পদবির প্রভাব খাটিয়ে তারা এ বালু উত্তোলন করছেন।
অভিযোগের বিষয়ে শ্রীমঙ্গল পৌর বিএনপির আহ্বায়ক শামীম আহমদ বলেন, আমি কখনো বালুর ব্যবসা করিনি, ভবিষতেও এই ব্যবসা করার ইচ্ছা নেই। তবে শনিবার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বালু উত্তোলনের ভিডিও ভাইরালের বিষয়ে তিনি বলেন, তার বাসা ছড়ার পাড়ে। পাহাড়ি ঢলে তার বাসা ও রাস্তা ঝুঁকিতে রয়েছে। তাই তিনি দুইজন শ্রমিক লাগিয়ে ছড়া থেকে বালু তুলে বস্তায় ভরে ছড়ার পাড়ে ও রাস্তায় দিচ্ছেন।
এ ব্যাপারে শ্রীমঙ্গল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. ইসলাম উদ্দিন বলেন, ইজারাবিহীন ঘাট থেকে কারোরই বালু তোলার সুযোগ নেই। এ ব্যাপারে প্রশাসনের কড়া নজরদারি রয়েছে। যারাই অবৈধ বালু উত্তোলনের সঙ্গে জড়িত হবেন তাদের আইনের আওতায় আনা হবে।
তিনি আরও বলেন, বিগত এক বছরে ইতিমধ্যে ১৬টি নিয়মিত মামলা, ৭টি মোবাইল কোর্ট অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে। এতে প্রচুর পরিমাণে বালু ও যানবাহন জব্দসহ জরিমানা করা হয়েছে। জব্দকৃত বালু ইতিমধ্যে তিনবার নিলাম করা হয়েছে, যার পরিমাণ ৭১ হাজার ২৮৫ ফুট।
তিনি আরও বলেন, খবর পেয়ে শনিবার শ্রীমঙ্গল শান্তিবাগ এলাকায়ও অভিযানে যায় ভ্রাম্যমাণ আদালত। সেখানে শামীম আহমদ তার বাসার পাশে ছড়ার পাড় রক্ষার জন্য ছড়া থেকে বালু তুলে তা বস্তায় ভরছিলেন। তবে এটিও করা যাবে না। পরে এ ব্যাপারে শামীম আহমদসহ স্থানীয় লোকজনদের ডেকে সবাইকে এ রকম কাজ ভবিষ্যতে না করার জন্য সতর্ক করেন। আর তার পুনরাবৃত্তি করা হলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
শ্রীমঙ্গল উপজেলা সহকারী কমিশনার ভূমি মো. মহিবুল্লাহ আকন বলেন, শনিবার সন্ধ্যায় শ্রীমঙ্গল শান্তিবাগ এলাকায় অভিযানে যান। সেখানে কিছু লোক কর্তৃক অবাণিজ্যিকভাবে বালু উত্তোলনের সত্যতা পান এবং একশ ঘনফুট বালি জব্দ করেন। আর যিনি বালু ওঠাচ্ছিলেন তিনি ভবিষতে আর কখনো বালু উত্তোলন করবেন না মর্মে তার কাছ থেকে মুচলেখা নেওয়া হয়। এ সময় তারা ওই ঘাট বন্ধ করে স্থানীয় এলাকাবাসীকে সতর্ক করে দেন।
তিনি আরও বলেন, ইজারাবিহীন কোনো ঘাট থেকে বাণিজ্যিক কিংবা অবাণিজ্যিক কোনোভাবেই বালু উত্তোলন করা যাবে না।
এ সময় তিনি বলেন, ছড়া থেকে বালু উত্তোলন শ্রীমঙ্গলের জন্য এটি একটি বড় সমস্যা। তিনি শ্রীমঙ্গল ভূমি অফিসে যোগদান করেছেন মাত্র এক সপ্তাহ হলো। এরই মধ্যে তিন দিনই বালু উত্তোলন বন্ধে অভিযানে বের হতে হয়েছে। গত ২৭ আগস্ট ইজারাকৃত গোপলা ছড়ায় ব্রিজের পাশ থেকে বালু উত্তোলন বন্ধ করান। ২৬ আগস্ট উপজেলার রঘুনাথপুর কালীবাড়ি এলাকায় যৌথবহিনীর অভিযানে ৫শ ফুট বালি জব্দ করেন। একই সাথে ওইদিন বিকেলে উপজেলার সিন্দুরখান ইউনিয়নের সিক্কা ও ডোবাগাঁও এলাকায় আরও দুটি অবৈধ ঘাটে অভিযান করেন। এ সময় বালুসহ অবৈধ উত্তোলনকারীরা পালিয়ে যায়। তবে উভয় স্থানে বাঁশের গড় দিয়ে অবৈধ ঘাট বন্ধ করে আসেন।
তিনি আরও বলেন, শ্রীমঙ্গল উপজেলায় ৩১টি বালু মহাল রয়েছে, যেগুলো হলো ভুরভুরিয়াছড়া, জৈনকাছড়া, খাইছড়া, জাগছড়া, সুমইছড়া শাওনছড়া, নারায়ণছড়া লংলিয়াছড়া, উদনাছড়া বিলাসছড়া, ডিংডিংগাছড়া, পুটিয়াছড়া নলুয়াছড়া হুগলিয়াছড়া, গান্ধিছড়া, আমরইলছড়া, আলীয়াছড়া, মাকড়ীছড়া, শুয়ারীছড়া পাত্রীয়াছড়া, জৈতাছড়া, ইছামতিছড়া, বৌলাছড়া, বড় ছড়া, মুড়াছড়া, কালিছড়া কলমছড়া, ফুলছড়া, গোপলাছড়া ও শিয়ালছড়া। যার মধ্যে ইজারা দেওয়া হয়েছে ৬টি। ইজারাধীন ছড়াগুলো হচ্ছে জৈনকাছড়া, জাগছড়া (পশ্চিম অংশ), সুমইছড়া, নারায়ণছড়া, বৌলাছড়া ও বড়ছড়া।
এলাকাবাসী জানান, দীর্ঘদিন ধরে শ্রীমঙ্গলের বিভিন্ন ছড়া ও জমির মাটি কেটে তার নিচ থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করে আসছে একটি চক্র। এতে একদিকে নদীর প্রাকৃতিক প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, অন্যদিকে সড়ক ও জনপথের অবকাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তারা বলেন, ইজারা নিয়ে নিয়ম মেনে বালু উত্তোলন করার সরকারি নিয়ম রয়েছে। শ্রীমঙ্গলের সব ছড়া যদি বৈধ ইজারার আওতায় আসে তবে এ প্রক্রিয়া কমে যাবে।
শ্রীমঙ্গল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. ইসলাম উদ্দিন বলেন, প্রতিটি ছড়ার দৈর্ঘ্য ৮-১০ কিলোমিটার, কোনোটা তারও বেশি। এই ছড়াগুলোতে সিলিকাবালু উৎপন্ন হয়। এই দীর্ঘ এলাকাজুড়ে ছড়াগুলো নজরদারিতে রাখতে তাদের হিমশিম খেতে হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে জনগণের সচেতন হওয়া ছাড়া তা রক্ষা করা কষ্টকর। তবে কষ্ট হলেও আমরা অভিযান অব্যাহত রাখব। যারাই অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করবে তাদের আইনের আওতায় আনা হবে।