ঢাকা রবিবার, ০২ নভেম্বর, ২০২৫

দ্বিধাদ্বন্দ্বে জাপার ভোটে অংশগ্রহণ অনিশ্চিত

এফ এ শাহেদ
প্রকাশিত: নভেম্বর ২, ২০২৫, ০১:৩৩ এএম
ছবি- রূপালী বাংলাদেশ

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে দেশের প্রায় সব রাজনৈতিক দল জোর প্রস্তুতি এবং প্রচারণা চালাচ্ছে। ছোট-বড়ো দলগুলো যখন নির্বাচনি তৎপরতা শুরু করছে, ব্যতিক্রমী চিত্র জাতীয় পার্টিতে (জাপা)। দলীয় কোন্দল, রাজনৈতিক দলগুলোর ক্রমাগত চাপে দ্বিধাদ্বন্দ্ব জাপায়, ফলে নির্বাচনে যোগদান নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে অনিশ্চয়তা। এখন পর্যন্ত দেখা যায়নি কোনো নির্বাচনি কর্মকাণ্ড, তৃণমূলেও নেই কোনো প্রচার।

দলের শীর্ষ নেতারা বলছেন, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় সরকার সব দলকে সমান অধিকার দেবে। তার পরিবর্তে জাপাকে অসহযোগিতা করা হচ্ছে।  এ অবস্থায় সরকার জাপাকে নির্বাচনে অংশ নিতে দেবে কি না, তা নিশ্চিত নয়। এই পরিস্থিতিতে নির্বাচনে জাপা অংশগ্রহণ করবে কি না তা নিয়ে শঙ্কা রয়েছে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, আওয়ামী লীগকে ফ্যাসিবাদী হওয়ার পেছনে জাপার ভূমিকা বেশি। সেই স্থান থেকে জামায়াত, গণঅধিকার, এনসিপিসহ বিভিন্ন দল দলটির নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার পক্ষে শক্ত অবস্থানে রয়েছে। তবে নির্বাচন কমিশন কোনো রাজনৈতিক দলের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করতে পারে না। এটা সিদ্ধান্ত দিতে হবে সরকারকে অথবা আদালতকে। নিষিদ্ধ না হওয়া পর্যন্ত যেকোনো দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ এবং বর্জন দুই করতে পারে।

এদিকে দলের মধ্যে চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন জাতীয় পার্টির শীর্ষ নেতা জি এম কাদের। ফ্যাসিস্ট সময়ে দলের ভূমিকার সঙ্গে নেতৃত্বের দুর্বলতা অনিশ্চিতের মুখে ফেলেছে জাতীয় পার্টির ভবিষ্যৎ। অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে জর্জরিত দলের নির্বাচনি প্রতীক ‘লাঙল’ নিয়ে টানাটানি। যে বিষয় গড়িয়েছে আদালত পর্যন্ত। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই আইনি লড়াই আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে দলটির অংশগ্রহণ কাঠামোকেই পুনর্নির্ধারণ করতে পারে। অবশ্য জাপার নেতাকর্মীরা বলছেন, প্রতীক নিয়ে এই সংঘাত যেমন বিভাজনকে গভীর করার আশঙ্কা তৈরি করেছে, অপরদিকে তা দলের দ্বন্দ্ব মীমাংসার পথও খুলেছে। বিবদমান পক্ষগুলো শেষ পর্যন্ত ঐক্যবদ্ধ হয়ে ১৩তম জাতীয় নির্বাচনে অংশ নিতে পারেন বলে ধারণা তাদের।

নির্বাচনে অংশগ্রহণের বিষয়ে জাতীয় পার্টির একাংশের মহাসচিব ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘গণতান্ত্রিক শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন প্রয়োজন। সেই নির্বাচনের জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত প্রয়োজন। লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডসহ সব দলের সমান অধিকার নিশ্চিত করতে পারলে জাপা সব সময় নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত। তবে আমরা বর্তমানে সংকটের মধ্যে রয়েছি। দেশ, জাতি, রাজনৈতিক দল সবাই সংকটে। দেশে নির্বাচন হবে কি না, কবে নির্বাচন হবে তা নিয়ে সংশয়ে আছি। ভোট গঠনমূলক ও সুষ্ঠু হবে কি না, জাতীয় পার্টিকে সুষ্ঠুভাবে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে দেবে কি নাÑ কোনোটাই এখন সঠিক উত্তর দেওয়ার সময় আসেনি।’

শামীম হায়দার আরও বলেন, ‘যদি জাতীয় পার্টিকে ছাড়া নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, তবে তা হবে বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে নিম্নমানের নির্বাচনগুলোর একটি। এমন ভোট ২০১৪ সালের একতরফা নির্বাচনের চেয়েও খারাপ হতে পারে।’ তিনি মনে করেন, বড়ো রাজনৈতিক শক্তিগুলোকে বাদ দিয়ে নির্বাচন করলে সেটি শুধু একতরফা হবে না, বরং দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাও হুমকির মুখে পড়বে। তিনি আরও বলেন, ‘সরকার প্রতিটি ক্ষেত্রেই ব্যর্থ হয়েছে। সাধারণ জনগণের আস্থা অর্জন করতে পারেনি। এই অবস্থায় ভোট হলে ভোটের পরে এবং ভোটের দিন সংঘাত হতে পারে। জাতীয় নির্বাচন একটি সমষ্টিগত প্রক্রিয়া। সব দলের অংশগ্রহণের পাশাপাশি সরকার, ঐকমত্য কমিশন, নির্বাচন কমিশনের সমন্বিত সৎ ও নিরপেক্ষ উদ্যোগের মাধ্যমে অনুষ্ঠিত নির্বাচনই দেশকে এই মহাসংকট থেকে উত্তরণের পথে নিয়ে যেতে পারে।’

এদিকে নির্বাচন ইস্যুতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার একতরফা নির্বাচনের পাঁয়তারা করছে বলে মন্তব্য করেছেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের। তিনি বলেন, ‘সরকার একতরফা নির্বাচন করলে দেশ গৃহযুদ্ধের দিকে ধাবিত হবে।’

তিনি অভিযোগ করেছেন, ‘সরকার একতরফা নির্বাচন করার পাঁয়তারা করছে। সুষ্ঠু, অংশগ্রহণমূলক, নিরপেক্ষ নির্বাচন করার সদিচ্ছা এবং সক্ষমতা এই সরকারের নেই।’

জি এম কাদের দাবি করেছেন, তারা কখনোই আওয়ামী লীগের দোসর ছিলেন না, সব সময় জনগণের দোসর ছিলেন। এমনকি জাপাকে আওয়ামী লীগ জোর করে নির্বাচনে নিয়েছিল।

নির্বাচনে জাপার অবস্থানের বিষয়ে, জাতীয় পার্টির একাংশের মহাসচিব (আনিসুল ইসলাম মাহমুদ) মুজিবুল হক চুন্নু রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘নির্বাচনে যাওয়ার জন্য সুষ্ঠু যে পরিবেশ প্রয়োজন হয়, আমার তা দেখতে পারছি না। অংশগ্রহণমূলক, নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য সরকারের সহযোগিতার প্রয়োজন রয়েছে। জাপা একটি নিবন্ধিত দল, সে হিসেবে এই দলের সভা, মিটিং-মিছিল করার বৈধতা থাকলেও সরকার আমাদের কোনো সহযোগিতা করছে না। সরকার গণতন্ত্রের কথা বলে, স্বৈরতন্ত্র হটানোর কথা বলে, তবে আমরা জাপার সঙ্গে স্বৈরতন্ত্রিক আচরণ দেখতে পাচ্ছি।’

তিনি বলেন, ‘জাতীয় ইস্যু নিয়ে সরকার আলোচনা করছে, তবে সেখানে আমাদের ডাকা হচ্ছে না। এগুলো গণতন্ত্রের লক্ষণ না। সরকার আমাদের সঙ্গে বৈমাতৃকসুলভ আচরণ করছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘নির্বাচনের পরিবেশ হলে অবশ্যই আমরা নির্বাচনে অংশ নেব। আমরা নির্বাচনমুখী দল। সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক, নিরপেক্ষ নির্বাচন করার সদিচ্ছা যদি সরকার পোষণ করে থাকে, জাপা যেহেতু নিষিদ্ধ হয়নি, তাদের অংশগ্রহণ ব্যতিরেকে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হতে পারে না। সুতরাং লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করে সরকারের উচিত জাপাকে নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়া।’

তিনি বলেন, ‘আমরা সব রাজনৈতিক দলকে অনুরোধ করব, জাতীয় পার্টি শান্তিপূর্ণভাবে রাজনীতি করার দল। জাপা একটি আধুনিক গণতন্ত্রমনা মডার্ন ডেমোক্রেটিক পার্টি। দেশের মানুষকে নিয়ে এগিয়ে যেতে চাই। এ বিষয়ে দেশের সব রাজনৈতিক দল, সরকারসহ সবার সহযোগিতা চাই।’

এদিকে, আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টি যাতে অংশ নিতে না পারে সে ব্যবস্থা নিতে নির্বাচন কমিশনকে (ইসি) বলেছে গণঅধিকার পরিষদ। শক্ত অবস্থানে জামায়াত, এনসিপিসহ অনেকগুলো রাজনৈতিক দল।

জাপা প্রসঙ্গে নুরুল হক নুর বলেন, ‘বাংলাদেশের জনগণ ফ্যাসিবাদী শক্তিকে প্রত্যাখ্যান করেছে। আইনগতভাবে তাদের বিচার হচ্ছে। সুতরাং তারা যেন নির্বাচনে অংশ নেওয়ার কোনো সুযোগ না পায়। একইভাবে এই ফ্যাসিবাদের দোসর জাতীয় পার্টিসহ ১৪ দলকে নির্বাচনের সুযোগ দেওয়া যাবে না। একই সঙ্গে জাপার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।’

জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সদস্যসচিব আখতার হোসেন বলেন, ‘আওয়ামী লীগকে ফ্যাসিবাদী হওয়ার পেছনে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রেখেছে জাপা। জাপা আগামী নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারবে না।’