ঢাকা রবিবার, ০৫ অক্টোবর, ২০২৫

রংপুর বিভাগের দুই জেলায়  ৩৯ জনের শরীরে অ্যানথ্রাক্সের উপসর্গ 

গাইবান্ধা ও মিঠাপুকুর প্রতিনিধি
প্রকাশিত: অক্টোবর ৫, ২০২৫, ১২:৩২ এএম

রংপুরের ৩ উপজেলায় ২৮ ব্যক্তির শরীরে আ্যানথ্রাক্স উপসর্গ ধরা পড়ার পর এবার গাইবান্ধা জেলার সুন্দরগঞ্জ উপজেলায় অন্তত ১১ জন এই রোগে আক্রান্ত হয়েছে বলে জানা গেছে। ইতিমধ্যে এই রোগে আক্রান্ত হয়ে পীরগঞ্জ উপজেলায় দুজনের মৃত্যু হয়েছে। আর সুন্দরগঞ্জ উপজেলায় অসুস্থ একটি গরু জবাইয়ের পর অন্তত ১১ জন অ্যানথ্রাক্স রোগে আক্রান্ত হয়েছে। স্থানীয় স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা বিষয়টি নিয়ে উদ্বিগ্ন না হয়ে সচেতন থাকার পরামর্শ দিয়েছেন। তবে পরপর আক্রান্তের ঘটনায় স্থানীয় মানুষের মনে আতঙ্ক বিরাজ করছে। রূপালী বাংলাদেশের প্রতিনিধিদের পাঠানো খবরÑ

সুন্দরগঞ্জে ১১ জনের শরীরে উপসর্গ :

গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলায় অসুস্থ একটি গরু জবাইয়ের পর অন্তত ১১ জন অ্যানথ্রাক্স রোগে আক্রান্ত হয়েছে। আক্রান্তদের মধ্যে পাঁচজন গাইবান্ধা জেলা হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে বাড়ি ফিরে গেছে এবং বাকিরা স্থানীয়ভাবে চিকিৎসা নিচ্ছে। গত শুক্রবার উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. দিবাকর বসাক ঘটনাটির সত্যতা নিশ্চিত করেন।

সুন্দরগঞ্জ উপজেলার বেলকা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হাফিজার রহমান জানান, ২৭ সেপ্টেম্বর বেলকার কিশামত সদর গ্রামে মাহাবুর রহমানের একটি গরু হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ে। পরে গরুটি জবাই করে কম দামে স্থানীয়দের মধ্যে মাংস ভাগ করে দেওয়া হয়। জবাইয়ের কাজে অংশ নেওয়া ১১ জনের শরীরে কয়েক দিন পর ফোসকা, ঘা ও পচনের মতো উপসর্গ দেখা দেয়। ধীরে ধীরে তাদের হাত, মুখ, চোখ ও নাকে ক্ষতচিহ্ন স্পষ্ট হয়ে ওঠে। চিকিৎসকের পরামর্শে পরীক্ষায় তাদের অ্যানথ্রাক্সে আক্রান্ত হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত হয়।

আক্রান্তদের মধ্যে মোজাফফর মিয়া, মোজা মিয়া, শফিকুল ইসলাম, মাহাবুর রহমানসহ পাঁচজন বর্তমানে গাইবান্ধা জেলা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। বাকিরা স্থানীয়ভাবে চিকিৎসা নিচ্ছেন।

ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য হাফিজার রহমান বলেন, গরুটি অসুস্থ ছিল, তার পরও কয়েকজন গ্রামবাসী সেটি জবাই করেন। যারা সরাসরি জবাইয়ের কাজে ছিলেন, তারাই এখন অসুস্থ।

গাইবান্ধার সিভিল সার্জন ডা. রফিকুজ্জামান বলেন, অ্যানথ্রাক্স নিয়ে আতঙ্কের কিছু নেই। এটি মানুষ থেকে মানুষে ছড়ায় না। অসুস্থ গবাদিপশু জবাই বা মাংস ব্যবহারের মাধ্যমে এ রোগ ছড়ায়। নিয়মিত চিকিৎসায় কয়েক দিনের মধ্যেই রোগীরা সুস্থ হয়ে ওঠেন। তিনি সবাইকে অসুস্থ পশু জবাই থেকে বিরত থাকার পরামর্শ দেন।

মিঠাপুকুরে রোগী বাড়ছেই:

সরকারি হিসাবে মিঠাপুকুরে সাতজনের শরীরে আ্যানথ্রাক্সের উপসর্গের কথা বলা হলেও বাস্তবে সংখ্যাটা দ্বিগুণেরও বেশি বলে মনে করছেন স্থানীয়রা। এ ছাড়া এলাকায় আরও অ্যানথ্রাক্স উপসর্গের রোগী রয়েছে বলে দাবি করেছেন উপজেলার আমাইপুর গ্রামের বাসিন্দারা।

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, মিঠাপুকুরে প্রথম আ্যানথ্রাক্স উপস্বর্গের রোগী শনাক্ত হয় ইমাদপুর ইউনিয়নের আমাইপুর গ্রামে। এই গ্রামে একটি অসুস্থ গরু জবাই করেন গ্রামের লোকজন। গরুটি তড়িঘড়ি করে জবাই করে কম দামে মাংস বিক্রি করা হয়। গত ২০ সেপ্টেম্বর ওই গ্রামের প্রথম আক্রান্ত রোগী আ্যানথ্রাক্স আক্রান্ত ওই গরুর মাংস খেয়েছিলেন। এ ছাড়া ওই গরু প্রক্রিয়াজাত করার সঙ্গে সম্পৃক্ত লোকজনের শরীরেও পরবর্তীতে আ্যানথ্রাক্সের উপস্বর্গ দেখা দেয়। এমনকি মাংস রান্নার কাজে সম্পৃক্ত নারীরাও আক্রান্ত হয়েছেন।

ভুক্তভোগীরা জানান, ইতিমধ্যে উপজেলার আমাইপুর, দুর্গাপুর ও তরফসাদি গ্রামে আ্যানথ্রাক্স উপস্বর্গের রোগী পাওয়া গেছে। উপজেলা স্বাস্থ্য বিভাগ বলছেন, সাতজন আ্যানথ্রাক্স রোগী রয়েছে, তাদের চিকিৎসা চলছে। তবে বাস্তবে এই হিসাব অনেক বেশি।

সরেজমিন আমাইপুর গ্রামে দেখা গেছে, আ্যানথ্রাক্স আক্রান্ত রোগীরা শরীরে ক্ষত নিয়ে দিন যাপন করছে। আক্রান্ত গ্রামের এক গৃহিণীর বাম হাতের মধ্যম আঙুলে ঘা হয়ে ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছে। আঙুলটি দিয়ে পুঁজ ও ময়লা পানি বের হচ্ছে। কান্নাজড়িত কণ্ঠে ওই গৃহিণী বলেন, ‘বাবা ওই গোছ (মাংস) বাড়িত আনি এই অবস্থা। খুব ব্যথা করে, পচে যাচ্ছে। কোনো ডাক্তার আইসে নাই। হামরা গরিব মানুষ, এত ট্যাকা কোটে পাই।’

একই অবস্থা গ্রামের দুই দিনমজুরের। তাদের হাত, কোমর ও পিঠে আ্যানথ্রাক্সের ক্ষত রয়েছে। তারাও স্থানীয় চিকিৎসকের পরামর্শে ওষুধ ও পাউডার ব্যবহার করছেন। এ ছাড়া গ্রামের অনেকেই শরীরে চুলকানি ও ছোট-বড় ক্ষত নিয়ে আতঙ্কে রয়েছেন। অনেকেই লোকলজ্জায় আক্রান্ত হওয়ার বিষয়টি প্রকাশ করছেন না। ইতিমধ্যে পীরগাছা উপজেলায় দুজন অ্যানথ্রাক্স উপস্বর্গের রোগীর মৃত্যু হয়েছে। এ খবর ছড়িয়ে পড়ায় ওই এলাকায় ভীতি তৈরি হয়।

উপজেলা স্বাস্থ্য বিভাগ কয়েকজনের নমুনা সংগ্রহ করলেও অনেকেই এই রোগের চিকিৎসা ও সচেতনতা সম্পর্কে কিছুই বলতে পারেননি। আক্রান্তদের অনেকেই স্থানীয় গ্রাম্য চিকিৎসকের কাছে চিকিৎসা নেওয়ার কথা জানান।

ভুক্তভোগীরা জানান, প্রাণিসম্পদ দপ্তর গ্রামে কিছু গবাদি পুশুকে টিকা দিলেও এখনো অনেক বাড়ির গবাদি পশু টিকা পায়নি। এ ছাড়া উপজেলা স্বাস্থ্য বিভাগের পক্ষ থেকেও আ্যানথ্রাক্স মোকাবিলায় তেমন কোনো উদ্যোগ নেই। এ কারণে প্রায় প্রতিটি ঘরেই এই রোগ ছড়িয়ে পড়ছে। 

স্থানীয় সচেতন মহল বলছে, দ্রুত আ্যানথ্রাক্স মোকাবিলায় জনসচেতনতার পাশাপাশি চিকিৎসা নিশ্চিত করা না গেলে এ রোগ ছড়িয়ে পড়বে।

ইমাদপুর ইউপি চেয়ারম্যান শফিকুল ইসলাম জানান, অ্যানথ্রাক্স মোকাবিলায় উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। প্রতি ওয়ার্ডে একজন ইমাম, ইউপি সদস্য ও প্রাণিসম্পদ দপ্তরের প্রতিনিধির সমন্বয়ে কমিটি গঠন করা হয়েছে। যাতে কেউ অসুস্থ গরু জবাই করতে না পারে।

অ্যানথ্রাক্স নিয়ে উদ্বিগ্ন না হয়ে সচেতন থাকার পরামর্শ দিয়েছেন স্থানীয় স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ও চিকিৎসকেরা। মিঠাপুকুর প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মো. আলতাব হোসেন বলেন, উপজেলায় বর্তমানে গরুর সংখ্যা প্রায় ৩ লাখ এবং দেড় লাখেরও বেশি ছাগল রয়েছে। সরকারিভাবে ৩৪ হাজার গবাদি পশুর জন্য টিকা বরাদ্দ পাওয়া গেছে, যা চাহিদার তুলনায় অনেক কম। তবে সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও সচেতনতা বৃদ্ধি ও কঠোর তদারকির মাধ্যমে অ্যানথ্রাক্স নিয়ন্ত্রণের সর্বাত্মক চেষ্টা করছি।

উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ইনডোর মেডিকেল অফিসার ডা. এম এ হালিম লাবলু বলেন, ‘মিঠাপুকুরে সাতজনের নমুনা সংগ্রহ করে আইইডিসিআরএ পাঠানো হলে দুজনের পজিটিভ এসেছে। এ ছাড়া আরও কয়েকজন অ্যানথ্রাক্স উপস্বর্গের রোগী রয়েছে। আমরা সচেতনতার পাশাপাশি চিকিৎসা দিয়ে যাচ্ছি।’

সিভিল সার্জন ডাক্তার শাহিনা আক্তার বলেন, রংপুরের তিনটি উপজেলা পীরগাছা, কাউনিয়া ও মিঠাপুকুরে এখন পর্যন্ত ২৮ ব্যক্তির শরীরে এনথ্রাক্স ধরা পড়েছে। প্রতিটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসকরা সচেতন রয়েছে। আতঙ্কিত হওয়ার তেমন কিছু নেই।