ঢাকা শুক্রবার, ১০ অক্টোবর, ২০২৫

সিলেটে ফের আলোচনায় আরিফুল হক চৌধুরী

সালমান ফরিদ, সিলেট
প্রকাশিত: অক্টোবর ১০, ২০২৫, ১২:২৫ এএম

আরিফুল হক চৌধুরী। সিলেট সিটি করপোরেশনের দু’বারের নির্বাচিত মেয়র। করেন বিএনপির রাজনীতি। এক সময় ছিলেন সিলেট মহানগর বিএনপির সভাপতি। এখন সম্মানজনক পদ বিএনপির চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা পরিষদের অন্যতম সদস্য। এ মুহূর্তে সিলেটের সবচেয়ে জনপ্রিয় নেতা হিসেবে তাকে বিবেচনা করা হয়। দলমত নির্বিশেষে প্রায় সবার পছন্দের মানুষ তিনি। আপসহীন কিন্তু ব্যক্তিত্বসম্পন্ন। কথা বলেন স্পষ্ট এবং অঞ্চলপ্রীতি রেখে। এটি তিনি পেয়েছেন তার রাজনৈতিক গুরু, বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে সফল, একাধিকবারের সাবেক অর্থ ও পরিকল্পনামন্ত্রী এম. সাইফুর রহমানের কাছ থেকে।

সিলেট সিটি করপোরেশনের প্রবীণ ও বারবার নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি তিনি। দু’দফায় মেয়র নির্বাচিত হওয়ার আগে ছিলেন নির্বাচিত কাউন্সিলর। সিলেট পৌরসভার কাউন্সিলর দিয়ে তার ‘জনপ্রতিনিধি’র জীবন শুরু। এখনো তিনি সিলেট মহানগরীর অনেকটা অপরিহার্য জনপ্রতিনিধি। এ রকমই মনে করেন সিলেটবাসী। এম. সাইফুর রহমানের জামানায় তিনি ছিলেন সিলেটের সবচেয়ে ক্ষমতাধর লোক। সিলেটের উন্নয়নের স্বার্থে এবং যেকোনো প্রয়োজনে তিনি হুংকার দিয়ে রাজপথে নেমে আসেন।

সেই আরিফুল হক চৌধুরী সবসময় আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকতে পছন্দ করেন। কখনো আলোচনার টেবিল থেকে হারিয়ে গেলে তিনি আবার নতুন কোনো ইস্যুতে নিজেকে ফিরিয়ে আনেন। এই ক’দিন আগে তিনি ‘সুন্দর সিলেট’-এর মিশন নিয়ে মাঠে নেমেছিলেন। মহানগরীতে অবৈধ ব্যাটারিচালিত রিকশার বিরুদ্ধে তার কার্যক্রম ইতোমধ্যেই নগরবাসীর দৃষ্টি কেড়েছে। নগর পুলিশের ট্রাফিক বিভাগের সহায়তায় সুফলও পাচ্ছে নগরবাসী। এ নিয়ে আরিফের উদ্যোগ তাকে আলোচনায় নিয়ে আসে। তারও কিছুদিন আগে তিনি আলোচনায় আসেন সাবেক আলোচিত-সমালোচিত ও সিলেট থেকে পাথরকা-ে প্রত্যাহার হওয়া জেলা প্রশাসক শের মাহবুব মুরাদের বিরুদ্ধে রাজপথে নেমে। তবে এবারকার আলোচনা অবশ্য ভিন্ন কারণে।

তার নিজের দল বিএনপির হয়ে সংসদ নির্বাচন কিংবা সিলেট সিটি নির্বাচনে টিকিট পাওয়া না-পাওয়ার ইস্যুতে। গত মঙ্গলবার সিলেট নগরীর মেজরটিলায় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ৩১ দফার সমর্থনে লিফলেট বিতরণ শেষে অনুষ্ঠিত সংক্ষিপ্ত সমাবেশে সাবেক মেয়র ও বিএনপি নেতা আরিফুল হক চৌধুরী বলেন, ‘আমি এখনো স্থির করি নাই, আমার দলের চেয়ারম্যানকে বলে দিয়েছি- নির্বাচন করলে এবং মনোনয়ন দিলে সিলেট-১ আসনে দিতে হবে। যদি সংসদ সদস্য না দেন, তাহলে আমাকে সিলেট সিটিতে মেয়র পদে ডিক্লেয়ার করতে হবে।

আমি এটাও বলছি, না হলে আমাকে বলতে হবে, আপনাকে দিয়ে হবে না; আমি আসসালামু আলাইকুম। মধ্যখানে কোনো কিছু থাকবে না।’ এমন বক্তব্য দিয়ে তিনি দল বিএনপিসহ সিলেটে ফের আলোচনায় চলে আসেন। বিএনপিসহ পুরো সিলেটে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। দ্রুত তার ওই বক্তব্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়ে যায়। যদিও পরদিন নিজের বাসভবন থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লাইভে এসে ভিডিও বার্তায় তিনি দাবি করেন, তার বক্তব্য বিকৃত করে প্রকাশ ও প্রচার করা হয়েছে। সেখানে তিনি বলেন, ‘সিলেট-১ আসন, না হয় মেয়র আমাকে দিতে হবে, আমি এমন কোনো বক্তব্য দেইনি। সামনে নির্বাচন, আমার ভাবমূর্তি নষ্ট করতে এমন অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। যারা এটাকে প্রচার করছেন। বিএনপি দলের চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া ও ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নেতৃত্বে আমরা অবিচল।’

অবশ্য বিএনপির একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছে, দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান আরিফুল হক চৌধুরীকে সিলেট-১ সংসদীয় আসনে প্রার্থী হওয়ার ব্যাপারে এখনো কোনো সবুজ সংকেত দেননি। এখানে খন্দকার আব্দুল মুক্তাদিরের মনোনয়ন পাওয়ার সম্ভাবনা উজ্জ্বল। বরং দলীয় কৌশলগত ভারসাম্য বজায় রাখতে তারেক রহমান তাকে আবার সিলেট সিটি করপোরেশনের মেয়র পদে নির্বাচন করার ইঙ্গিত দিয়েছেন। দলের প্রতীকে লড়তে হলে তাকে সিটি করপোরেশনের মেয়র পদেই লড়তে হবে।

অবশ্য আরিফুল হক চৌধুরীর ঘনিষ্ঠজনেরাও সে রকম ইঙ্গিত দিচ্ছেন। মানসিকভাবে তিনি মেয়র পদে নির্বাচনের প্রস্তুতিও নিচ্ছেন। এ জন্য নগরীর বিভিন্ন এলাকায় জনসংযোগ করছেন প্রতিদিন। একেকদিন একেক মসজিদে জুমার নামাজ আদায় করছেন। তিনি সংসদ নির্বাচনে প্রার্থিতার প্রশ্নে সিলেট-১ ছাড়া আর কোনো আসন থেকে মনোনয়ন চান না। সিলেট-৪-এ প্রার্থী হওয়ার আগ্রহ প্রথম দিকে দেখালেও সেখান থেকে সরে আসেন। সংসদ নির্বাচনে দল মনোনয়ন দিতে চাইলে যেন তাকে সিলেট-১-এ দেওয়া হয়। আর তা না হয়ে যদি নির্বাচনের জন্য প্রার্থী হতে বলে দল, তাহলে সেটি যেন সিলেট সিটি করপোরেশন হয়Ñ সেই জায়গা থেকেই তিনি তৎপরতা চালাচ্ছেন।

আরিফ কয়েক মাস আগে নগরের শেখঘাট মসজিদ থেকে ‘ইজাজত’ নিয়ে সিলেট-১ আসনে সংসদ সদস্য পদে আনুষ্ঠানিক প্রচারণায় নেমেছিলেন। যদিও ৩ মাস পর সংসদ সদস্য পদে শঙ্কার কথা তুলে ধরে একটি মতবিনিময় সভায় বক্তব্য রাখেন তিনি। আরিফ জানেন, সিলেট-১ আসনে বিএনপির শক্ত প্রার্থী খন্দকার আব্দুল মুক্তাদির, যিনি তার মতোই বেগম খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা। লন্ডন লবিংয়ে তিনি এখনো অনেক দূর এগিয়ে আছেন তার থেকে। অনেকে এ আসনে মুক্তাদিরের প্রার্থিতা প্রায় নিশ্চিত ধরে নিয়েছেন। ফলে এখানে প্রার্থী হওয়া তার জন্য চ্যালেঞ্জিং হবে।

এর চেয়ে সহজ সিলেট সিটি করপোরেশনের মেয়র পদে লড়াই করার জন্য দলের টিকিট পাওয়া। সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলে তিনি সহজেই বিজয় লাভ করবেনÑ এটি মনে করেন নগরবাসীসহ বিএনপির স্থানীয় ও কেন্দ্রের নীতিনির্ধারকরা। এটি মাথায় রেখেই এগোচ্ছেন তিনি।

আরিফুল হক চৌধুরী বর্তমানে কোনো সরকারি দায়িত্বে নেই, তিনি সিটি করপোরেশনের মেয়রও নন। তবুও নগরের প্রায় সবকিছুতেই তার ডাক পড়ে বা তিনি এগিয়ে আসেন সবার আগে। সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সাথে তিনি নেমে পড়েন কাজে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এটি আরিফুল হক চৌধুরীর রাজনৈতিক অবস্থান ও কৌশল মূলত ‘নগর রাজনীর অপরিহার্য হয়ে থাকা’র কৌশলের অংশ। নির্বাচনের আগে নগরবাসীর আস্থা অর্জন এবং সিটি করপোরেশন নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার জন্য জনমত তৈরি তার উদ্দেশ্য। এটি সমালোচনার চেয়ে প্রশংসিত হচ্ছে বেশি।

নগরবাসী অনেকে মনে করেন, মেয়র পদে আরিফুল হক চৌধুরীই এ মুহূর্তে সবচেয়ে যোগ্য লোক। সিলেট নগরে তাকে প্রয়োজন। তিনি যেভাবে সিলেট নগরীকে গুছিয়ে এনেছেন, যে পরিকল্পনা নিয়ে নগরকে সাজাতে শুরু করেছিলেন, মেয়র পদে বসে সেই পরিকল্পনার বাস্তবায়ন তিনিই সবচেয়ে বেশি আন্তরিকতা ও দক্ষতায় করতে পারবেন।

এদিকে সিলেটের সাথে সারা দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থায় দীর্ঘদিনে চলমান দুর্ভোগ, অনিয়ম ও চরম নৈরাজ্যের প্রতিবাদে মাঠে নেমে আবারও আলোচনায় থেকে যাচ্ছেন আরিফুল হক চৌধুরী। আগামী ১২ অক্টোবর, রোববার নগরীর কোর্ট পয়েন্টে বেলা ১১টায় একটি সমাবেশের ডাক দিয়েছেন তিনি। এতে দল-মত নির্বিশেষে সব সিলেটবাসীকে উপস্থিত থাকার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। এটি মূলত সড়ক যোগাযোগ এবং চরম ঝুঁকিপূর্ণ ও সংস্কারহীন ব্রিটিশ আমলের রেলপথের উন্নয়নের দাবিতে ডাকা।  

২০১৩ সালের সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী মরহুম বদর উদ্দিন আহমদ কামরানকে পরাজিত করে প্রথম মেয়র হয়েছিলেন বিএনপির আরিফুল হক চৌধুরী। ২০১৮ সালের নির্বাচনে তিনি ফের দলীয় প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করে মেয়র হন। তবে ২০২৩ সালের নির্বাচনে দলের বারণ থাকায় মেয়রপ্রার্থী হননি তিনি। ওই বছরের ২০ মে তিনি ঘোষণা দিয়ে সিটি নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ান। আরিফ প্রার্থী না হওয়ায় সিটি নির্বাচনে মেয়র হয়েছিলেন আওয়ামী লীগের আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী।

সিলেট সিটি করপোরেশনের একাধিক সূত্র জানায়, প্রায় ১ বছর ধরে জনপ্রতিনিধিশূন্য সিটি করপোরেশন। বর্তমানে প্রশাসক বিভাগীয় কমিশনার। কিন্তু প্রশাসনিক কাজে বর্তমান প্রশাসক ব্যস্ত থাকায় সিটির উন্নয়ন কাজে তেমন নজর দিতে পারেন না। এ জন্য নানা কাজে এখনো পরামর্শ নিতে হয় সাবেক মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীর। এমনকি নগরের বাতিল হওয়া একটি প্রকল্প কাটছাঁট করে ৫০০ কোটি টাকার প্রকল্প নিয়ে আসতে মন্ত্রণালয়ে তদবির করতে হয়েছে সেই আরিফুল হক চৌধুরীকেই।

আরিফুল হক চৌধুরী আলোচনায় আসা প্রসঙ্গে বলেন, ঠিক আলোচনায় থাকা নয়, সিলেটের প্রয়োজনে আর দল বিএনপির জন্যই আমি কাজ করি, কথা বলি। তিনি বলেন, যে আসনে আমি ৪৭ বছর রাজনীতি করেছি, যেখানে আমি বেড়ে উঠেছিÑ সেই সিলেট-১ আসনে নির্বাচন করা আমার লক্ষ্য থাকতেই পারে। সেই লক্ষ্য আমার রয়েছে। এই কথাটাই আমি বলেছি। মনোনয়ন দেওয়া না দেওয়া দলের সিদ্ধান্ত। আমার দলের নেতা তারেক রহমান সেই সিদ্ধান্ত নেবেন।