ভোলার বোরহানউদ্দিন উপজেলার ঐতিহ্যবাহী হাকিমুদ্দিন ফাজিল মাদ্রাসায় ঘটেছে এক চাঞ্চল্যকর আর্থিক কেলেঙ্কারি। অভিযোগ উঠেছে প্রতিষ্ঠানটির অফিস সহকারী কামাল উদ্দিন মিরাজ বছরের পর বছর শত শত ভুয়া শিক্ষার্থীর নামে সরকারি উপবৃত্তির টাকা আত্মসাৎ করেছেন। প্রাথমিক তদন্তে দেখা গেছে, তিনি একাই প্রায় অর্ধকোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন।
২০২১ সালের শেষ দিকে মাত্র ১২ হাজার টাকা বেতনে চাকরি শুরু করেন কামাল উদ্দিন। তথ্যপ্রযুক্তিতে পারদর্শী হওয়ায় মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তি ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব তার হাতে তুলে দেন। প্রিন্সিপালের মোবাইল ফোনে যাওয়া OTP কোডের সুযোগে কামাল উদ্দিন শত শত ভুয়া শিক্ষার্থী তৈরি করে প্রতারণার মাধ্যমে সরকারি উপবৃত্তির টাকা উত্তোলন করেন।
পরিদর্শনে দেখা গেছে, আলিম প্রথম বর্ষে প্রকৃত শিক্ষার্থী ছিল ৭৩ জন, কিন্তু সরকারি ওয়েবসাইটে দেখানো হয়েছে ১৩৩ জন। সেখানে ৯৫ জন উপবৃত্তি পেয়েছেন। শুধু এই শ্রেণিতেই চার বছরে আত্মসাৎ হয়েছে প্রায় ২১ লাখ ৬০ হাজার টাকা।
একইভাবে ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত ১৫০ জন ভুয়া শিক্ষার্থী বাড়িয়ে তোলা হয় আরও ১৮ লাখ টাকার উপবৃত্তি বাবদ। নবম ও দশম শ্রেণিতে ভুয়া নাম যোগ করে আত্মসাৎ করা হয় প্রায় ২০ লাখ টাকা। সব মিলিয়ে ৩ শতাধিক ভুয়া শিক্ষার্থীর নামে ৫০–৫৫ লাখ টাকা তোলা হয়।
উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা রেজাউল করিম জানান, “ঢাকা থেকে আসা পরিদর্শক দল মাদ্রাসার উপবৃত্তি সংক্রান্ত অনিয়ম ধরেছে। প্রিন্সিপাল স্বীকার করেছেন পাসওয়ার্ড তার দায়িত্বে থাকার কথা, তবে অফিস সহকারির কর্মকাণ্ড সম্পর্কে তিনি জানতেন না বলে দাবি করেছেন।”
তিনি আরও বলেন, “নকল শিক্ষার্থীর নামে রেজিস্ট্রেশন কার্ড ও অভিভাবকের তথ্য ব্যবহার করার পেছনে একটি প্রতারক চক্র সক্রিয় ছিল বলে ধারণা করা হচ্ছে।”
গত আগস্টে পরিদর্শক দল আসার খবর পেয়ে কামাল উদ্দিন তাড়াহুড়ো করে ভুয়া নাম মুছে ফেলতে গিয়ে প্রকৃত শিক্ষার্থীদের নামও মুছে ফেলেন, ফলে শতাধিক শিক্ষার্থী উপবৃত্তি থেকে বঞ্চিত হয়। তদন্তে দেখা যায়, সরকারি ওয়েবসাইটে উপবৃত্তিপ্রাপ্ত শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৭৫০ জন, অথচ বাস্তবে ছিলেন মাত্র ৪৫০ জন।
মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল মাওলানা আল আমিন বলেন, “কামাল উদ্দিন আইটিতে দক্ষ হওয়ায় তার হাতে কাজ দেওয়া হয়েছিল। OTP আমার ফোনে আসত, প্রয়োজনে তাকে দিতাম। দুর্নীতির সুযোগ ছিল বুঝিনি।”
তবে তদন্ত কর্মকর্তাদের মতে, অনুমোদন কোড ব্যবহারের দায়িত্ব প্রিন্সিপালের, ফলে নৈতিকভাবেও তিনি দায় এড়াতে পারেন না।
মাত্র ১২ হাজার টাকায় চাকরি শুরু করা কামাল উদ্দিন এখন এলাকায় পরিচিত কোটিপতি। বোরহানউদ্দিন পৌরসভার ৬ নম্বর ওয়ার্ডে তার একটি দোতলা বাড়ি (মূল্য প্রায় ৫০ লাখ টাকা) ও ৩০ শতাংশ জমি রয়েছে।
স্থানীয়রা জানান, তিনি আগে বীমা কোম্পানি ও গ্রাম আদালতে কাজ করার সময়ও আর্থিক অনিয়মে জড়িত ছিলেন। সাংবাদিকরা যোগাযোগের চেষ্টা করলেও তিনি ফোনে সাড়া দেননি।
তদন্ত কমিটির সুপারিশে কামাল উদ্দিনকে দুই মাসের জন্য সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। তবে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের ক্ষোভ এখনো প্রশমিত হয়নি। তাদের প্রশ্ন, “একজন অফিস সহকারি বছরের পর বছর কোটি টাকার অনিয়ম করলেন, অথচ প্রিন্সিপাল জানলেন না—এটা কীভাবে সম্ভব?”
অভিভাবকদের ভাষায়, “যেখানে জ্ঞানের আলো ছড়ানোর কথা, সেখানে দুর্নীতির অন্ধকারে ডুবে গেছে প্রতিষ্ঠানটি। সরকারের উপবৃত্তির টাকা এখন কিছু অসাধু ব্যক্তির হাতের খেলনা হয়ে গেছে।”