নিয়ম ভেঙে পদোন্নতিপ্রাপ্ত ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনের ৩৩ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আট বছর পর ব্যবস্থা নিয়েছে প্রশাসন। এক বিজ্ঞপ্তিতে তাদের পূর্বের দায়িত্বে ফিরিয়ে নেওয়া হয়েছে। শাস্তিমূলক এই ব্যবস্থার কারণে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে।
গত ১১ আগস্ট এক প্রজ্ঞাপনে ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনের প্রশাসক মোখতার আহমেদ ২০১৯ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর থেকে ২০২৩ সালের ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত চলতি দায়িত্বপ্রাপ্ত সব কর্মকর্তা-কর্মচারীকে আগের পদে ফিরিয়ে নেওয়ার নির্দেশ দেন। এ সিদ্ধান্তের পেছনে মূল কারণ হিসেবে সরকারি বিধিমালা লঙ্ঘন এবং অনুমোদিত সাংগঠনিক কাঠামো উপেক্ষা করে পদায়নের অভিযোগ আনা হয়েছে।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের নিয়ম অনুযায়ী, কোনো কর্মকর্তাকে দুই মাসের বেশি সময় ধরে চলতি দায়িত্ব দেওয়া যাবে না। বিশেষ প্রয়োজনে মেয়াদ ছয় মাস পর্যন্ত বাড়ানো গেলেও তার জন্য সংশ্লিষ্ট কমিটির অনুমোদন প্রয়োজন। কিন্তু এই নিয়ম মানেনি ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনের তৎকালীন প্রশাসন। এ ছাড়া সিটি করপোরেশন অনুমোদিত সাংগঠনিক কাঠামোতে নেই এমন কিছু পদেও লোকবল পদায়ন করা হয়েছিল।
এ ঘটনার পর আলোচনা-সমালোচনা সৃষ্টি হলে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন কর্মকর্তারা। প্রত্যেকের রুমের সামনের নেমপ্লেট খুলে ফেলেন। এতে ভাটা পড়েছে চলমান বিভিন্ন কাজে। তবে আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পদ ফিরে পাওয়ার কথা জানান কর্মকর্তারা।
নির্বাহী প্রকৌশলীর (যান্ত্রিক) দায়িত্ব পালন করা মো. শাফি কামাল বলেন, ‘নিয়ম অনুযায়ী তখন উপসহকারী প্রকৌশলী (যান্ত্রিক) থেকে নির্বাহী প্রকৌশলীর দায়িত্ব পেয়েছিলাম। কিন্তু এখন একটি প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে আমাদের দায়িত্ব খর্ব করা হয়েছে। এতে আমরা মানসিক ও সামাজিকভাবে হেয় হচ্ছি। আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পদ ফিরে পেতে চেষ্টা করা হচ্ছে। তবে সিটি করপোরেশনের সব কাজ আমরা করে যাচ্ছি, এতে কোনো স্থবিরতা হচ্ছে না।’
জয়নাল আবেদীন হেলথ ভিজিটর হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত। স্যানিটারি ইন্সপেক্টর পদে চলতি দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। তাকেও আগের পদে ফেরত পাঠানো হয়েছে। কাঞ্চন কুমার নন্দীর মূল পদ প্রধান সহকারী। তিনি প্রশাসনিক কর্মকর্তা হিসেবে অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করেছেন। তাকে আগের পদে ফেরত পাঠানো হয়েছে। মোহাম্মদ সিদ্দিকুর রহমানের মূল পদ কার্য সহকারী। তিনি এত দিন সম্পত্তি কর্মকর্তা হিসেবে চলতি দায়িত্বে ছিলেন। তাকেও আগের পদে ফেরত পাঠানো হয়েছে।
ডাক্তার এইচকে দেবনাথ ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনের মেডিকেল অফিসার। এত দিন চিফ মেডিকেল অফিসার হিসেবে চলতি দায়িত্বে ছিলেন। তাকে তার মূল পদে ফিরিয়ে নেওয়া হয়েছে। মুহা. আমিনুল ইসলামের মূল পদ প্রশাসনিক কর্মকর্তা। তিনি সহকারী সচিব পদে চলতি দায়িত্বে ছিলেন।
ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনের বিভিন্ন বিভাগে নির্বাহী প্রকৌশলী হিসেবে চলতি দায়িত্বে ছিলেন মোহাম্মদ আজহারুল হক, জীবন কৃষ্ণ সরকার, জসিম উদ্দিন, শফি কামাল, জিল্লুর রহমান। তাদের সবাইকে উপসহকারী প্রকৌশলী পদে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে।
প্রধান প্রকৌশলীর চলতি দায়িত্ব থেকে নির্বাহী প্রকৌশলী পদে ফেরত যাওয়া রফিকুল ইসলাম মিয়ার ভাষ্য, এই আকস্মিক পদাবনতিতে প্রশাসনিক কাজে সমস্যা হচ্ছে। বিভিন্ন প্রকল্পের পরিচালক হিসেবে তিনি টেন্ডার আহ্বান করতে পারছেন না। ফলে ঠিকাদারদের কাজও থমকে গেছে।
সহকারী সচিবের চলতি দায়িত্ব থেকে প্রশাসনিক কর্মকর্তা পদে ফিরেছেন মোহা. আমিনুল ইসলাম। তিনি জানান, জনস্বার্থে চলতি দায়িত্ব পেলেও কোনো আর্থিক সুবিধা পাননি। এ সিদ্ধান্তের কারণে তার সামাজিক মর্যাদা ক্ষুণœ হয়েছে এবং দাপ্তরিক কাজে বিঘœ ঘটছে।
স্যানিটারি ইন্সপেক্টর দীপক মজুমদার বলেন, ‘আমাদের অর্গানোগ্রামটি অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছিল। এটি পাস হলে আমরা নিয়মানুযায়ী পদোন্নতি পেতাম।’
প্রশাসকের আকস্মিক সিদ্ধান্তে সিটি করপোরেশনের গুরুত্বপূর্ণ পদগুলো শূন্য হয়ে পড়েছে। এতে টেন্ডার প্রক্রিয়া সম্পন্ন, নথিতে স্বাক্ষর এবং প্রকল্প বাস্তবায়নের মতো জরুরি কাজ থমকে গেছে।
একাধিক কর্মকর্তা জানান, সিটি করপোরেশনের দাপ্তরিক কাজ সুষ্ঠুভাবে পরিচালনায় প্রধান প্রকৌশলী, নির্বাহী প্রকৌশলী, প্রধান হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা, স্যানিটেশন ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তার মতো গুরুত্বপূর্ণ পদগুলো অপরিহার্য। তৎকালীন প্রশাসন কাজের গতি বজায় রাখতে জনস্বার্থে এসব পদে চলতি দায়িত্ব দিয়েছিল।
সিটি করপোরেশনের সচিব সুমনা আল মজিদ বলেন, প্রস্তাবিত সাংগঠনিক কাঠামো অনুযায়ী এই ৩৩ জনকে চলতি দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। তবে দুই মাসের মধ্যে পদোন্নতি কমিটির অনুমোদন না নেওয়ায় ভুলটি হয়েছে। পরিস্থিতি বিবেচনায় বিভিন্ন প্রকল্পের জন্য এসব পদের প্রয়োজন ছিল।
রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে অযোগ্য বিভিন্ন কর্মকর্তা পদ দখল করে রাখায় সিটি করপোরেশনে প্রত্যাশিত টেকসই উন্নয়ন হয়নি বলে জানিয়ে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) ময়মনসিংহ জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক ইয়াজদানী কোরায়শী কাজল বলেন, ‘উপসহকারী প্রকৌশলী থেকে সহকারী প্রকৌশলী না হয়ে নিয়ম ভেঙে এক ধাপ এগিয়ে অনেককে নির্বাহী প্রকৌশলী করা হয়েছিল। এতে কর্মকর্তাদের মধ্যে অভিজ্ঞতারও ঘাটতি দেখা যায়। এর বড় প্রমাণ হলো, হাতে নেওয়া বিভিন্ন প্রকল্পের কাজ, যা নিয়ে আমরা বারবার কথা বলেছি।’
গণসংহতি আন্দোলন ময়মনসিংহ জেলা শাখার আহ্বায়ক মোস্তাফিজুর রহমান রাজীব বলেন, বিগত সরকারের সময় সব ক্ষেত্রেই দুর্নীতি ভরপুর ছিল। এতে যেমন রাজনৈতিক ব্যক্তিরা জড়িত, ঠিক তেমনি ছিলেন আমলারাও। সিটি করপোরেশনে যাদের চলতি দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে, তারা দায়িত্ব পালনকালীন ক্ষমতা ও চেয়ারের অপব্যবহার করেছে। এখন দেখা যাচ্ছে তাদের চলতি দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়ায় উন্নয়নকাজে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। দ্রুত এসব পদে দক্ষ জনবল নিয়োগ দিয়ে উন্নয়ন কর্মকা- ত্বরান্বিত করা হোক।
অনিয়মতান্ত্রিকভাবে পদ দখল করে দায়িত্ব পালনের কারণে ৩৩ কর্মকর্তাকে চলতি দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়ার কথা জানিয়ে বিভাগীয় কমিশনার ও সিটি করপোরেশনের প্রশাসক মো. মোখতার আহমেদ বলেন, আগের যে মেয়র ছিলেন, তিনি ওই কর্মকর্তাদের চলতি দায়িত্ব দিয়ে রেখেছিলেন। চলতি দায়িত্ব দিতে গিয়ে দেখা গেছে একজন সহকারী প্রকৌশলীকে তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী করা হয়েছে। সহকারী প্রকৌশলীকে চলতি দায়িত্ব দিলে নেক্সট পদ হচ্ছে নির্বাহী প্রকৌশলী সেটাতে দেওয়ার কথা। নির্বাহী প্রকৌশলী দেওয়া হয়েছে তার কিছুদিন পর আবার তাকে তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ, একই ব্যক্তিকে চলতি দায়িত্বে করা হয়েছে নির্বাহী প্রকৌশলী, আবার কিছুদিন পর তাকেই করা হয়েছে তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী।
এটা নিয়মের ব্যত্যয়। পরিপত্রে বলা আছে, কাউকে যদি চলতি দায়িত্ব দিতে হয়, মেয়রের সভাপতিত্বে একটা মিটিং হবে, তারপর তাকে দায়িত্ব দেওয়া হবে; কিন্তু সেই দায়িত্ব ছয় মাসের বেশি নয়। আবার তাকে দায়িত্ব দিলে আবারও মিটিং হবে। কিন্তু এখানে যাদের চলতি দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল, তখন একবার মিটিং হয়েছে; এরপর তা আর হয়নি। এসব ব্যত্যয় থাকার কারণে যে যে পদে ছিলেন, তাকে সেই পদে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে। নিয়ম অনুযায়ী যিনি যে পদ পাওয়ার কথা, তিনি সেই পদেই যাবেন।