বিশ্ব রাজনীতির আলোচনায় যখন ইউক্রেন, গাজা যুদ্ধ, ইন্দো-প্যাসিফিক উত্তেজনা কিংবা যুক্তরাষ্ট্র-চীন দ্বন্দ্ব প্রাধান্য পায়, তখন অগোচরে ঘটে যাওয়া ভূরাজনৈতিক পরিবর্তনগুলো অনেক সময় চোখ এড়িয়ে যায়। অথচ বিশ্বশক্তির সংঘাতের পেছনে, মধ্য এশিয়া ও দক্ষিণ ককেশাস অঞ্চলে এক ভিন্নধর্মী রূপান্তর ঘটছে। এবং আশ্চর্যের বিষয় হলো, এই পরিবর্তনের নেতৃত্বে নেই মস্কো, বেইজিং কিংবা ওয়াশিংটন, এগিয়ে এসেছে আবুধাবি ও রিয়াদ।
সম্প্রতি বছরগুলোতে উপসাগরীয় দেশগুলো নিজেদের শুধু তেলনির্ভর অর্থনীতি হিসেবে সীমাবদ্ধ রাখেনি; তারা পরিণত হয়েছে বৈশ্বিক কৌশলগত খেলোয়াড়ে। তাদের নতুন ভূরাজনৈতিক ক্ষেত্র এখন ইউরেশিয়ার হৃদয়ভূমি, যে অঞ্চল যুগ যুগ ধরে সাম্রাজ্যবাদী প্রতিযোগিতা আর মহাশক্তির প্রভাবের মধ্যে বন্দি ছিল। অবকাঠামো নির্মাণে বিনিয়োগ, শান্তি আলোচনা আয়োজন এবং বাস্তববাদী অংশীদারিত্ব গড়ে তুলে সংযুক্ত আরব আমিরাত ও সৌদি আরব এই অঞ্চলে অপরিহার্য অংশীদার হয়ে উঠছে, যেখানে আগে আধিপত্য ছিল রাশিয়া, চীন কিংবা তুরস্কের।
এটি বিচ্ছিন্ন কোনো পদক্ষেপ নয়। উদাহরণ হিসেবে ধরা যায় কাজাখস্তান রেলওয়ে ও আমিরাতের এডি পোর্টস গ্রুপের যৌথ উদ্যোগ ‘গালফলিংক’ প্রকল্পকে। বাইরে থেকে এটি হয়তো কেবল আরেকটি বাণিজ্যিক চুক্তি মনে হবে। কিন্তু ভেতরে এটি মধ্য এশিয়ার জন্য কৌশলগত পুনর্নির্দেশনা, রাশিয়া বা চীনের ঐতিহ্যগত স্থলপথের বদলে অঞ্চলটি এখন দক্ষিণ দিকে উপসাগরীয় বন্দরগুলোর সঙ্গে সরাসরি যুক্ত হচ্ছে। একইভাবে, উজবেকিস্তান এ বছর উপসাগরীয় নাগরিকদের জন্য ভিসা মওকুফের যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তা কেবল পর্যটন বৃদ্ধির কৌশল নয়; বরং অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক একীভূতকরণের আহ্বান।
কূটনীতির ক্ষেত্রেও উপসাগরীয় দেশগুলো নতুন ভূমিকা নিচ্ছে। যখন আমিরাত আর্মেনিয়া ও আজারবাইজানের মধ্যে শান্তি আলোচনা আয়োজন করল, তখন তারা এমন এক ভূমিকায় অবতীর্ণ হলো যা ঐতিহাসিকভাবে রাশিয়ার ছিল। দশকজুড়ে দক্ষিণ ককেশাসে রাশিয়ার প্রভাব বলয় দৃঢ় ছিল সামরিক ঘাঁটি, জ্বালানি পাইপলাইন এবং নিরাপত্তা নিশ্চয়তার প্রতিশ্রুতির মাধ্যমে। কিন্তু নাগোর্নো-কারাবাখে নতুন করে সংঘাত ছড়িয়ে পড়া ও ইউক্রেনে ব্যস্ত হয়ে পড়ার ফলে মস্কোর প্রভাব দুর্বল হয়েছে। এই শূন্যস্থান পূরণে উপসাগরীয় রাষ্ট্রগুলো দ্রুত এগিয়ে এসেছে, তারা হুমকি বা চাপ নয়, অর্থনৈতিক সুবিধার ভিত্তিতে শান্তির প্রস্তাব দিয়েছে।
এই কৌশলটি ভিন্নধর্মী। যুক্তরাষ্ট্র যেখানে নিরাপত্তা সহায়তার সঙ্গে আদর্শিক বক্তৃতা মিশিয়ে দেয়, কিংবা চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড উদ্যোগ অনেক সময় নির্ভরতার ফাঁদ তৈরি করে, সেখানে উপসাগরীয় রাষ্ট্রগুলো ব্যবহার করছে বাস্তববাদী পারস্পরিকতার মডেল। তারা শাসনব্যবস্থা পরিবর্তন করতে চায় না, আদর্শ রপ্তানিও করে না। তারা বিনিয়োগ করে, অবকাঠামো গড়ে এবং স্থানীয় নেতাদের কঠোর জোটে আবদ্ধ না করেই সম্পর্ক তৈরি করে।
এই পরিবর্তন ঐতিহাসিকভাবে আরও তাৎপর্যপূর্ণ। মধ্য এশিয়া ও দক্ষিণ ককেশাস একসময় রুশ সাম্রাজ্য ও পরবর্তীতে সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে দৃঢ়ভাবে আবদ্ধ ছিল। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত পতনের পর অঞ্চলটি পায় জটিল সীমান্ত, ভঙ্গুর প্রতিষ্ঠান ও অনিরসনযোগ্য জাতিগত বিরোধ। রাশিয়া তখনো এসব দুর্বলতা কাজে লাগিয়ে প্রভাব ধরে রাখে, জ্বালানি, নিরাপত্তা চুক্তি ও আঞ্চলিক মধ্যস্থতাকারী ভূমিকায় থেকে।
কিন্তু গত দুই দশকে এই প্রভাব ধীরে ধীরে ক্ষয় হয়েছে। চীন অবকাঠামো ঋণের বন্যা বইয়ে দিয়ে প্রভাব বিস্তার করেছে বেল্ট অ্যান্ড রোড প্রকল্পের মাধ্যমে। তুরস্ক নরম শক্তি, ভাষাগত ও সাংস্কৃতিক বন্ধন কাজে লাগিয়ে ‘তুর্কি বিশ্ব’ ধারণা ছড়িয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র মাঝে মাঝে প্রবেশ করেছে, মূলত ৯/১১-পরবর্তী সন্ত্রাসবাদবিরোধী নীতির কারণে।
এই ভিড় জমা অঙ্গনে উপসাগরীয় রাষ্ট্রগুলো এসেছে ভিন্ন প্রস্তাব নিয়ে, পূর্বতন সাম্রাজ্যিক উত্তরাধিকার বা আদর্শগত শর্ত ছাড়াই অংশীদারিত্বের মডেল। আর এই নিরপেক্ষতাই তাদের বাড়তি সুবিধা দিয়েছে। তারা সরাসরি রাশিয়া বা চীনের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে না; বরং স্থানীয় দেশগুলো (কাজাখস্তান, উজবেকিস্তান, আর্মেনিয়া, আজারবাইজান) কে সুযোগ দিচ্ছে বহুমুখী কূটনৈতিক বিকল্প বেছে নেওয়ার।
উপসাগরীয় হস্তক্ষেপের বিশেষ গুরুত্ব হলো এর অ-আক্রমণাত্মক সংঘাত ব্যবস্থাপনা। দক্ষিণ ককেশাসের দিকেই তাকালে দেখা যায়, রাশিয়ার সুরক্ষা প্রতিশ্রুতির ওপর নির্ভরশীল আর্মেনিয়া শেষ পর্যন্ত দেখতে পেল, আজারবাইজান তুরস্কের সহায়তায় নাগোর্নো-কারাবাখ পুনর্দখল করেছে। মস্কোর নিরাপত্তা নিশ্চয়তার বিশ্বাসযোগ্যতা ভেঙে পড়ে। তখন আমিরাত এগিয়ে এলো, সৈন্য পাঠিয়ে নয়, হুমকি দিয়ে নয়, বরং নিরপেক্ষ আলোচনার ক্ষেত্র আর অর্থনৈতিক শান্তির প্রস্তাব নিয়ে।
এ মডেল উপসাগরীয় অঞ্চলের নিজস্ব শান্তি প্রচেষ্টার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। সৌদি-ইরান সম্পর্কের পুনর্মিলন চীনের মধ্যস্থতায় হলেও বছরের পর বছর নীরব উপসাগরীয় কূটনীতি সেটির ভিত্তি তৈরি করেছিল। একইভাবে, ইয়েমেনের শান্তি প্রক্রিয়ায় আমিরাতের ভূমিকা প্রমাণ করেছে যে তিক্ত সংঘাতও অর্থনৈতিক প্রণোদনার মাধ্যমে প্রশমিত হতে পারে। এই মডেল যদি ইউরেশিয়ার জমাট বাঁধা সংঘাতে প্রয়োগ করা যায়, তবে নতুন স্থিতিশীলতার পথ উন্মুক্ত হতে পারে।
একই যুক্তি প্রযোজ্য মধ্য এশিয়ার অমীমাংসিত বিরোধগুলোর ক্ষেত্রেও। উজবেকিস্তান, কিরগিজস্তান ও তাজিকিস্তানকে ভাগ করা ফেরগানা উপত্যকা এখনো জাতিগত উত্তেজনা, সীমান্ত বিরোধ ও উগ্রপন্থার ঝুঁকিতে ভরপুর। উপসাগরীয় রাষ্ট্রগুলো সন্ত্রাসবিরোধী ও পুনর্বাসন কর্মসূচির অভিজ্ঞতা দিয়ে এখানে সহায়তা করতে পারে, জাতীয়তাবাদী স্পর্শকাতরতা উসকে না দিয়েই। তারা নিরাপত্তা সহযোগিতা জোরদার করার পাশাপাশি লজিস্টিকস ও বাণিজ্যে বিনিয়োগের মাধ্যমে অস্থিতিশীলতার মূল কারণেও হাত দিচ্ছে।
কেউ কেউ বলতে পারে, উপসাগরীয় দেশগুলো রাশিয়া বা চীনের বিকল্প হতে পারবে না। সত্যি, তাদের কাছে ইউরেশিয়া দখলের মতো কঠোর সামরিক ক্ষমতা নেই, রাশিয়ার মতো ঐতিহাসিক বন্ধনও নেই। কিন্তু আসল বিষয় সেটি নয়। উপসাগরীয় রাষ্ট্রগুলো মহাশক্তিকে সরাতে নয়, বরং প্রতিদ্বন্দ্বী প্রভাবকে ভারসাম্যপূর্ণ করতে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকায় এসেছে। এই ‘গতিশীল নিরপেক্ষতা’ তাদের এমনভাবে সক্রিয় হতে দেয় যে তারা রাশিয়া, চীন, তুরস্ক ও যুক্তরাষ্ট্র, সবার সঙ্গেই সম্পর্ক রাখতে পারে, কারো চোখে হুমকি না হয়েই।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, উপসাগরীয় বিনিয়োগ রাজনৈতিক শর্তহীন মূলধন নিয়ে আসে। পশ্চিমা সাহায্য যেখানে শাসন সংস্কারের দাবি তোলে, আর চীনা ঋণ অনেক সময় নির্ভরতার ফাঁদ তৈরি করে, সেখানে উপসাগরীয় বিনিয়োগকে তুলে ধরা হয় পারস্পরিক সুবিধাজনক চুক্তি হিসেবে। নতুন বন্দর, লজিস্টিকস হাব, জ্বালানি পাইপলাইন, এগুলো স্থানীয় জনগণের জন্য তাৎক্ষণিক সুবিধা তৈরি করে, ফলে উপসাগরীয় সম্পৃক্ততা রাজনৈতিকভাবে গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে।
এখান থেকে আরও বড় শিক্ষা মেলে, বিশ্বশক্তির প্রকৃতি বদলে যাচ্ছে। ২০ শতকে প্রভাব বিস্তার হতো সামরিক ঘাঁটি, আদর্শিক জোট বা জোরপূর্বক অর্থনৈতিক চাপের মাধ্যমে। ২১ শতকে, বিশেষত উপসাগরীয় মধ্যম শক্তিগুলোর জন্য, প্রভাব তৈরি হচ্ছে নরম কৌশলে, সংযোগ, পুঁজি ও বিশ্বাসযোগ্যতায়।
অবশ্য সীমাবদ্ধতাও আছে। উপসাগরীয় রাষ্ট্রগুলো সব সংঘাত সমাধান করতে পারবে না, আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা তীব্র হলে হয়তো চিরস্থায়ী নিরপেক্ষতা বজায় রাখা কঠিন হবে। কিন্তু তাদের উপস্থিতিই এখন কৌশলগত সমীকরণ বদলে দিচ্ছে। আর্মেনিয়ার জন্য, রাশিয়ার রক্ষার মায়া ভাঙলে আমিরাত একটি বিকল্প অংশীদার। কাজাখস্তানের জন্য, রুশ নিরাপত্তা দাবি ও চীনা অর্থনৈতিক নির্ভরতার মাঝামাঝি গালফ বিনিয়োগ একটি তৃতীয় বিকল্প। আজারবাইজানের জন্য, তুরস্কের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের পাশাপাশি উপসাগরীয় কূটনীতি নতুন কৌশলগত গভীরতা যোগ করছে।
বড় প্রভাব হলো, ইউরেশিয়ার ভূরাজনৈতিক মানচিত্র আর একরৈখিক নয়। এটি কেবল রাশিয়া বনাম পশ্চিম, বা চীন বনাম যুক্তরাষ্ট্র নয়। এখন এটি বহুমুখী, যেখানে ইউএই ও সৌদি আরবের মতো মধ্যম শক্তিগুলো বাণিজ্য পথ, শান্তি আলোচনা ও বাস্তববাদী জোটের মাধ্যমে নতুন রেখাচিত্র আঁকছে। বার্তাটি স্পষ্ট, উপসাগরীয় রাষ্ট্রগুলো আর কেবল বৈশ্বিক শৃঙ্খলার ভোক্তা নয়; তারা ধীরে ধীরে এর নির্মাতা হয়ে উঠছে।
লেখক : রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক।
আপনার মতামত লিখুন :