ক্লাস শেষ হয়েছে। একটু পরেই বাজবে ছুটির ঘণ্টা। কেউ কেউ মেতেছিল আড্ডায়। কেউ হয়তো অপেক্ষা করছিল কখন বাইরে গিয়ে মা-বাবাকে জড়িয়ে ধরে বলবে ‘স্কুলে আজ অনেক মজা হয়েছে’। কিন্তু হুট করে আকাশ থেকে যেন নেমে এলো আগুনের গোলা। বিকট শব্দ! এরপর নীবর, নিস্তব্ধ হাহাকার। নিভে গেল একে একে অনেক শিশু-শিক্ষার্থীর জীবন প্রদীপ। এ যেন এক হৃদয়বিদারক ঘটনা! স্কুল ছুটির আগেই জীবন থেকে ছুটি নিতে হলো তাদের। স্কুল ছুটি হয়েছে কিন্তু তারা ফিরবে না বাড়ি। উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ভবনে বিমান বাহিনীর যুদ্ধবিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় প্রতিমুহূর্তেই সামনে আসছে হৃদয়বিদারক সব দৃশ্য। যে শিশুটি প্রতিদিনই মা-বাবাকে বলত ‘আমি স্কুলে যাচ্ছি, টাটা বাই বাই।’ তার এই টাটা বাই বাই-ই যে, শেষ বিদায় হবে তা কে জানত?
রাজধানীর উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ভবনে বিধ্বস্ত হওয়া বিমানটি বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর এফটি-৭ বিজিআই যুদ্ধবিমান। নিয়মিত প্রশিক্ষণের অংশ হিসেবে সোমবার দুপুর ১টা ৬ মিনিটে ঢাকায় কুর্মিটোলা বিমানবাহিনী ঘাঁটি এ কে খন্দকার থেকে উড্ডয়নের পর বিমানটি যান্ত্রিক ত্রুটির সম্মুখীন হয়। দুপুর ১টা ১৮ মিনিটের দিকে বিমানটি বিধ্বস্ত হয়। জনবহুল এলাকায় প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনা এই প্রথম।
এই ঘটনা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, প্রশিক্ষণ কার্যক্রমে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিতে আরও কঠোর নীতিমালা ও বাস্তবায়ন প্রয়োজন। পাশাপাশি শহরের অভ্যন্তরে প্রশিক্ষণ কার্যক্রমের যৌক্তিকটাই বা কি? জনবসতি এলাকায় যুদ্ধ বিমানের প্রশিক্ষণ চালানো শুধু নিরাপত্তার ঝুঁকি নয়, এটি আন্তর্জাতিক নিয়ম, মানবিক দায়বদ্ধতা ও পরিবেশগত বিবেচনারও বড় ব্যত্যয়।
আমাদের দেশে যেকোনো দুর্ঘটনা ঘটলে উদ্ধার কর্মীদের সবচেয়ে বেশি বেগ পেতে হয় উৎসুক জনতাকে সরানোর জন্য। উত্তরার ঘটনায়ও তারই পুনরাবৃত্তি হয়েছে। অনেক সময় দুর্ঘটনার স্থলে সঠিক ব্যবস্থাপনার অভাবেই প্রাণহানি বাড়ে। আমাদের দেশে একটি আগুন লাগা, ভবন ধস বা বড় ধরনের কোনো দুর্ঘটনার পর সবচেয়ে বেশি যেটি চোখে পড়ে তা হলো, উদ্ধারকাজের সময় ঘিরে থাকা ভিড়। এই ভিড় কেবল কৌতূহলী জনতার নয়, এর মধ্যে থাকে স্থানীয় মানুষ, অসচেতন মিডিয়া, রাজনৈতিক কর্মী এবং সম্প্রতি যুক্ত হওয়া ইউটিউবার ও কনটেন্ট নির্মাতারা। একই রকম নাটকীয়ভাবে আহতদের দেখতে হাসপাতালে হয় ভিড়।
মাইলস্টোনের ঘটনায়ও একই নাটকের দৃশ্যায়ন ঘটেছে। দুর্ঘটনার স্থান, হাসপাতাল, সবখানে রাজনৈতিক নেতা ও উৎসুক মানুষের ভিড়। এ ধরনের পরিদর্শন ‘সহানুভূতি দেখানোর নামে হলেও, আমরা মনে করি এটি বাস্তবে দায়িত্বজ্ঞানহীন পদক্ষেপ।
একজন রাজনৈতিক নেতা বা সরকারের কোনো উচ্চপদের ব্যক্তি ঘটনাস্থলে গেলে তার সঙ্গে স্বাভাবিকভাবে অনুসারী, সাংবাদিক, নিরাপত্তাকর্মীসহ একটি বিশাল ভিড় তৈরি হয়, যা উদ্ধারকাজের জন্য সংকুচিত জায়গাকে আরও সংকুচিত করে তোলে। কাজটা জটিল থেকে জটিলতর হয়। প্রশ্ন হলো, তাদের সেই সময়ে সেখানে উপস্থিতি কি আদৌ প্রয়োজন? এই ধরনের দুর্ঘটনা নিয়ে রাজনীতি করা অত্যন্ত স্পর্শকাতর একটি বিষয়। যা কাম্য নয়।
জনসাধারণের নিরাপত্তা এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সুরক্ষার স্বার্থে এখনই সময় প্রশিক্ষণ এবং উড্ডয়ন নীতিমালায় প্রয়োজনীয় সংস্কার আনার। দুর্ঘটনা ঘটবে না, এমন নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারে না, কিন্তু সচেতনতা, সতর্কতা এবং নীতিগত কঠোরতা অনেক সম্ভাব্য বিপদ থেকে আমাদের বাঁচাতে পারে।
মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে যুদ্ধবিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় পুরো স্কুলটাই যেন পরিণত এক অজানা যুদ্ধক্ষেত্রে। যেখানে কেউ কারোর শত্রু ছিল না। প্রাণ গেল শিশুদের, যারা ঘরে ফেরার জন্য ব্যাগ গুছাচ্ছিল। কেউ মারা গেছে ঘটনাস্থল, কেউ হাসপাতালে। কেউ কেউ মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে।
আমরা প্রার্থনা করি, হাসপাতালে যারা আছে তাদের সবাই বেঁচে উঠুক। কিন্তু যারা বেঁচে থাকবে, তারা সবাই বাকি জীবনটা আতঙ্ক নিয়ে কাটাবে। শুধু কী আক্রান্ত ওই শিশুরাই এমন আতঙ্কঘোরে থাকবে? নাকি আজীবন আতঙ্কিত হয়ে দিন পার করবে মাইলস্টোনের যে অংশটি দুর্ঘটনায় পড়েনি, সেখানে দুর্ঘটনার সময় অবস্থান করা মানুষগুলো।
আমরা আশা করি, দেশের প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হোক নিরাপদ, আকস্মিক কোনো মৃত্যু সেখানে ভর না করুক। আমাদের ভুলে আর কোনো ফুল যেন অকালে ঝরে না পড়ুক।