বিগত সরকারের আমলে সরকারের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি বাংলাদেশ সরকারি কর্মকমিশন কে করা হয়েছিল চরম দলীয়করণ। আইন-কানুনের প্রতি তোয়াক্কা না করে বিধিবিধান অনুসরণ না করেই আওয়ামীপন্থি সরকারি কর্মকর্তাদেরই বসানো হতো পিএসসির সদস্য এবং চেয়ারম্যানের পদে। নিয়োগপ্রাপ্ত সেসব পিএসসির সদস্য এবং চেয়ারম্যান অর্থাৎ আওয়ামী গং সবসময় আওয়ামী লীগের পক্ষেই কাজ করে গেছে।
প্রশাসনসহ সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ছাত্রলীগের ক্যাডারদের নিয়োগ দেওয়ার উদ্দেশ্যে বিসিএসের ভাইভাতে ২০০ নাম্বারের সংযোজন করা হয়। এরপরও শিক্ষার্থী হিসেবে যারা অত্যন্ত নিম্নমানের ছাত্রলীগ নেতাকর্মী, যারা ক্যাডার সার্ভিসে আসতে পারে না তাদের সরকারি প্রতিষ্ঠানে ঢুকানোর জন্য তৈরি করা হয় বিসিএস থেকে নন-ক্যাডার নিয়োগ বিধিমালা-২০১০। আজ বলব কীভাবে পিএসসি আইন তৈরি করে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়াদোত্তীর্ণ ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের বিভিন্ন সরকারি দপ্তরে প্রবেশ করিয়েছে।
বিসিএস নন-ক্যাডার নিয়োগ বিধিমালা-২০১০-এর ৪(১) অনুযায়ী ‘কমিশন বিসিএস পরীক্ষার মাধ্যমে নিয়োগের জন্য প্রকাশিত বিজ্ঞপ্তিতে নন-ক্যাডার পদে নিয়োগের বিষয় কমিশনে সংশ্লিষ্ট পদের অনুরোধপত্র প্রাপ্তির তারিখের ক্রমানুসারে নন-ক্যাডার পদের বিবরণ ও সংখ্যা উল্লেখ করিবে’ মর্মে বলা হয় অর্থাৎ সরকারের নিকট থেকে শূন্য পদ পূরণের জন্য নিয়োগের অনুরোধপত্র প্রাপ্তির পরবর্তী বিসিএস বিজ্ঞপ্তিতে নন-ক্যাডার শূন্য পদের বিবরণী উল্লেখপূর্বক বিসিএস থেকে নন-ক্যাডার নিয়োগ দেওয়ার কথা বিধিমালাতে বলা হয়েছে।
পিএসসি যদি এ বিধিমালা অনুসরণ করে বিসিএস থেকে নন-ক্যাডার নিয়োগ দিত তাহলে হয়তো ছাত্রলীগের যেসব পরীক্ষার্থীর বয়স শেষ হয়ে যাচ্ছে তাদের চাকরি দেওয়া অনিশ্চয়তায় পড়ে যাচ্ছিল, তাই পিএসসি আইন-কানুনের খেয়াল না করে যখন যেমন ইচ্ছা নন-ক্যাডার নিয়োগ দিয়েছে। নন-ক্যাডার বিশেষ নিয়োগ বিধিমালা-২০১০ তৈরি হওয়ার পর ৩১, ৩২, ৩৩, ৩৪তম বিসিএস বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়, যেখানে বিসিএস নন-ক্যাডার নিয়োগ বিধিমালা-২০১০-এর ৪(১) অনুযায়ী কোনো বিবরণ ছিল না, তারপর ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের ঢুকানোর জন্য তাদের নন-ক্যাডার নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, অর্থাৎ একজন ছাত্রলীগের নেতাকে ক্যাডার সার্ভিসে ঢুকানোর সর্বশেষ চেষ্টার পরেও যখন সম্ভব হয় না, তখন তাকে নন-ক্যাডারে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। বিগত সরকারের নিয়োগপ্রাপ্ত দলকানা কর্মকর্তাদের দ্বারা পরিচালিত পিএসসি তার অপকর্ম ঢাকতে ২০১৪ সালে বিধিমালাতে সংযোজন করে এক স্বৈরশাসন নামা ‘২৮, ২৯, ৩০, ৩৩ ও ৩৪তম বিসিএসের বিজ্ঞপ্তিতে বিধি অনুযায়ী নন-ক্যাডার পদের বিবরণ উল্লেখ না থাকলেও সরকার কর্তৃক নন-ক্যাডার পদের সুনির্দিষ্ট পদের বিবরণ ও সংখ্যা উল্লেখক্রমে কমিশনকে অনুরোধ করা সাপেক্ষে এ বিধিমালার অধীন প্রদত্ত সুবিধাদি প্রযোজ্য হবে’ এই বিধি সংযোজন করে নিয়োগপ্রাপ্ত ছাত্রলীগ সদস্যদের জ্যেষ্ঠতা দেওয়ার পথ তৈরি করে। ব্যাপারটা এমন যে ‘কোনো পরীক্ষার্থী, কোনো পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেনি, পরবর্তী সময়ে এসে বলল আমি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করিনি তো কি হয়েছে, আপনারা মনে করেন আমি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেছি, যারা পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেছে, তাদের যে সুবিধা দেবেন আমাকেও সেই একই সুবিধা দিতে হবে’ এ ধরনের বিধি তৈরি করা আর সন্ত্রাস করা অভিন্ন নয়। কেননা, একটা বিধি লঙ্ঘন করে নিয়োগ আর এক বিধি সংযোজন করে তাদের জ্যেষ্ঠতা দেওয়ার পথ তৈরি করা।
এরপর ৩৫, ৩৬, ৩৭, ৩৮ ও ৪০তম বিসিএসের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়, যেখানে বিধি অনুযায়ী নন-ক্যাডার পদের সুনির্দিষ্ট বিবরণ উল্লেখ করা হয় না। অর্থাৎ, এসব বিসিএসের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের সময় পিএসসির কাছে কোনো নন-ক্যাডার শূন্য পদের চাহিদা ছিল না। অথচ এসব বিসিএস থেকে নন-ক্যাডার নিয়োগ দেওয়া হয়, পিএসসির কাছে শূন্য পদের চাহিদা না থাকলেও নিয়োগ দেওয়া হলো কীভাবে? বিষয়টি বোঝার স্বার্থে একটি বিসিএস নিয়ে আলাপ করা যাক, ৩৮তম বিসিএসের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত ২০.০৬.২০১৭ইং তারিখে, সেই বিজ্ঞপ্তিতে নন-ক্যাডার নিয়োগ (বিশেষ) বিধিমালা-২০১০-এর ৪(১) অনুযায়ী নন-ক্যাডার পদের সুনির্দিষ্ট বিবরণ ছিল না। ২০১৮, ২০১৯ সালে যেসব নন-ক্যাডার দপ্তর থেকে শূন্য পদ পূরণের চাহিদা প্রেরণ করা হয়, সেসব পদ পূরণের জন্য পিএসসির নিয়মিত নন-ক্যাডার নিয়োগের বিধিমালা অনুযায়ী স্বতন্ত্র উন্মুক্ত নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে, এরপর প্রিলি, রিটেন, ভাইভা সম্পন্ন করে নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে, এরপর সেসব চাকরি প্রার্থীরা সংশ্লিষ্ট দপ্তরে যোগ দেন।
এরপর ৩৮তম বিসিএসের ফলাফল ঘোষণা হয়, এরপর পিএসসি দেখল ছাত্রলীগের অনেক নেতাকর্মী চাকরি পায়নি, ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের অনুরোধে পিএসসি নিজে বিভিন্ন দপ্তর থেকে চাহিদা সংগ্রহ করে, কোন কোন দপ্তর সে ক্ষেত্রে চাহিদা প্রেরণ করে, তার পরিপ্রেক্ষিতে ৩৮তম বিসিএস থেকে নন-ক্যাডারে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের নিয়োগ দেওয়া হয়। কিন্তু ২০২০ সালে যে চাহিদা পিএসসি বিভিন্ন দপ্তর থেকে পেয়েছে, সেটার নিয়োগের জন্য বিধি অনুযায়ী পরবর্তী বিসিএস অর্থাৎ ৪১তম বিসিএস নেওয়ার কথা, সেটা না করে পিএসসি ৩৮তম বিসিএস থেকে নন-ক্যাডারে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের ঢুকিয়ে, একদিকে যেমন সংশ্লিষ্ট দপ্তরের উন্মুক্ত নিয়োগপ্রাপ্তদের সঙ্গে জ্যেষ্ঠতা নিয়ে জটিলতা সৃষ্টি করেছে, অন্যদিকে ৪১তম বিসিএসের পরীক্ষার্থীদের অধিকার বিনষ্ট করেছে।
তৎকালীন পিএসসি কর্মকর্তারা তাদের এ অপকর্ম ঢাকতে বিসিএস নন-ক্যাডার নিয়োগ বিধিমালা-২০১০-এর সংশোধন করে বিসিএস নন-ক্যাডার নিয়োগ বিধিমালা-২০২৩ তৈরি করে যেখানে ৪(১) এ বলা হয়- কমিশন, সরকারের কাছ থেকে ক্যাডার পদের সহিত নন-ক্যাডার শূন্য পদে নিয়োগের অনুরোধ প্রাপ্তি সাপেক্ষে বিসিএস পরীক্ষার মাধ্যমে নিয়োগের জন্য প্রকাশিত বিজ্ঞপ্তিতে পুরণযোগ্য নন-ক্যাডার শূন্য পদের বিবরণী ও সংখ্যা প্রকাশ করবে’ মর্মে উল্লেখ করা হয়। একই বিধিমালা ৪(৩) এ বলা হয় ‘ উপ-বিধি ৪(১) এ যা কিছুই থাকুক না কেন এই বিধিমালা কার্যকর হওয়ার আগে নন-ক্যাডার পদে নিয়োগের জন্য অপেক্ষমাণ যেসব বিসিএস পরীক্ষার জন্য প্রকাশিত বিজ্ঞপ্তিতে সুপারিশের বিষয় উল্লেখ ছিল, কিন্ত নন-ক্যাডার পদের সুনির্দিষ্ট বিবরণ ও সংখ্যা উল্লেখ ছিল না, সে ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ প্রার্থীদের ক্ষেত্রে সরকার কর্তৃক বিসিএস’ওয়ারী নন-ক্যাডার পদের সুনির্দিষ্ট বিবরণ ও সংখ্যা উল্লেখক্রমে কমিশন কে অনুরোধ করা সাপেক্ষে এ বিধিমালার অধীন প্রদত্ত সুবিধাদি প্রযোজ্য হবে’ মর্মে উল্লেখ করা হয়। অর্থাৎ ৪(১) বিধিমালাতে পদের বিবরণ দেওয়ার বাধ্যবাধকতা থাকলেও পিএসসি নিজেদের বিধি লঙ্ঘনের বিষয়টি প্রতিষ্ঠিত করতে পদের বিবরণ দেওয়া এবং পদের বিবরণ না দেওয়া এক করে ফেলেছেন, ব্যাপারটা চরম হাস্যকর, পিএসসি কি আইনের ঊর্ধ্বে কোনো প্রতিষ্ঠান যার কোনো আইন কানুন, বিধিবিধান মানার প্রয়োজন নেই? পিএসসির নন-ক্যাডারের এই স্বৈরশাসনতন্ত্রের অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে এক ভয়ংকর তথ্য; বিসিএস নন-ক্যাডার (বিশেষ) নিয়োগ বিধিমালা-২০১০, ২০১৪-এর সংশোধনী এবং বিসিএস নন-ক্যাডার (বিশেষ) নিয়োগ বিধিমালা-২০২৩-এর বিধি ৪(১) অনুযায়ী অর্থাৎ সরকারি দপ্তর/অধিদপ্তর থেকে শূন্য পদের চাহিদা প্রাপ্তির পর পরবর্তী বিসিএস থেকে সংশ্লিষ্ট নন-ক্যাডার পদের বিবরণ উল্লেখ করে সংশ্লিষ্ট বিসিএস থেকে নিয়োগ দেওয়ার কথা থাকলেও নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে আগের বিসিএস থেকে যাদের ভাইভায় ২০০ নাম্বার দিয়ে পুশ করে এগিয়ে নিয়ে আসা হয়েছে এমন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়াদোত্তীর্ণ ছাত্রলীগের ক্যাডারদের স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি), শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর, স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর, সমাজসেবা অধিদপ্তর, পরিসংখ্যান বিভাগসহ সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, ৪(৩) বিধি তৈরি করে সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কর্মকর্তাদের ওপরে জ্যেষ্ঠতা দেওয়ার পথ তৈরি করেছে, এমনকি পিএসসির আওয়ামী চাটুকারিতা এমন পর্যায়ে ছিল, প্রকৌশল বিষয়ে পরীক্ষায় পাস পর্যন্ত করেনি এমন বুয়েট, চুয়েট, কুয়েট, রুয়েট এবং ডুয়েট ছাত্রলীগের পরীক্ষার্থীদের এলজিইডি, শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর, স্বাস্থ্য প্রকৌশলসহ বিভিন্ন প্রকৌশল দপ্তরের সহকারী প্রকৌশলী হিসেবে সুপারিশ করেছে। যিনি প্রকৌশল বিষয়ে পরীক্ষায় পাস করেননি, তিনি কীভাবে প্রকৌশল দপ্তর পরিচালনা করবেন, সেই বিষয়টি প্রশ্নবিদ্ধ আর সেটা কতটা আইনসিদ্ধ? যার প্রকৌশল বিষয়ে পরীক্ষায় ন্যূনতম পাস করার জ্ঞান নেই, সে কীভাবে মানুষকে প্রকৌশল সেবা দেবে? অবশ্য এর পুরস্কারস্বরূপ তৎকালীন পিএসসি চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ সাদিক ২০২৪ সালের আওয়ামী লীগের পাতানো নির্বাচনে সুনামগঞ্জ-৪ আসন থেকে আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন পেয়ে সংসদ সদস্য বনে গেছিলেন। কিন্তু সেসব আওয়ামী সাংসদ এবং ড. মোহাম্মদ সাদিকের মতো আওয়ামীপন্থি সরকারি আমলারা পালিয়ে গেলেও নিয়োগপ্রাপ্ত এসব ছাত্রলীগের ক্যাডাররা বিভিন্ন দপ্তরে তা-ব চালাচ্ছেন, আপা কবে আসবেন, সেই গ্রাউন্ড প্রস্তুত করছেন, অনিয়মের রাজত্ব কায়েম করে যাচ্ছেন। পিএসসির পুশ প্রাইজ প্রাপ্ত যেসব আপার সৈনিকরা ৪ আগস্ট মুখে কালো কাপড় বেঁধে আপার প্রতি সমর্থনের পাশাপাশি, যেকোনো পর্যায়ে আপা ও দলের জন্য জীবন উৎসর্গের শপথ পাঠ করে, যা সরকারি চাকরির সুস্পষ্ট লঙ্ঘন, এখন ও বীরদর্পে তারা সচিবালয় চষে বেড়াচ্ছেন। এ জন্যই কি জুলাইয়ে দুই হাজারের অধিক ছাত্র-জনতা, দিনমজুর প্রাণ দিয়েছিলেন?
আপনার মতামত লিখুন :