২০২৪ সালের জুলাই মাস বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে। আপাতদৃষ্টিতে কোটা সংস্কার নিয়ে শুরু হওয়া ছাত্র আন্দোলন ধীরে ধীরে রূপ নেয় দেশের স্বৈর-শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে এক সর্বব্যাপী গণজাগরণে। অবশেষে ৩৬ জুলাই (৫ আগস্ট), আয়রন লেডি খ্যাত শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের দীর্ঘ ১৫ বছরের শাসনের অবসান ঘটে এবং তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশত্যাগ করেন।
এই আন্দোলনের সূচনা হয় সরকারি চাকরিতে নিয়োগে বিদ্যমান কোটা ব্যবস্থা সংস্কারের দাবিকে ঘিরে, যেখানে মেধা ও সাম্যের ভিত্তিতে চাকরির সুযোগ নিশ্চিত করার দাবি তোলে শিক্ষার্থীরা। কিন্তু সরকারের অব্যাহত অগ্রাহ্যতা, ছাত্রদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে বারবার পুলিশি দমন, নির্যাতন ও গ্রেপ্তারের মাধ্যমে বিষয়টি দ্রুতই বিস্তৃত রাজনৈতিক আন্দোলনে রূপ নেয়।
আন্দোলন চলাকালে একাধিক শিক্ষাার্থীকে গুলি করে হত্যা, ছাত্রদের ওপর নির্যাতন, গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ ও ইন্টারনেট বন্ধ করার সিদ্ধান্ত সাধারণ জনগণকে আরও ক্ষুব্ধ করে তোলে। শুধু রাজধানী নয়, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, বরিশালসহ সারা দেশে ছাত্র-জনতা একযোগে রাস্তায় নামে। পক্ষে-বিপক্ষে মত থাকলেও এটি অস্বীকার করার উপায় নেই, এই আন্দোলন স্বতঃস্ফূর্ত, অরাজনৈতিক এবং তৃণমূল-নির্ভর ছিল।
তৎকালীন সরকার প্রধান শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে বহুদিন ধরেই দলীয়করণ, বিচারবিভাগে হস্তক্ষেপ, একদলীয় শাসন কায়েম, বিরোধীদের দমন-পীড়ন, গুম-খুন, মিডিয়া নিয়ন্ত্রণ এবং নির্বাচন ব্যবস্থাকে প্রহসনে রূপান্তরিত করার অভিযোগ ছিল। ২০২৪ সালের জুলাই মাসে এসব অভিযোগের বাস্তব প্রমাণ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ক্ষমতার বাইরে থাকা বিরোধী দলগুলো নিষ্ক্রিয় থাকলেও, তরুণ সমাজ এবং সাধারণ শিক্ষার্থীরাই কার্যত রাজপথে নেতৃত্ব নেয়।
জুলাইয়ের শেষ দিকে সরকারি নিয়ন্ত্রণ যখন ভেঙে পড়ে এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একাংশ আন্দোলনকারীদের পক্ষে অবস্থান নেয়, তখনই সরকারের পতন অনিবার্য হয়ে ওঠে। যার ফলে শেখ হাসিনার মতো পাওয়ারফুল সরকারও পদত্যাগ করে একটি বিশেষ বিমানে দিল্লি পাড়ি জমাতে বাধ্য হয়।
এটি নিছক একটি সরকারের পতন নয়। এটি একটি শাসনব্যবস্থার পরিসমাপ্তি, যেখানে গণতন্ত্রের পরিবর্তে স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। জুলাই অভ্যুথান তাই কেবল একটি রাজনৈতিক মাইলফলক নয়, এটি বাংলাদেশের নতুন প্রজন্মের গণতান্ত্রিক চেতনার প্রতীক।
এই আন্দোলনের প্রাণ ছিলেন বাংলাদেশের আপামর ছাত্র-জনতা। তাই ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশনায় তাদের ভূমিকা আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। আমাদের দায়িত্ব হবে, এই প্রজন্মের আত্মত্যাগ ও নেতৃত্বকে সম্মান জানিয়ে একটি সংবেদনশীল, মানবিক ও ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্র গড়ে তোলা।
জুলাই অভ্যুথান আমাদের মনে করিয়ে দেয়, যে রাষ্ট্রের শাসনব্যবস্থা তার তরুণদের চেতনা দমন করতে চায়, সে রাষ্ট্র নিজেই একদিন ভেঙে পড়ে।
বাংলাদেশের ইতিহাসে ২০২৪ সালের জুলাই অভ্যুথান এক নতুন বাঁক রচনা করেছে। দেশের ছাত্র-জনতা যে সাহসিকতা, সংহতি ও আত্মত্যাগের মাধ্যমে একটি প্রায়-অসাধ্য কাজ সম্পন্ন করেছে, তা যুগান্তকারী। এই অভ্যুথান তাই এখন শুধুই একটি আন্দোলন নয়, এটি একটি চেতনার নাম, অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে ন্যায়ের জন্য লড়াইয়ের প্রতীক।
জুলাই অভ্যুথান আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়েছে, রাষ্ট্রযন্ত্র যখন ভেঙে পড়ে, জনগণের আস্থা যখন চূড়ান্তভাবে বিনষ্ট হয়, তখন আর কোনো ক্ষমতার বলয় কাজ করে না। শেখ হাসিনার প্রস্থান একদিকে ইতিহাসের অবসান, অন্যদিকে নতুন ইতিহাস রচনার সূচনা।
অভ্যুথানের এক বছর পার হয়েছে। এই এক বছরে একাধিক বিচ্ছিন্ন ঘটনা প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির ঘরকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
তবে আমাদের থেমে গেলে চলবে না। ২০২৪-এর জুলাই চেতনা কেবল একটি সরকারের পতনের চেতনা নয়; এটি একটি নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতি গঠনের ডাক। যেখানে থাকবে না দলীয়করণে প্রশাসন, বিচার বিভাগের নিয়ন্ত্রণ, ভোট ডাকাতি কিংবা গুম-খুনের রাজনীতি।
আমরা মনে করি, জুলাই অভ্যুথান ইতিহাসের একটি গৌরবময় অধ্যায় হয়ে থাকবে নানা কারণে। যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য প্রেরণার উৎস। যে প্রেরণা বলবে ‘অন্যায় যতই শক্তিশালী হোক না কেন, সংগঠিত জনতার শক্তির কাছে তা চূড়ান্তভাবে পরাজিত।’
একটি নতুন, ন্যায়ভিত্তিক, গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের বিনির্মাণে তাই আমাদের জুলাই চেতনাকে বুকে ধারণ করে উজ্জীবিত রাখতেই হবে।
আপনার মতামত লিখুন :