ঢাকা মঙ্গলবার, ০৫ আগস্ট, ২০২৫

জুলাই গণঅভ্যুত্থান:

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে জনতার বজ্রকণ্ঠ

জুয়েল হাসান
প্রকাশিত: আগস্ট ৪, ২০২৫, ১১:১৯ পিএম

পৃথিবী যখন নীরব, তখনো কিছু মানুষ চিৎকার করে পৃথিবীকে জাগিয়ে তোলে। এই কথাটি যেন বাস্তবায়িত হলো ২০২৪ সালের জুলাই মাসে, যখন বাংলাদেশের হৃদয় থেকে এক বিপ্লবী স্রোত বইতে শুরু করল। মেঘলা আকাশের নিচে নীরব শান্তি ভেঙে গেল বিক্ষোভের উত্তাল ঢেউয়ে। গলার স্বরে, পায়ের তলে উঠে এলো সেই বেদনাদায়ক যন্ত্রণার ইতিহাস, সামাজিক অবিচারের বিরুদ্ধে মানুষ যখন এক হয়ে দাঁড়ালো-তখনই শুরু হলো গণঅভ্যুত্থানের গাথা।


বাংলাদেশ, যেখান থেকে একসময় স্বাধীনতার ডাক গেঁথে দিয়েছিল, সেখানে আবারও ঘুরে দেখা হলো গণমানুষের রণতা-ব। আর সেই রণতা-ব শুধু একটি সময়ের প্রতিবাদ নয়, এটি ছিল এক নতুন প্রত্যয়ের সূচনা, এক নতুন ইতিহাসের রচনা। গণঅভ্যুত্থান একটি শব্দ নয়, বরং এটি জনজীবনের, মানুষের অধিকার আর সামাজিক ন্যায়ের জন্য লেখা এক গানে।


বিপ্লব কখনোই চুপচাপ আসে না। সে আসে মানুষের হৃদয়ে আগুন জ্বালিয়ে, তাদের পদধ্বনি হয়ে বুকে গর্জন করে ওঠে। ২০২৪ সালের জুলাইয়ের সেই গণঅভ্যুত্থানও ঠিক তেমনই এক আগুনের ঢেউ, যা বাংলাদেশকে পুরোপুরি অচেতন থেকে জাগ্রত করে তুলেছিল। একটি দেশের জনমানুষ যখন দীর্ঘদিন ধরে অবিচার, দমন-পীড়ন, অর্থনৈতিক ও সামাজিক বৈষম্যের শিকল বেঁধে রাখতে দেখা যায়, তখনই তাদের বুকে আগুন জ্বলতে শুরু করে। যা অবশেষে বাহিরে এসে এক মহা স্রোতের মতো বইতে বাধ্য হয়।


বাংলাদেশের ইতিহাসে গণঅভ্যুত্থানের ঘটনা নতুন নয়, তবে ২০২৪ সালের জুলাইয়ে সংঘটিত গণঅভ্যুত্থান ছিল একটি সময়ের গ-ি ছাড়িয়ে যাওয়া সংগ্রাম, যেখানে মানুষ এককাতারে এসে নিজের মৌলিক অধিকার ও মর্যাদার দাবি জানায়। এই আন্দোলন ছিল শুধু রাজনৈতিক রণভূমির যুদ্ধে নামা নয়, বরং এটি ছিল মানুষের মানবিক অস্তিত্ব ও সম্মানের জন্য এক অস্ত্রোপচারের মতো।
দেশের সর্বস্তরের মানুষ, কৃষক, শ্রমিক, শিক্ষার্থী, ব্যবসায়ী, নাগরিক, সবাই একযোগে তাদের দুর্দশার শেকল ভাঙার সংকল্প নিয়ে রাস্তায় নেমেছিল। বছরের পর বছর দীর্ঘায়িত হতাশা, অভাব, সুযোগের অভাব, এবং সরকারি অবহেলার বিরুদ্ধে তারা এবার নিজেই মুখ খুলে দাঁড়িয়েছিল। যুবসমাজ, যারা ছিল দেশটির ভবিষ্যৎ, তারা সবচেয়ে বেশি অংশগ্রহণ করেছিল এই আন্দোলনে। কারণ তাদের হাতে ছিল দেশের ভবিষ্যতের দায়িত্ব, তাদের সামনে ছিল অজানা অনিশ্চয়তার আর্তনাদ।


এই গণঅভ্যুত্থানের পেছনে লুকিয়ে ছিল বছরের পর বছর জমে থাকা অসংখ্য গল্প গণতান্ত্রিক অধিকার হারানোর বেদনাদায়ক বাস্তবতা, দারিদ্র্য ও বৈষম্যের প্রতি বিদ্রোহ, সরকারি দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের বিরুদ্ধে জনগণের ক্ষুব্ধ প্রতিবাদ। একদিকে যখন বিশ্বের অনেক দেশ উন্নতির পথে এগিয়ে যাচ্ছিল, বাংলাদেশের দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত জনগণ তাদের মৌলিক চাহিদা পর্যন্ত পেতে ব্যর্থ হচ্ছিল, তখন এই নীরব ক্রন্দন ঘরে বাইরে এসে এক মহা বিপ্লবে রূপ নেয়।


গণঅভ্যুত্থান একটি প্রমাণ ছিল যে, কোনো নির্যাতন, অবিচার, কিংবা দমন-পীড়ন দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে না। জনতার ভেতরে লুকানো শক্তি কখনোই নিঃস্বার্থ নয়, বরং তা সময় আসলে সমাজের কংক্রিট ভেঙে নতুন ভবনের ভিত্তি গড়ে দেয়। এই আন্দোলন ছিল এক নবজাগরণের সুর, যেখানে প্রত্যেক মানুষের মুক্তি, সমতা ও ন্যায়ের স্বপ্ন ফুটে উঠেছে।


সাহিত্য ও সংস্কৃতির ভাষায় এই গণঅভ্যুত্থান ছিল এক বিপ্লবের কবিতা, এক ক্রান্তিকালের গল্প, যেখানে জনগণ ছিল কবি, গল্পকার, আর স্রষ্টা। রাস্তায় গেয়ে উঠলো মানুষের মন থেকে উঠা স্লোগান, যা ছিল এক কথায় ‘আমরা বঞ্চিত নই, আমরা অধিকার চাই।’ এই শব্দগুলো ছিল এক নতুন দিনের আহ্বান, যেখানে প্রত্যেক বাংলাদেশি নিজের মর্যাদা ফিরে পাবে।


২০২৪ সালের এই জুলাই গণঅভ্যুত্থান বাংলাদেশের জাতীয় ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে, যা শুধু বর্তমান প্রজন্মের জন্য নয়, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্যও একটি অবিস্মরণীয় শিক্ষা ও প্রেরণার উৎস। এটি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়, যে গণতন্ত্র কোনো পণ্য নয়, বরং একটি জীবন্ত প্রক্রিয়া, যা সবার অংশগ্রহণ ও দায়িত্ববোধের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয়।


এই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে দেশের নাগরিকেরা নতুন করে উপলব্ধি করল স্বাধীনতা শুধু সীমানার জন্য নয়, বরং প্রতিটি মানুষের জীবনে সঠিক, ন্যায়সঙ্গত ও মর্যাদাপূর্ণ জীবনযাপনের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য। আর এ কারণেই ২০২৪ সালের জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থান শুধু এক রাজনৈতিক ঘটনা নয়, এটি ছিল এক মানবতাবোধের উন্মেষ, এক নতুন বাংলাদেশের স্বপ্নের সূচনা।


বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক ইতিহাস দেখলে বোঝা যায়, গণঅভ্যুত্থান এখানে নতুন কিছু নয়। স্বাধীনতার পর থেকে বিভিন্ন সময়ে জনজীবনে চলেছে নানা আন্দোলন, স্বৈরাচারবিরোধী সংগ্রাম, এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্নের লড়াই। কিন্তু ২০২৪ সালের জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থান তার আগে যা ঘটেছে তার থেকে ভিন্ন ছিল।


বিগত কয়েক বছরে দেশে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, অর্থনৈতিক সংকট, দুর্নীতি, সামাজিক বৈষম্য ও নাগরিক অধিকার লঙ্ঘনের কারণে সাধারণ মানুষের অসন্তোষ সঞ্চিত হচ্ছিল। বিশেষ করে তরুণ সমাজের মধ্যে বেকারত্ব, শিক্ষার সংকট ও জীবনের অনিশ্চয়তা মারাত্মক রূপ নিয়েছিল। এই সব বঞ্চনা আর অবিচারের বিরুদ্ধে মানুষের চরম অসন্তোষ এককাতারে এসে মিলিত হলো, গড়ে উঠলো এক ভীষণ উত্তাল জনআন্দোলন।


গণঅভ্যুত্থান ছিল কেবল রাজনৈতিক সংকটের প্রতিবাদ নয়, এটি ছিল সামাজিক ন্যায়ের দাবি, অর্থনৈতিক সুযোগ-সুবিধার সমতা, ও মানুষের মৌলিক অধিকার রক্ষার লড়াই। সামান্য কয়েক দিনের মধ্যেই এটি একটি সামগ্রিক সামাজিক আন্দোলনে রূপ নিল, যেখানে শ্রমিক, ছাত্র, কৃষক, সাধারণ মানুষ, সর্বস্তরের মানুষ ঐক্যবদ্ধভাবে অংশগ্রহণ করল।


গণঅভ্যুত্থান শুধু রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ বা হরতালের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। এটি ছিল এক সাংস্কৃতিক বিপ্লব, যেখানে কবিতা, গান, চিত্রকলা, নাটক, এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেশের প্রত্যন্ত থেকে শহরের প্রান্তরে ছড়িয়ে পড়ল মানুষের অনুভূতি।


কবি ও সাহিত্যিকরা এই আন্দোলনের বেদনায় রক্তিম করে তুলল ভাষাকে। একুশের ফেব্রুয়ারির ভাষা আন্দোলনের মতো, ২০২৪ সালের জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থানও হয়ে উঠলো সাহিত্যের ভাষায় বর্ণিত এক সংগ্রামের গল্প। মানুষের আবেগের ঢেউয়ে ভেসে উঠলো নতুন নতুন কবিতা, গান, ও বর্ণনা, যা পরবর্তী প্রজন্মের জন্য রেখে গেল এক ঐতিহাসিক স্মারক।


গণঅভ্যুত্থানের ভাষা ছিল সরল অথচ গভীর। ‘ন্যায় চাই, স্বাধীনতা চাই, জাগো বাংলাদেশ দরিদ্রতা নয়, অধিকার চাই, আমাদের ভবিষ্যৎ আমাদের হাতে এসব স্লোগান ও বক্তব্য ছিল মানুষের হৃদয়ের গভীর থেকে ওঠা।


সরকার, যিনি গণঅভ্যুত্থানের সময় ক্ষমতাসীন ছিলেন, শুরুতে এই আন্দোলনকে ছোট করে দেখার চেষ্টা করেছিল। কিছু ক্ষেত্রে কড়া নিরাপত্তা বাহিনীর প্রয়োগও দেখা গিয়েছিল, যা জনগণের ক্ষোভকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছিল। কিন্তু গণঅভ্যুত্থানের চাপ এতটাই ব্যাপক ও সংগঠিত ছিল যে সরকার অবশেষে কথোপকথনের মাধ্যমে সমস্যাগুলো সমাধানের পথ খুঁজতে বাধ্য হলো।
গণমাধ্যম ও আন্তর্জাতিক সমাজও এই আন্দোলনের পক্ষে সচেতনতা তৈরিতে ভূমিকা পালন করল। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও বুদ্ধিজীবী এই আন্দোলনের প্রতি সহমর্মিতা প্রকাশ করলেও, সমাজের মধ্যে কিছু বিভাজনও দেখা গিয়েছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও, এই গণঅভ্যুত্থান বাংলাদেশে গণতন্ত্রের পুনর্প্রতিষ্ঠা ও সামাজিক ন্যায়ের দাবির প্রতীক হয়ে উঠেছিল।

২০২৪ সালের জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থান, যদিও কঠিন সংগ্রাম ও আঘাতের মধ্য দিয়ে গিয়েছে, তার প্রতিফলন বাংলাদেশকে নতুন দিশা দেখিয়েছে। এই আন্দোলনের ফলে সরকারকে গণতান্ত্রিক সংস্কার আনতে বাধ্য করা সম্ভব হয়েছে। অর্থনৈতিক নীতি, সামাজিক নিরাপত্তা, নাগরিক অধিকার এবং সরকারের জবাবদিহিতা সব ক্ষেত্রে পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা স্পষ্ট হয়েছে।
তা ছাড়া, এই গণঅভ্যুত্থান বাংলাদেশের নতুন প্রজন্মকে রাজনৈতিক সচেতনতা ও সক্রিয় অংশগ্রহণের গুরুত্ব শিক্ষা দিয়েছে। এক সময়ের নীরব যুবসমাজ আজকে হয়ে উঠেছে সামাজিক পরিবর্তনের শক্তি। দেশের দূরপ্রান্তের গ্রাম থেকে শহরের কোনায়, সবাই মিলেমিশে এক হয়ে দাঁড়িয়েছে অধিকার প্রতিষ্ঠার যুদ্ধে।


প্রত্যেক অন্ধকার রাতের শেষে একটি নতুন সকাল আসে, বাংলাদেশের জন্য ২০২৪ সালের জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থান ছিল সেই অন্ধকার রাত, যেখানে হাজারো মানুষের রক্ত আর স্বপ্ন মিশিয়ে গড়া এক নতুন সূর্যের প্রথম কিরণ দেখা দিয়েছে। যদিও পথ কঠিন, ঝড় বৃষ্টি অগণিত, কিন্তু সেই জনতার প্রত্যয়ের শিখা একদিন নিশ্চিত করে উঠবে দেশের মাটিতে শান্তি, সুবিচার ও সমৃদ্ধি।


গণঅভ্যুত্থান আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় গণতন্ত্র কেবল ভোটকেন্দ্রিক নয়, এটি হলো জনমানুষের জীবনের প্রতি শ্রদ্ধা ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার নাম। দেশের প্রতিটি মানুষ যার স্বাধীনতা ও সমতার অধিকার, তার জীবনের মর্যাদা যেন অক্ষুণœ থাকে এটাই আসল গণতন্ত্রের ভিত্তি।


বাংলাদেশের এই গণঅভ্যুত্থান শুধু অতীতের স্মৃতি নয়, এটি এক নতুন ইতিহাসের সূচনা, যেখানে প্রত্যেক মানুষ হবে সমান, থাকবে ন্যায়বিচার ও মানবতার জয়গান। সেই চিরন্তন স্বপ্নের পথে এক নতুন অধ্যায়ের শুরু, যার ভিত্তি ২০২৪ সালের জুলাইয়ের জনঅবিস্মরণীয় গণঅভ্যুত্থান।