উত্তর কোরিয়া আবারও আন্তর্জাতিক কূটনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে। ডোনাল্ড ট্রাম্প দ্বিতীয় মেয়াদে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই পিয়ংইয়ং থেকে এক গুরুত্বপূর্ণ বার্তা আসে। দেশটির সর্বোচ্চ নেতা কিম জং উনের বোন কিম ইয়ো জং ঘোষণা দেন, যুক্তরাষ্ট্র যদি উত্তর কোরিয়াকে একটি পারমাণবিক শক্তিধর রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়, তবে তাদের সঙ্গে আলোচনার পথ খোলা থাকতে পারে। এমন বক্তব্য নতুন নয়, তবে সময় ও প্রেক্ষাপট বলছে, এবার তা আরও বেশি কৌশলগত, পরিকল্পিত এবং গভীর বার্তা বহন করছে।
দীর্ঘদিন ধরে উত্তর কোরিয়া তাদের পারমাণবিক কর্মসূচিকে আত্মরক্ষামূলক ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার প্রধান অবলম্বন হিসেবে তুলে ধরছে। তারা মনে করে, এই অস্ত্র ভান্ডার তাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার একমাত্র গ্যারান্টি। দেশটির দৃষ্টিতে যুক্তরাষ্ট্র ও দক্ষিণ কোরিয়া মিলে যে সামরিক ও কূটনৈতিক চাপ তৈরি করেছে, তাতে পরমাণু অস্ত্রই একমাত্র ভারসাম্য রক্ষার উপায়।
১৯৯০-এর দশকের ‘অৎফঁড়ঁং গধৎপয’ দুর্ভিক্ষ, অর্থনৈতিক পতন ও আন্তর্জাতিক নিঃসঙ্গতার ভয়াবহ অভিজ্ঞতা উত্তর কোরিয়ার কৌশলগত চেতনায় গভীর প্রভাব ফেলেছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ১৯৫৩ সাল থেকে আজ পর্যন্ত চলমান এক যুদ্ধাবস্থার বাস্তবতা। যদিও সে সময় কোরিয়ান যুদ্ধের পর একটি সাময়িক যুদ্ধবিরতি হয়, আনুষ্ঠানিক কোনো শান্তিচুক্তি হয়নি। ফলে উত্তর কোরিয়ার দৃষ্টিতে যুদ্ধ কখনো থামেনি, বরং এখনো চলমান রয়ে গেছে ছায়াযুদ্ধ হিসেবে।
এই ছায়াযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে পরমাণু অস্ত্র হয়ে উঠেছে তাদের অস্তিত্ব রক্ষার ঢাল। যুক্তরাষ্ট্র এক সময় দক্ষিণ কোরিয়ায় পারমাণবিক অস্ত্র মোতায়েন করেছিল, এখনো প্রায় ২৯ হাজার মার্কিন সেনা দেশটিতে অবস্থান করছে। দক্ষিণ কোরিয়ার অর্থনীতি উত্তর কোরিয়ার চেয়ে প্রায় ৬০ গুণ বড়। সামরিক শক্তিতে তারা বিশ্বে পঞ্চম। এমন বৈষম্যের প্রেক্ষিতে উত্তর কোরিয়ার সামরিক ও কৌশলগত শক্তির ঘাটতি পুষিয়ে নিতে তাদের পারমাণবিক কর্মসূচি একটি প্রতিরোধ কাঠামো হিসেবে গড়ে উঠেছে।
তাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, প্রতিটি পরমাণু পরীক্ষার পেছনে একটি যুক্তি দেওয়া হয় সেটি হলো- যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রাসন, হুমকি ও নিষেধাজ্ঞার জবাব হিসেবেই এগুলো পরিচালিত হয়েছে। তারা কখনোই এগুলোকে আক্রমণাত্মক অস্ত্র হিসেবে প্রচার করেনি। বরং তাদের ভাষায়, এটি ‘স্বাভাবিক আত্মরক্ষার অধিকার।’
তবে বাস্তবতা বলছে, উত্তর কোরিয়ার এই কৌশল কেবল প্রতিরক্ষা নয়, বরং কূটনৈতিক দরকষাকষির অন্যতম হাতিয়ারও বটে। পরমাণু কর্মসূচি তাদের জাতীয় পরিচয়, নেতৃত্বের বৈধতা এবং আন্তর্জাতিক দরবারে কথাবার্তা বলার সক্ষমতার প্রতীক হয়ে উঠেছে।
ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে অতীতের বৈঠকগুলো, বিশেষ করে সিঙ্গাপুর ও হ্যানয়ের বৈঠক, যদিও ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ছিল, ফলাফল ছিল হতাশাজনক। যুক্তরাষ্ট্র সম্পূর্ণ নিরস্ত্রীকরণের (ঈঠওউ) দাবি নিয়ে এগিয়েছিল, আর পিয়ংইয়ং চেয়েছিল নিরাপত্তার নিশ্চয়তা ও অর্থনৈতিক অবরোধ প্রত্যাহার। মেলেনি কোনোটাই।
এবার আবারও আলোচনার বার্তা আসছে, তবে ভিন্ন কণ্ঠে আরও স্পষ্টভাবে। কিম ইয়ো জং বলছেন, ‘আমাদের পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ে কারো সঙ্গে আপসের প্রশ্নই আসে না। বরং আমাদের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে আমাদের বর্তমান অবস্থানকে স্বীকার করতে হবে।’
এমন অবস্থান যুক্তরাষ্ট্রের জন্য এক বিরাট নীতিগত চ্যালেঞ্জ। এখন প্রশ্ন উঠছে যুক্তরাষ্ট্র কি বাস্তবতা মেনে অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ আলোচনা (ধৎসং পড়হঃৎড়ষ ঃধষশং) করবে, নাকি আগের মতোই পূর্ণ নিরস্ত্রীকরণের দাবি ধরে রাখবে? অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ আলোচনায় গেলে যেমন আলোচনার একটি ভিত্তি গড়ে ওঠে, তেমনি এটি আন্তর্জাতিক পরমাণু নিরস্ত্রীকরণ কাঠামোর ওপর এক বিশাল আঘাতও হতে পারে। ইরান, সৌদি আরব কিংবা ভবিষ্যতের অন্য রাষ্ট্রগুলোও উত্তর কোরিয়ার পথ অনুসরণে উৎসাহিত হতে পারে।
এখানে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, উত্তর কোরিয়া দক্ষিণ কোরিয়াকে কার্যত উপেক্ষা করছে। তারা সংলাপের একমাত্র যোগ্য পক্ষ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রকেই বিবেচনা করছে। এটি দক্ষিণ কোরিয়ার কূটনৈতিক সক্ষমতার জন্য এক বড় আঘাত। তারা বলছে, দক্ষিণ এখনো ‘শত্রু’ এবং তাদের সঙ্গে কোনো আলোচনা সম্ভব নয়।
সিউলের নতুন প্রশাসন যদিও শান্তিপূর্ণ সম্পর্কের ইঙ্গিত দিয়েছে, সীমান্তে লাউডস্পিকার প্রচার বন্ধ করেছে, ওড়ানো বন্ধ করেছে উড়ন্ত প্রচারপত্র, তবুও পিয়ংইয়ং স্পষ্ট জানিয়েছে, ‘শত্রুর সংজ্ঞা বদলায়নি।’
পরিস্থিতির এই জটিল বাস্তবতায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের জন্য সবচেয়ে জরুরি হলো বাস্তবতাকে বিবেচনায় রেখে একটি দীর্ঘমেয়াদি কৌশল গ্রহণ করা। শাস্তিমূলক অবরোধ ও একতরফা দাবি দিয়ে উত্তর কোরিয়াকে সম্পূর্ণ নিরস্ত্রীকরণে বাধ্য করা সম্ভব নয়। আবার তাদের পারমাণবিক শক্তি মেনে নেওয়াও একটি বড় ভুল বার্তা দিতে পারে।
তাই দরকার একটি ভারসাম্যপূর্ণ নীতি। যেখানে একদিকে উত্তর কোরিয়ার নিরাপত্তা আশ্বস্ত করা হবে, অন্যদিকে ধাপে ধাপে নিরস্ত্রীকরণের বাস্তব রূপরেখা তৈরি হবে। একে বলা যেতে পারে ‘পড়হফরঃরড়হধষ ংবপঁৎরঃু-ভড়ৎ-ফরংধৎসধসবহঃ ফবধষ’-যেখানে অস্ত্র ছাড়ার প্রতিটি ধাপের জন্য নির্দিষ্ট নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক সুবিধা নিশ্চিত থাকবে।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হলো, কিম জং উনের সরকার এখন আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি চাইছে একটি পরমাণু রাষ্ট্র হিসেবে, এবং তারা এটিকে পুঁজিবাদী কূটনীতির একমাত্র কার্যকর ভাষা হিসেবে বিবেচনা করছে। কিন্তু এই কৌশলের সফলতানির্ভর করছে যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য রাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়ার ওপর।
ট্রাম্প যদি আবার ‘বিগ ডিল’ কৌশল গ্রহণ করেন, তবে সেটি নির্ভর করবে এই প্রশ্নের উত্তরেই তিনি কি উত্তর কোরিয়ার অস্তিত্বের নিরাপত্তাকে স্বীকৃতি দিয়ে আলোচনা শুরু করবেন, নাকি আবারও চাপের নীতিতে ফিরে যাবেন?
বিশ্ববাসীর জন্য এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো- তারা কি উত্তর কোরিয়ার এই নতুন চিত্রকে মেনে নিয়ে নতুন এক বিশ্ব পরমাণু নীতির পথ তৈরি করবে, নাকি অতীতের মতো আদর্শবাদ ধরে রেখে সংলাপের সব দরজা বন্ধ করে রাখবে?
লেখক :
মো. ওবায়দুল্লাহ
শিক্ষার্থী, ইউনিভার্সিটি অব সাউদার্ন মিসিসিপি
যুক্তরাষ্ট্র