বাংলাদেশের মানুষ মারা যাচ্ছে শুধু দারিদ্র্যে নয়, মরছে সমাজের নৃশংসতা, কুসংস্কার আর দ্বিচারিতার চাপে। সম্প্রতি ঘটে যাওয়া তিনটি ঘটনা যেন আমাদের জাতিগত নৈতিক দেউলিয়াত্বের নগ্নতা উন্মোচন করেছে। এগুলো কেবল বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয় বরং যুগ যুগ ধরে চলে আসা এক অসুস্থ সামাজিক কাঠামো এবং ধর্মীয় অনুশাসনের প্রতি অবজ্ঞার প্রতিফলন। যেখানে দুর্বলদের জন্য আইন ও ন্যায়বিচার অনুপস্থিত, কিন্তু ক্ষমতাবানদের জন্য অপরাধও পুরস্কার হয়ে দাঁড়ায়।
রাজশাহীর পবায় মিনারুল নামের এক ব্যক্তি স্ত্রী, স্কুলপড়ুয়া ছেলে ও মাত্র দেড় বছরের শিশুকন্যাকে শ্বাসরোধে হত্যার পর আত্মহত্যা করেছেন। কারণ ঋণের চাপ। একজন বাবা, যিনি তার সন্তানের জন্য প্রাণ দিতেও দ্বিধা করেন না, কীভাবে নিজের হাতে তার দুধের শিশুকে হত্যার মতো জঘন্য সিদ্ধান্ত নেয়? এর জবাব লুকিয়ে আছে, এই সমাজের নিষ্ঠুর বাস্তবতায়।
কিন্তু আসল বিষয় হলো ৯০ শতাংশ মুসলিম দেশের মানুষ কি করে ঋণে জর্জরিত একজন মানুষকে এই পরিণতি থেকে বাঁচাতে পারে না? ইসলাম স্পষ্টভাবে নির্দেশ দিয়েছে- ঋণগ্রস্তকে সাহায্য করা প্রত্যেক মুসলমানের দায়িত্ব। জাকাতের অন্যতম একটি উদ্দেশ্যই হলো দুস্থ ও ঋণগ্রস্তের ঋণ পরিশোধে সহায়তা করা। অথচ বাস্তবে আমরা দেখি, মসজিদে কোটি কোটি টাকা ব্যয় হয় আলোকসজ্জায়, কিন্তু পাশের বাড়ির এক দরিদ্র পরিবার আত্মহত্যা করলে, সেটি শুধু আড্ডার বিষয় হয়ে যায়। এ সমাজে দারিদ্র্যের চেয়ে ভয়ংকর হলো মানুষের সামাজিক উদাসীনতা ও বর্বরতা। কারণ, অর্থনৈতিক সংকট নয়, মানুষের ধর্মীয় অনুশাসনের মৃত্যুই এ ধরনের হত্যাকা-ের আসল কারণ।
ফরিদপুরে চোর সন্দেহে এক যুবককে উলটো করে ঝুলিয়ে পেটানো হয়েছে। ভিডিও ভাইরাল, লোকজন বাহবা দিচ্ছে যেন ন্যায়বিচারের নতুন সংজ্ঞা তৈরি হলো। অথচ সেই ‘চোর’ এখনো আদালতে প্রমাণিত অপরাধী নয়। তার অপরাধ প্রমাণিত হোক বা না হোক, এভাবে উলটো ঝুলিয়ে নির্যাতন করা সম্পূর্ণ অমানবিক এবং আইনের পরিপন্থি।
মজার বিষয় হলো- এ সমাজই এমন ‘বীরত্ব’ দেখায় কেবল দুর্বল ও গরিবদের ওপর। এ লোকেরা কখনো সাহস পায় না, ক্ষমতাবান চোরদের দিকে আঙুল তুলতে। সালমান এফ রহমান, গিয়াসউদ্দিন আল মামুনদের কোটি কোটি টাকার দুর্নীতি সবাই জানে, কিন্তু কেউ তাদের কেশাগ্র স্পর্শ করার সাহস রাখে না। উদাহরণগুলো পড়ে হয়তোবা পাঠকের ভ্রো কুঞ্চিত হবে, নানা তারা তো সবাই আইনের আওতায় আনা হয়েছে। আমরা জানি, কোন কারণে তাদের জেলে যেতে হয়েছে কিন্তু তারা তো আমাদের চোখের সামনে সালমান, মামুন হয়ে উঠেছে। বিষয়টি এখানেই বুঝতে হবে।
কবি নজরুল তাই লিখেছিলেন ‘অন্যায় রনে যারা যত বড়, তারা তত বড় জাতি, সাত মহারথী শিশুরে বধিয়া, ফুলায় বেহায়া ছাতি।’ এই সমাজের তথাকথিত ন্যায়বিচারও যেন মঞ্চস্থ নাটক, যেখানে খলনায়ক সবসময় দুর্বল চরিত্র, আর আসল অপরাধী থাকে পর্দার আড়ালে।
নাটোরের সহকারী অধ্যাপিকা খায়রুন নাহার তার অর্ধেক বয়সি ছাত্র মামুনকে বিয়ে করেছিলেন ধর্মীয় ও আইনি দিক থেকে যা সম্পূর্ণ বৈধ। রাসুলুল্লাহ (সা.) প্রথম বিয়ে করেছিলেন হযরত খাদিজা (রা.)-কে, যিনি বয়সে বড় ছিলেন এবং দুইবারের বিধবা ছিলেন। আল্লাহ তাকে কোরআনে সম্মানিতদের মধ্যে উল্লেখ করেছেন।
তাহলে কেন সমাজ খায়রুন নাহারকে হত্যার পথে ঠেলে দিল? কেন এ বিয়েকে নিয়ে সামাজিকমাধ্যমে বিষাক্ত মন্তব্য, অপমান, গুজব, কুৎসার ঝড় বইলো? উত্তর সহজ আমাদের সমাজ এখনো জাহেলিয়াতের যুগে আটকে আছে। তখনো নারীর ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত সমাজের আদালতে বিচার হতো, আজও হয়। তখনো কুসংস্কার ও সামাজিক অপবাদ দিয়ে জীবন ধ্বংস করা হতো, আজও হয়।
খায়রুন নাহারের মৃত্যুর জন্য দায়ী সেসব নোংরা মানসিকতার মানুষ, যারা ধর্মের কথা মুখে আনে, কিন্তু জীবনযাপনে জাহেলিয়াতকে আঁকড়ে ধরে। আমরা মনে করি, আমরা আধুনিক হয়েছি মোবাইল হাতে, ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে, বিদেশি ব্র্যান্ডের পোশাক পরে। কিন্তু চিন্তায় আমরা এখনো সেই যুগে আছি, যখন কুসংস্কার ও অন্ধ আচার দিয়ে মানুষকে মেরে ফেলা হতো। তখন রক্ত ঝরত তলোয়ারে, আজ ঝরে কিবোর্ডে অপমানের বাণে বা সামাজিক বয়কটের চাপে।
জাহেলিয়াতের যুগে ছিল কন্যাসন্তান হত্যা আজও আমরা সেই হত্যাকারী মানসিকতার উত্তরাধিকার বহন করি। তখনো ধনী-ক্ষমতাবানদের অপরাধ ক্ষমা পেত, আজও তাই। পার্থক্য শুধু এতটুকু তখন অপরাধ ঢাকতে মরুভূমির ধুলো ব্যবহার হতো, আজ ব্যবহার হয় ‘আইনের ফাঁকফোকর’, ‘সামাজিক ভন্ডামি’, আর ‘রাজনৈতিক ছাতা’।
আমাদের সমাজে ন্যায়বিচার যেন একপেশে অস্ত্র, যা দুর্বলদের বুকে গেঁথে দেওয়া হয়, কিন্তু ক্ষমতাবানদের ক্ষেত্রে মুঠোয় লুকিয়ে রাখা হয়। একজন চোর সন্দেহে যুবককে আমরা জনসম্মুখে পেটাতে পারি, কিন্তু বড় চোরদের বিরুদ্ধে মুখ খুলি না। একজন ঋণগ্রস্ত কৃষকের পাশে দাঁড়াই না, কিন্তু কোটি টাকার খেলাপি ঋণ মাফ হয়ে যায়। একজন নারীর ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তে আমরা নৈতিকতার ঝাঁপিয়ে পড়ি, কিন্তু পতিত রাজনীতিবিদদের চরিত্র নিয়ে কিছু বলি না।
এই দ্বিচারিতা শুধু আমাদের ন্যায়বোধকেই হত্যা করছে না, এটি সমাজের ভেতর এক নৈতিক দেউলিয়াত্বের সুনামি বইয়ে দিচ্ছে। যেহেতু এ দেশে মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ, তাই ধর্মীয় অনুশাসনই এ সমস্যার প্রতিকারের সবচেয়ে সহজ ও স্বাভাবিক পথ। ইসলাম শুধু নামাজ-রোজার ধর্ম নয়, এটি এক পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা, যা অর্থনীতি, ন্যায়বিচার, পারিবারিক সম্পর্ক, সামাজিক আচরণ সবকিছুতেই সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা দিয়েছে।
সমাধানের জন্য আমাদের চারটি স্তরে পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রথমত, পরিবারে ঋণগ্রস্ত আত্মীয়ের পাশে দাঁড়ানোকে ধর্মীয় ও নৈতিক দায়িত্ব হিসেবে সন্তানদের শেখাতে হবে, যাতে আর্থিক সংকটে কেউ একা না পড়ে। দ্বিতীয়ত, ব্যক্তিগতভাবে এমন সহমর্মিতা চর্চা করতে হবে, যা ঋণ, দারিদ্র্য বা সামাজিক অপমানের কারণে কাউকে আত্মহত্যার মতো চরম সিদ্ধান্ত নিতে বাধা দেবে। তৃতীয়ত, সামাজিকভাবে আইনের শাসন দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠা করতে হবে, যাতে ‘গণপিটুনি’ নামের পৈশাচিকতা বন্ধ হয় এবং ক্ষমতাবান অপরাধীরাও আইনের আওতায় আসে। সর্বশেষে, রাষ্ট্রীয়ভাবে নাগরিকদের দায়িত্ব, কার্যকর সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি এবং দুর্নীতি দমনে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে, যাতে ন্যায়বিচার কেবল কাগজে নয়, বাস্তবেও কার্যকর হয়।
একজন দরিদ্র রিকশাওয়ালা ১০ টাকার সাবান ৩০ টাকায় ভ্যাট ও ট্যাক্স দিয়ে কিনে সরকার প্রধানকে এসি রুমে আর মার্সিডিজ বেঞ্জ এ চড়ার জন্য নয়। আর রাষ্ট্রের মালিক পথে ঘুমাবে কিন্তু তার চাকররা আলিশান প্রাসাদ বা বিদেশে বাড়ি গাড়ি করবে, তা কখনোই উচিত নয়। একজন চাকরের সর্বোচ্চ পদধারী সচিব, অবশ্যই এ দেশের কৃষককে সম্মান দেবে এবং স্যার বলবে। সমাজের এসব মুসলিম সম্প্রদায় বা শাসকরা হয়তো ভুলে গেছেন, যে তারা ওমর (রা.) মতো অর্ধ পৃথিবীর শাসক নন, কিংবা ওমরের রাজ্যের যত ছাগল বা উট ছিল তাদের খাওয়াতে এ দেশের সমান তৃণভূমি লাগত।
যদি আমরা সত্যিই ইসলামকে কেবল নাম নয়, কর্মে ধারণ করি তাহলে এমন ঘটনা অনেকাংশে কমে যাবে। আমাদের মনে রাখতে হবে, আজ যারা সমাজের এ অবক্ষয় দেখে চুপ করে আছি, কাল আমরাও হয়তো এর শিকার হবো। তাই এখনই সময় এই জাহেলিয়াতের অন্ধকার ভেঙে আলোর পথে ফেরার। অন্যথায়, ইতিহাস আমাদেরও সেই নোংরা সমাজের অংশ হিসেবে নিন্দা করবে, যে সমাজ দুর্বলদের রক্তে ভিজে থেকেও ক্ষমতাবানদের পদচারণায় ফুল বিছিয়ে দিত। তাই মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র বলেছিলেন- ‘ঙঁৎ ষরাবং নবমরহ ঃড় বহফ ঃযব ফধু বি নবপড়সব ংরষবহঃ ধনড়ঁঃ ঃযব ঃযরহমং ঃযধঃ সধঃঃবৎ.’
লেখক: রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন