সিলেটের পাথর ও বালু লুটের ঘটনা দীর্ঘদিন ধরে আলোচনায় থাকলেও সম্প্রতি দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুসন্ধানে তা আরও স্পষ্টভাবে সামনে এসেছে। দুদকের প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, পাথর ও বালু লুটের কাজে রাজনৈতিক দলগুলোর নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের পাশাপাশি প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তা এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। ফলে জনমনে প্রশ্ন উঠেছে, রাষ্ট্রীয় সম্পদ রক্ষার দায়িত্বপ্রাপ্তরা যখন নিজেরাই অনিয়মে জড়িয়ে পড়েন, তখন সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হবে কীভাবে?
দুদকের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছেÑ বিএনপি, আওয়ামী লীগ, জামায়াত ও এনসিপির মোট ৩২ জন নেতা এই লুটপাটের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত। পাশাপাশি সিলেটের তৎকালীন জেলা প্রশাসক, কোম্পানীগঞ্জের নির্বাহী কর্মকর্তা, পুলিশ সুপার, স্থানীয় থানার ওসি এবং খনিজ সম্পদ উন্নয়ন ব্যুরোর কর্মকর্তাদের নামও এসেছে। তদন্তে তাদের দায়িত্বে অবহেলার বিষয়টিও স্পষ্টভাবে উঠে এসেছে। যদিও এ ঘটনায় সিলেটের জেলা প্রশাসককে ওএসডি করা হয়েছে এবং কোম্পানীগঞ্জের ইউএনওকে বদলি করা হয়েছে। তবে লুটপাটে জড়িত অন্য কর্মকর্তারা এখনো রয়েছেন বহালতবিয়তে। প্রশাসনের এমন সীমিত পদক্ষেপে সাধারণ মানুষ আশ্বস্ত হতে পারছেন না। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, বদলি বা সাময়িকভাবে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়াকে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা হিসেবে ধরা যায় না। রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুটপাটের মতো গুরুতর ঘটনায় সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ও আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা অত্যন্ত প্রয়োজন। অভিযোগের যথাযথ তদন্ত শেষে দোষ প্রমাণিত হলে আর্থিক অনিয়মের হিসাব তলব করা এবং প্রযোজ্য আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।
শুধু বদলি করলে দায়মুক্তির সুযোগ সৃষ্টি করে, যা ভবিষ্যতে অনিয়মকে উৎসাহিত করতে পারে। অন্যদিকে, পাথরকা-ে রাজনৈতিক দলগুলোর অবস্থান পরিষ্কার করাও গুরুত্বপূর্ণ। দুদকের প্রতিবেদনে বিভিন্ন দলের নেতাদের নাম এলেও কোনো দল এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়নি। কেবল বিএনপি অভিযোগ ওঠার আগেই তাদের একজন নেতার পদ স্থগিত করেছিল। অথচ জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনতে হলে রাজনৈতিক দলগুলোকেই প্রথমে তাদের নেতাকর্মীদের জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে।
রাজনীতির মূল শক্তি হলো জনগণের বিশ্বাস। সেই বিশ্বাস দুর্নীতির মাধ্যমে নষ্ট হলে গণতন্ত্র দুর্বল হয়ে পড়ে। মনে রাখতে হবে, সিলেটের এসব পাথর শুধু দেশের অর্থনৈতিক সম্পদই নয়, এই অঞ্চলও পরিবেশগত সম্পদ। অবৈধভাবে পাথর উত্তোলন অর্থনৈতিক ক্ষতির পাশাপাশি প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্যের ওপর দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। নদী ও পাহাড়ের ক্ষতি হলে এর প্রতিক্রিয়া স্থানীয় মানুষের জীবন ও জীবিকায়ও প্রতিফলিত হয়।
তাই রাষ্ট্রীয় সম্পদ রক্ষা করা নৈতিক দায়িত্বও বটে। এই প্রেক্ষাপটে সরকারের এখন প্রয়োজন কিছু সুস্পষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণ করা। এর মধ্যে একটি হলো, দুদকের প্রতিবেদনে যাদের নাম এসেছে, তাদের সবাইকে পূর্ণাঙ্গ তদন্তের আওতায় আনা উচিত। অপরাধ প্রমাণিত হলে যথাযথ প্রশাসনিক ও আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে, যাতে দোষীদের শাস্তি নিশ্চিত হয়। এ ছাড়া রাজনৈতিক দলগুলোকে নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করতে হবে এবং দুর্নীতিতে জড়িত নেতাদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। সরকারের উচিত পরিবেশ ও প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষায় কার্যকর নীতিমালা তৈরি করে কঠোর নজরদারি শুরু করা। সুশাসনের মূল ভিত্তি হলো জবাবদিহি। যদি কেউ অপরাধ করেও দায়মুক্তি পায়, তাহলে সমাজে ভুল বার্তা ছড়িয়ে পড়ে। সবাই ধরে নেয়, ক্ষমতা বা প্রভাব থাকলেই শাস্তি এড়ানো সম্ভব।
এর ফলে নৈতিকতা দুর্বল হয়। দায়িত্বে অবহেলার কারণে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো আস্থাহীন হয়ে পড়ে এবং দুর্নীতি পায় প্রাতিষ্ঠানিক রূপ। অতএব, সিলেটের পাথর লুটের ঘটনায় যেসব ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান জড়িত, তাদের বিচারিক প্রক্রিয়ার আওতায় আনা এখন জাতীয় পর্যায়ে সুশাসন, ন্যায়বিচার ও জন-আস্থা পুনর্গঠনের প্রশ্ন। জনগণ প্রত্যাশা করে, অপরাধীদের কোনো প্রকার ছাড় দেওয়া হবে না এবং যে-ই জড়িত থাকুক না কেন, তাদের জবাবদিহির মুখোমুখি হতে হবে। রাষ্ট্র যদি সঠিক সময়ে শক্ত অবস্থান নেয়, তবে তা অন্যায় ও অনিয়মের বিরুদ্ধে একটি ইতিবাচক দৃষ্টান্ত হয়ে দাঁড়াবে। এই দৃষ্টান্তই প্রমাণ করবে, কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নয়।