বাংলাদেশের নিত্যপণ্যের বাজারে আগস্ট মাসেও স্বস্তি ফেরেনি। বিশেষ করে ডিম, পেঁয়াজ ও সবজির লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধি জনজীবনে চরম ভোগান্তি তৈরি করেছে। ২২ আগস্ট ২০২৫ পর্যন্ত পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, প্রায় প্রতিটি নিত্যপণ্যের দাম আরও চড়া অবস্থায় স্থিত হয়েছে। বাজারে প্রতিদিনের খাদ্যসামগ্রী কিনতে গিয়ে সাধারণ মানুষ দিশাহারা। মধ্যবিত্ত ও নি¤œ আয়ের পরিবারগুলো তাদের নিত্যপ্রয়োজনীয় চাহিদা পূরণ করতে হিমশিম খাচ্ছে।
পেঁয়াজের অগ্নিমূল্য
বাংলাদেশের রান্নায় পেঁয়াজ অপরিহার্য উপকরণ। এ পণ্যের দাম বাড়লে গোটা বাজারে অস্থিরতা দেখা দেয়। জুলাইয়ের শেষে প্রতি কেজি পেঁয়াজ ছিল ৬০-৬৫ টাকা, আগস্টের মাঝামাঝি তা লাফিয়ে ৮০-৯০ টাকায় ওঠে। ২২ আগস্ট পর্যন্ত দাম সেই উচ্চ অবস্থায় স্থিত। ব্যবসায়ীরা বলছেন, ভারত থেকে আমদানির ওপর নির্ভরতা, সরবরাহ সংকট, পরিবহন খরচ এবং মজুতদারদের কারসাজিই মূল কারণ।
ডিমের অস্বস্তিকর দাম
‘গরিবের প্রোটিন’ নামে পরিচিত ডিম এখন আর গরিবের নাগালে নেই। আগস্টের শুরুতে ডজনপ্রতি ডিমের দাম ছিল ১২০-১২৫ টাকা। মাঝামাঝি তা বেড়ে দাঁড়ায় ১৩৫-১৪০ টাকায়। ২২ আগস্টে অনেক বাজারে ডিম বিক্রি হয়েছে ১৪৫-১৫০ টাকায়। খামারিরা জানাচ্ছেন, মুরগির খাদ্য, ভুট্টা, সয়াবিন, বিদ্যুৎ ও উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় ডিমের দাম বাড়ছে। অনেক ছোট খামার বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, ফলে সরবরাহ কমছে ও বাজারে চাপ বাড়ছে।
সবজি বাজারে আগুন
সবজি বাজারেও একই অবস্থা। মৌসুমি সবজি করলা, বেগুন, শসা, গাজর প্রতি কেজি ৮০-১৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। সবচেয়ে বেশি ভোগান্তি হচ্ছে কাঁচামরিচ নিয়ে, যার দাম ২২ আগস্ট পর্যন্ত ২২০-২৬০ টাকা কেজি। সরকারি সংস্থাগুলোর মতে, মৌসুমি বন্যা ও জলাবদ্ধতায় ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সরবরাহ কমে যাওয়ায় দাম বেড়েছে। তা ছাড়া পরিবহন খরচ ও পাইকারি থেকে খুচরা পর্যায়ে দ্বিগুণ দামের বোঝা ক্রেতার ঘাড়ে চাপছে।
বাজারে ভোক্তার সংকট
একজন দিনমজুরের দৈনিক আয় যেখানে ৫০০-৬০০ টাকা, সেখানে চারজনের পরিবারের একদিনের খাবারের জন্যই অর্ধেক টাকা খরচ হয়ে যাচ্ছে। অনেক পরিবার প্রোটিন গ্রহণ কমিয়ে দিয়েছে, ফলে শিশু ও বয়স্করা পুষ্টিহীনতার ঝুঁকিতে পড়ছে।
মুদ্রাস্ফীতির চাপ
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যমতে, জুলাই মাসে খাদ্যপণ্যে মুদ্রাস্ফীতি দাঁড়ায় ৭.৫৬ শতাংশ। আগস্টের শেষ সপ্তাহের বাজার পরিস্থিতি দেখে ধারণা করা হচ্ছে, এ হার আরও বৃদ্ধি পাবে। এর প্রভাব সরাসরি পড়ছে মধ্য ও নি¤œ আয়ের মানুষের জীবনযাত্রায়।
কেন এ পরিস্থিতি তৈরি হলো
১. প্রাকৃতিক দুর্যোগ: মৌসুমি বন্যা, জলাবদ্ধতা ও ঘূর্ণিঝড়ের কারণে কৃষি উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
২. জ্বালানি ও পরিবহন খরচ বৃদ্ধি: ডিজেল-গ্যাসের মূল্য বাড়ায় পরিবহন খরচ বেড়েছে।
৩. মজুতদারদের প্রভাব: বড় ব্যবসায়ীরা কৃত্রিম সংকট তৈরি করে বাজার অস্থিতিশীল করছে।
৪. আমদানিনির্ভরতা: বিশেষ করে পেঁয়াজ ও ডালের মতো পণ্য আমদানিনির্ভর হওয়ায় আন্তর্জাতিক বাজারের প্রভাব সরাসরি পড়ছে।
৫. অপর্যাপ্ত বাজার তদারকি: সরকারি মনিটরিং না থাকায় অস্বাভাবিক দাম নিয়ন্ত্রণে আসছে না।
৬. অবাধ দালালি ও সিন্ডিকেট: পাইকারি বাজারে প্রভাবশালী সিন্ডিকেট কৃত্রিমভাবে দাম বাড়াচ্ছে।
৭. গুদাম ও সংরণক্ষ সুবিধার ঘাটতি: যথেষ্ট কোল্ড স্টোরেজ না থাকায় মৌসুমি সংকট বাড়ছে।
৮. উৎপাদন ঘাটতি: কৃষকেরা ন্যায্যমূল্য না পেয়ে উৎপাদন কমিয়ে দিচ্ছেন।
৯. আন্তর্জাতিক বাজার অস্থিতিশীলতা: প্রতিবেশী দেশগুলো হঠাৎ রপ্তানি বন্ধ করলে বাংলাদেশে সংকট তৈরি হয়।
১০. সঠিক তথ্যের অভাব: বাজারে প্রকৃত চাহিদা-সরবরাহের তথ্যের ঘাটতি দাম বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখছে।
সমাধানের পথ
১. কঠোর বাজার তদারকি: প্রতিটি বাজারে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা, মজুতদারদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া।
২. আমদানি সহজীকরণ: জরুরি ভিত্তিতে পেঁয়াজ, ডিমসহ প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানির উদ্যোগ।
৩. কৃষি খাতকে সহায়তা: কৃষকদের স্বল্প সুদে ঋণ, বীজ ও সার সহায়তা প্রদান।
৪. খামারিদের প্রণোদনা: ডিম ও মুরগি উৎপাদনকারীদের খাদ্য সরবরাহে ভর্তুকি।
৫. সংরক্ষণ ও সরবরাহ আধুনিকীকরণ: কোল্ড স্টোরেজ বাড়ানো ও আধুনিক লজিস্টিক্স ব্যবস্থা।
৬. ভোক্তা অধিকার শক্তিশালীকরণ: অভিযোগ নিষ্পত্তির প্রক্রিয়া সহজ করা।
৭. সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি সম্প্রসারণ: নি¤œ আয়ের পরিবারকে স্বল্পমূল্যে খাদ্য সরবরাহ।
৮. সিন্ডিকেট ভাঙা: প্রতিযোগিতা কমিশনকে সক্রিয় করে কারসাজি নিয়ন্ত্রণ।
৯. ডিজিটাল বাজার মনিটরিং: প্রতিদিনের বাজারদর অনলাইনে আপডেট।
১০. কৃষি গবেষণা ও উদ্ভাবন: সাশ্রয়ী জাতের ফসল উদ্ভাবনে বিনিয়োগ।
১১. সমবায়ভিত্তিক খামার ব্যবস্থা: ছোট খামারিদের একত্রিত করে উৎপাদন খরচ কমানো।
১২. আঞ্চলিক বাজার গড়ে তোলা: ঢাকামুখী সরবরাহ কমিয়ে বিভাগীয় পর্যায়ে বড় বাজার তৈরি।
১৩. জনসচেতনতা বৃদ্ধি: ন্যায্য দামের তথ্য প্রচার।
১৪. আন্তর্জাতিক চুক্তি: প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি আমদানিচুক্তি।
ভবিষ্যৎ করণীয়
১. খাদ্য মজুত আধুনিকীকরণ: সরকারিভাবে পর্যাপ্ত খাদ্যভান্ডার তৈরি।
২. কৃষকদের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতকরণ: দেশীয় উৎপাদন বাড়াতে সুরক্ষা প্রদান।
৩. শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে প্রভাব কমানো: দরিদ্র পরিবারের জন্য আলাদা সহায়তা কর্মসূচি।
৪. পুষ্টি সহায়তা কর্মসূচি: শিশু ও মায়েদের জন্য বিনা মূল্যে ডিম, দুধ, ডাল সরবরাহ।
৫. দীর্ঘমেয়াদি নীতি: আগামী ৫-১০ বছরের জন্য খাদ্যনিরাপত্তা পরিকল্পনা।
৬. ক্রয়ক্ষমতা রক্ষায় পদক্ষেপ: মজুরি সমন্বয় ও মূল্য নিয়ন্ত্রণের সমন্বিত উদ্যোগ।
পরিশেষে বলতে চাই, ২২ আগস্ট ২০২৫ পর্যন্ত বাজারচিত্র স্পষ্টভাবে দেখাচ্ছে, ডিম, পেঁয়াজ ও সবজির লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধি সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রাকে অত্যন্ত কঠিন করে তুলেছে। মধ্যবিত্ত ও নি¤œ আয়ের পরিবারগুলো প্রতিদিনের খাদ্যপণ্য কেনার জন্য হিমশিম খাচ্ছে, প্রোটিন ও পুষ্টির ঘাটতি তৈরি হচ্ছে, শিশুরা ও বয়স্করা স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়েছে। খাদ্যের অতিরিক্ত খরচ পরিবারের শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা ও অন্যান্য দৈনন্দিন জীবনধারার ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলছে।
দুর্যোগ, আমদানির ওপর নির্ভরতা, পরিবহন খরচ বৃদ্ধি, মজুতদার ও সিন্ডিকেটের মনগড়া সংকট, পাশাপাশি পর্যাপ্ত বাজার তদারকির অভাব সব মিলিয়ে এই অবস্থা সৃষ্টি করেছে। এখনই যদি কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া না হয়, মূল্যস্ফীতি আরও বেড়ে যাবে, খাদ্যনিরাপত্তা সংকটে পড়বে, এবং দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতাও হুমকির মুখে পড়বে।
সমস্যার সমাধানে সরকারের পাশাপাশি ব্যবসায়ী, কৃষক ও ভোক্তাদের সমন্বিত উদ্যোগ জরুরি। বাজার তদারকি জোরদার, কৃষি ও খামারি সহায়তা বাড়ানো, আমদানির সম্প্রসারণ, সংরক্ষণব্যবস্থা আধুনিকীকরণ এবং সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি সম্প্রসারণ এ পদক্ষেপগুলো দ্রুত বাস্তবায়ন করলে সাধারণ মানুষকে প্রয়োজনীয় খাদ্য এবং নিরাপদ জীবন নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। এখনই সময় সাহসী ও কার্যকরী পদক্ষেপের, নয়তো অস্থিতিশীল বাজার দীর্ঘমেয়াদে জনজীবন ও অর্থনীতিতে ধ্বংসাত্মক প্রভাব ফেলবে।
লেখক, কলাম লেখক ও গবেষক
প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন