ঢাকা সোমবার, ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

অভিবাসন সংকট নিরসনে ইইউ: নতুন পরিকল্পনা

সাদিয়া সুলতানা রিমি
প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ১৪, ২০২৫, ১১:৪৯ পিএম

বিশ্বব্যাপী অভিবাসন সংকট গত এক দশক ধরে একটি বহুমাত্রিক সমস্যা হিসেবে আলোচনায় রয়েছে। বিশেষত ইউরোপীয় মহাদেশে এর প্রভাব সবচেয়ে বেশি দৃশ্যমান। সিরিয়া, আফগানিস্তান, ইরাক, ইয়েমেন, লিবিয়া ও সাব-সাহারান আফ্রিকার বিভিন্ন রাষ্ট্রে যুদ্ধ, দারিদ্র্য, জলবায়ু পরিবর্তন, রাজনৈতিক অস্থিরতা ও মানবাধিকার লঙ্ঘন মানুষকে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে ইউরোপের দিকে ঠেলে দিয়েছে। এই বাস্তবতায় ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) অভিবাসন সংকট মোকাবিলায় বারবার নীতি প্রণয়ন করলেও টেকসই সমাধান এখনো আসেনি। সম্প্রতি ইইউ আবারও নতুন পরিকল্পনা প্রকাশ করেছে, যার উদ্দেশ্য হলো মানবিক, নিরাপদ ও বাস্তবসম্মত উপায়ে অভিবাসন প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করা।

২০১৫ সালের পর থেকে ইউরোপে অভিবাসী সংকট ব্যাপক আকার ধারণ করে। তখন লক্ষাধিক মানুষ ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে প্রবেশ করে। অনেকে শরণার্থী হিসেবে স্বীকৃতি পায়, কিন্তু উল্লেখযোগ্য অংশ অবৈধ পথে প্রবেশ করায় সমস্যার জটিলতা বাড়ে। একদিকে মানবিক দায়িত্ব, অন্যদিকে নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক চাপ, এই দুইয়ের মধ্যে ভারসাম্য খুঁজতে গিয়ে ইইউ বিভক্ত হয়ে পড়ে। জার্মানি, সুইডেন ও ফ্রান্স তুলনামূলক বেশি শরণার্থী গ্রহণে আগ্রহী হলেও হাঙ্গেরি, পোল্যান্ড কিংবা চেক প্রজাতন্ত্রের মতো দেশগুলো কড়া অবস্থান নেয়।
ফলে, ইউরোপীয় ইউনিয়নের অভিন্ন অভিবাসন নীতি বাস্তবায়ন জটিল হয়ে ওঠে। কিন্তু অব্যাহত যুদ্ধ, দারিদ্র্য ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে অভিবাসনের চাপ কমেনি; বরং বেড়েছে। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালেই ৩ লাখের বেশি অভিবাসী ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে প্রবেশ করেছে। এর মধ্যে হাজার হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছে সমুদ্রের গভীরে।

ইইউর নতুন অভিবাসন পরিকল্পনা মূলত তিনটি দিককে কেন্দ্র করে সাজানো হয়েছে-

১. সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ জোরদার: ইউরোপীয় সীমান্ত ও উপকূলরক্ষী বাহিনীকে আরও শক্তিশালী করা হবে। নজরদারিতে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার বাড়ানো হবে।

২. অভ্যন্তরীণ দায়িত্ব বণ্টন: সদস্য রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে অভিবাসী গ্রহণের ভারসাম্য নিশ্চিত করা হবে। কোনো দেশ অভিবাসী গ্রহণে অনিচ্ছুক হলে তাকে আর্থিক সহায়তা প্রদানের বাধ্যবাধকতা থাকবে।

৩. আইনগত পথ সুসংহতকরণ: ইউরোপে অভিবাসনের জন্য বৈধ পথকে সহজতর করা হবে যাতে ঝুঁকিপূর্ণ অবৈধ পথ বেছে নিতে মানুষ নিরুৎসাহিত হয়। একই সঙ্গে অবৈধ অভিবাসীদের দ্রুত প্রত্যাবাসনের ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ জোরদার করা ইইউর নতুন পরিকল্পনার অন্যতম প্রধান দিক। ভূমধ্যসাগরের সমুদ্রপথে নজরদারি বাড়ানো, ড্রোন প্রযুক্তি ব্যবহার, এবং সমুদ্র উদ্ধার অভিযানের সমন্বয় এ পরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত। তবে এখানে মানবিক প্রশ্নও জড়িত। কারণ, নিরাপত্তা জোরদারের নামে অনেক সময় আশ্রয়প্রার্থী ও শরণার্থীদের মানবাধিকারের লঙ্ঘন ঘটে। মানবাধিকার সংস্থাগুলো ইতোমধ্যেই সতর্ক করেছে। সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ যেন মানবিক দৃষ্টিভঙ্গিকে ক্ষুণœ না করে।

অভিবাসন সংকট মোকাবিলায় সবচেয়ে বড় সমস্যার একটি হলো- সদস্য রাষ্ট্রগুলোর ভিন্নমত। দক্ষিণ ইউরোপের দেশগুলো, যেমন ইতালি, গ্রিস ও স্পেন, ভৌগোলিক কারণে সবচেয়ে বেশি অভিবাসীর চাপ বহন করছে। অথচ উত্তর ও পূর্ব ইউরোপের অনেক দেশ তাদের দায়িত্ব নিতে অনাগ্রহী। নতুন পরিকল্পনায় বলা হয়েছে, প্রতিটি দেশকে হয় অভিবাসী গ্রহণ করতে হবে, নতুবা অর্থনৈতিক অবদান রাখতে হবে। এটি একদিকে সমতা আনবে, কিন্তু অন্যদিকে নতুন করে রাজনৈতিক বিতর্ক উসকে দিতে পারে।

ইইউ বুঝতে পেরেছে, কেবল সীমান্ত নিয়ন্ত্রণই সমাধান নয়। মানুষের বৈধ অভিবাসনের পথ সুসংহত না হলে তারা অবৈধ পথেই ঝুঁকি নেবে। তাই নতুন পরিকল্পনায় দক্ষ শ্রমিক, শিক্ষার্থী ও গবেষকদের জন্য ভিসা প্রক্রিয়া সহজ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে যারা আশ্রয়ের যোগ্য নয়, তাদের দ্রুত প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। প্রত্যাবাসনের জন্য অভিবাসী উৎস দেশগুলোর সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় চুক্তি করার প্রস্তাবও এসেছে।

অভিবাসন শুধু রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক সমস্যা নয়, এটি গভীর মানবিক বিষয়। যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়া বা আফগানিস্তান থেকে পালিয়ে আসা মানুষদের জন্য ইউরোপ আশার আলো। ইইউর নতুন পরিকল্পনা মানবিক দিকটিকে সামনে আনার চেষ্টা করেছে। শরণার্থীদের মৌলিক অধিকার রক্ষায় আশ্রয়প্রার্থনা প্রক্রিয়াকে আরও স্বচ্ছ ও দ্রুত করার কথা বলা হয়েছে। তবে সমালোচকরা মনে করেন, পরিকল্পনার অনেক দিক এখনো নিরাপত্তা ও রাজনীতিকেন্দ্রিক, যেখানে মানুষের কষ্ট ও দুর্দশার প্রতি পর্যাপ্ত সংবেদনশীলতা নেই।

অভিবাসন সংকট ইউরোপের সমাজে বহুমুখী প্রভাব ফেলছে। একদিকে বহুজাতিক সংস্কৃতির বিকাশ ঘটছে, শ্রমবাজারে নতুন কর্মশক্তি যোগ হচ্ছে। অন্যদিকে, অভিবাসন-বিরোধী রাজনৈতিক শক্তি বাড়ছে, জাতীয়তাবাদী প্রবণতা জোরদার হচ্ছে। জার্মানি, ফ্রান্স কিংবা ইতালিতে অভিবাসন এখন নির্বাচনি রাজনীতির অন্যতম ইস্যু। অর্থনৈতিকভাবে অভিবাসীরা যেমন শ্রমঘাটতি পূরণে সহায়তা করছে, তেমনি তাদের সামাজিক সংহতকরণ না হলে সামাজিক উত্তেজনা বাড়ছে।

অভিবাসন সংকট কেবল ইউরোপের সমস্যা নয়; এটি বৈশ্বিক সমস্যা। জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থার হিসাব অনুযায়ী, বিশ্বে বর্তমানে ১১ কোটি মানুষেরও বেশি জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে আগামী দশকগুলোতে এই সংখ্যা আরও বাড়বে। তাই ইইউর নতুন পরিকল্পনা শুধু নিজেদের স্বার্থে নয়, বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। উন্নয়নশীল দেশগুলোর সঙ্গে সমন্বয়, বৈশ্বিক সংলাপ, এবং ন্যায্য দায়িত্ব বণ্টন ছাড়া এই সংকটের দীর্ঘমেয়াদি সমাধান সম্ভব নয়।

অভিবাসন সংকট ইউরোপের জন্য শুধু নিরাপত্তা বা অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ নয়, এটি একটি মানবিক দায়বদ্ধতার প্রশ্ন। ইইউর নতুন পরিকল্পনা এই সংকট মোকাবিলায় একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হতে পারে। তবে এটি কার্যকর করতে হলে সদস্য রাষ্ট্রগুলোর ঐক্য, বৈশ্বিক সহযোগিতা এবং মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি অপরিহার্য। সীমান্তে কড়া নিয়ন্ত্রণ বা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া দিয়ে হয়তো সাময়িক সমাধান আসবে, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি সমাধান নির্ভর করবে মূল কারণ নিরসনে বৈশ্বিক উদ্যোগের ওপর। তাই ইউরোপীয় ইউনিয়নের উচিত নিজেদের ভৌগোলিক সীমানার বাইরেও চিন্তা করা, যাতে অভিবাসন আর মানবিক ট্র্যাজেডি না হয়ে, একদিন বৈশ্বিক সহাবস্থানের ইতিবাচক শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়।

সাদিয়া সুলতানা রিমি, শিক্ষার্থী জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়