সোমবার, ২২ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

ফেসবুক


ইউটিউব


টিকটক

Rupali Bangladesh

ইনস্টাগ্রাম

Rupali Bangladesh

এক্স

Rupali Bangladesh


লিংকডইন

Rupali Bangladesh

পিন্টারেস্ট

Rupali Bangladesh

গুগল নিউজ

Rupali Bangladesh


হোয়াটস অ্যাপ

Rupali Bangladesh

টেলিগ্রাম

Rupali Bangladesh

মেসেঞ্জার গ্রুপ

Rupali Bangladesh


মো. নূর হামজা পিয়াস

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ২২, ২০২৫, ০১:২৭ এএম

‘বিসিএস স্বপ্নে বিভোর তরুণ প্রজন্ম কি হারাচ্ছে নিজেদের ভবিষ্যৎ?’

মো. নূর হামজা পিয়াস

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ২২, ২০২৫, ০১:২৭ এএম

‘বিসিএস স্বপ্নে বিভোর তরুণ প্রজন্ম কি হারাচ্ছে নিজেদের ভবিষ্যৎ?’

বর্তমান সময়ে অনেক অভিভাবকের একটি ধারণা হলো, সন্তানকে বিসিএস ক্যাডার বানানো মানেই জীবনে স্থায়িত্ব, অর্থ উপার্জন, সুনাম এবং সম্মান নিশ্চিত করা। সমাজে একটি বিশ্বাস গড়ে উঠেছে যে বিসিএস পদে পৌঁছানো মানে জীবনের চূড়ান্ত সাফল্য অর্জন। কিন্তু বাস্তবতা কি সত্যিই তাই? প্রতিযোগিতামূলক এই পরীক্ষার পেছনে রয়েছে অসংখ্য তরুণের ত্যাগ, অগণিত রাত জাগা, মানসিক চাপ এবং পারিবারিক স্বপ্নের বোঝা। কয়েক দশক ধরে বিসিএস আমাদের সংস্কৃতি এবং মানসিকতার সঙ্গে এতটাই জড়িয়ে গেছে যে অনেক তরুণের কাছে এটি একমাত্র গন্তব্যে পরিণত হয়েছে। অথচ এই অন্ধ নির্ভরশীলতা শুধু ব্যক্তিগত জীবনে নয়, দেশের অর্থনীতি ও সমাজেও মারাত্মক প্রভাব ফেলছে।

বিসিএস বাংলাদেশের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ নিয়োগ ব্যবস্থা। এটি প্রার্থীদের প্রশাসন, পররাষ্ট্র, পুলিশ এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বিভাগে চাকরির সুযোগ দেয়। কয়েক দশক ধরে বিসিএস চাকরি ক্ষমতা, নিরাপত্তা এবং মর্যাদার প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে, যা লাখ লাখ স্নাতকের কাছে এক স্বপ্নের মতো। প্রতি বছর অসংখ্য তরুণ উচ্চাকাক্সক্ষী প্রার্থী বিসিএসকে জীবনের সফলতার একমাত্র পথ মনে করে এর কঠিন ও তীব্র প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার জন্য বছরের পর বছর প্রস্তুতি নেয়।

এই প্রতিযোগিতা শুধু ব্যক্তিগত স্বপ্নের প্রতিফলন নয়, বরং আমাদের সমাজের গভীরভাবে প্রোথিত সাংস্কৃতিক মানসিকতার প্রতিচ্ছবি। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে পরিবারগুলো সন্তানদের বিসিএসের স্বপ্ন দেখিয়ে বড় করেছে। অনেক বাবা-মা এখনো মনে করেন, বিসিএস ক্যাডার হওয়া মানে পরিবারের সম্মান, সামাজিক মর্যাদা এবং আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।

বিসিএসের ইতিহাস ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমল থেকে শুরু। সে সময় সিভিল সার্ভিসের পদগুলো ছিল ক্ষমতা, প্রভাব এবং উচ্চ সামাজিক মর্যাদার প্রতীক। স্বাধীনতার পরও এ ধারা অব্যাহত থাকে। বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশে স্থিতিশীল চাকরি এবং সচ্ছল জীবনযাত্রার স্বপ্ন বিসিএসের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত হয়ে যায়। সমাজে এই ধারণা এতটাই দৃঢ়ভাবে গেঁথে গেছে যে, অনেক তরুণের কাছে বিসিএসই সফলতার একমাত্র প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, দেশের তরুণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে বেকারত্বের সংখ্যা প্রায় ১৯.৪ লাখ, যেখানে মোট তরুণ শ্রমশক্তির সংখ্যা ২৬৭.৬ লাখ। অর্থাৎ প্রায় ৭.২ শতাংশ তরুণ বেকার। ৪৬তম বিসিএস পরীক্ষার প্রিলিমিনারি ধাপে মাত্র ৩,১৪০টি পদের বিপরীতে আবেদন করেছিলেন প্রায় ২,৫৪,৫৬১ জন প্রার্থী। প্রথম ধাপে সফল হয়েছেন মাত্র ১০,৬৩৮ জন। পরে সংস্কারের পর এই সংখ্যা দাঁড়ায় ২১,৩৯৭ জনে। সংখ্যার এই বিশাল বৈষম্য থেকেই বোঝা যায় কেন বিসিএসকে কেন্দ্র করে তরুণদের ওপর এত চাপ তৈরি হয়। এত কম পদে এত বিপুল প্রতিযোগিতা হতাশা, উদ্বেগ এবং সামাজিক চাপের জন্ম দিচ্ছে।

বিসিএসের প্রতি অতি-নির্ভরশীলতা তরুণদের মানসিক স্বাস্থ্যকে গভীরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। অনেক প্রার্থী বছরের পর বছর পড়াশোনা করেও সফল হতে না পারায় হতাশায় ভোগেন। ব্যর্থতার দুঃখে তারা নিজেদের অযোগ্য মনে করেন। পরিবারের অযৌক্তিক প্রত্যাশা এবং সামাজিক চাপ এ হতাশাকে আরও বাড়িয়ে তোলে। অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে, প্রার্থীরা জীবনের সবকিছু বিসিএসের সঙ্গে বেঁধে ফেলেন। যদি কাক্সিক্ষত ফল না আসে, তারা ভেঙে পড়েন, এমনকি আত্মহত্যার মতো চরম পথ বেছে নেন। সফলদের সঙ্গে ব্যর্থদের এই তীব্র বৈষম্য সমাজে অদৃশ্য এক বিভেদ তৈরি করছে।

বিসিএসের প্রতি অতিরিক্ত মনোযোগের কারণে অনেক তরুণ স্নাতক বেসরকারি খাত, উদ্যোক্তা হওয়া, ফ্রিল্যান্সিং বা বিদেশে উচ্চশিক্ষার মতো বিকল্প পথগুলো উপেক্ষা করেন। বছরের পর বছর শুধু বিসিএসের প্রস্তুতিতেই সময় ব্যয় করায় তারা ব্যবহারিক দক্ষতা অর্জনের সুযোগ হারান। ফলে শ্রমবাজারে দক্ষতার ঘাটতি তৈরি হয়। আইটি, উৎপাদনশীল খাত বা স্টার্টআপের মতো নতুন শিল্পে দক্ষ জনবল না থাকায় দেশের অর্থনীতি চাপে পড়ে। অন্যদিকে, সীমিতসংখ্যক সরকারি চাকরির জন্য বিপুল স্নাতক প্রতিযোগিতা করে, যা বেকারত্বের হারকে আরও বাড়িয়ে তোলে।

বিসিএস পরীক্ষাকে কেন্দ্র করে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন শহরে অসংখ্য কোচিং সেন্টার গড়ে উঠেছে। প্রতি বছর হাজার হাজার তরুণ এসব কোচিংয়ে ভর্তি হন। গ্রামীণ পরিবারের অনেকে সন্তানদের পড়াশোনার খরচ চালাতে ঋণ নেন।

বাসা ভাড়া, বইপত্র, কোচিং ফি সব মিলিয়ে এটি অনেক পরিবারের জন্য এক বড় আর্থিক চাপ তৈরি করে। অথচ এই কোচিং সেন্টারগুলোর অনেকেই কোনো নিশ্চিত ফলাফল দিতে পারে না। বরং শিক্ষার্থীদের অযৌক্তিক স্বপ্ন দেখিয়ে তারা শুধু অর্থ উপার্জনের ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে।

দেশে কর্মসংস্থানের সুযোগ কম থাকায় অনেক তরুণ বিদেশে চলে যেতে চায়। ব্রিটিশ কাউন্সিলের এক জরিপে দেখা গেছে, ১৮ থেকে ৩৫ বছর বয়সি প্রায় ৫৫ শতাংশ তরুণ বিদেশে কাজ করতে বা স্থায়ীভাবে বসবাস করতে ইচ্ছুক।

কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাষ্ট্র এবং জাপান তাদের প্রিয় গন্তব্য। এর ফলে দেশে মেধাশূন্যতা তৈরি হচ্ছে। দক্ষ তরুণদের অভাবে দেশের শিল্প খাত দুর্বল হয়ে পড়ছে।

বিসিএস পরীক্ষার প্রস্তুতি এবং অনিশ্চয়তা অনেক তরুণের ব্যক্তিগত জীবনেও প্রভাব ফেলছে। অনেকে বিয়ে বা পারিবারিক সিদ্ধান্ত বিলম্বিত করছেন। যারা বিসিএসে সফল হন, তারা সম্মান, অর্থনৈতিক নিরাপত্তা এবং সামাজিক মর্যাদা ভোগ করেন। কিন্তু যারা ব্যর্থ হন, তারা সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন হন এবং আত্মসম্মান হারান। এই বৈষম্য সমাজে অদৃশ্য শ্রেণি বিভাজনের জন্ম দেয়।

বাংলাদেশ সরকার তরুণদের কর্মসংস্থানের জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে জাতীয় কর্মসংস্থান নীতি (ঘঊচ ২০২২) এবং দক্ষতা উন্নয়ন বিনিয়োগ কর্মসূচি (ঝঊওচ)। এগুলো প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য নতুন কর্মসংস্থান তৈরি এবং দারিদ্র্য বিমোচনে সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে। তবে তহবিলের অভাব, নিয়ন্ত্রক জটিলতা এবং উদ্যোক্তা সহায়তা ব্যবস্থার দুর্বলতার কারণে উদ্যোগগুলো পূর্ণ সম্ভাবনা অর্জন করতে পারছে না।

বিসিএসের প্রতি অতি নির্ভরশীলতা কমাতে হলে প্রথমেই দরকার চাকরির সুযোগের বৈচিত্র্য তৈরি। বেসরকারি খাতের বৃদ্ধি এবং স্টার্টআপগুলোকে সহায়তা করার মাধ্যমে বিকল্প পথ তৈরি করতে হবে। একই সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে দক্ষতাভিত্তিক শিক্ষা কার্যক্রম এবং ক্যারিয়ার কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। বিসিএস পরীক্ষায় মুখস্থবিদ্যার বদলে ব্যবহারিক দক্ষতার ওপর জোর দিতে হবে। উদ্যোক্তা তৈরি, বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ এবং প্রযুক্তিনির্ভর কর্মসংস্থান বাড়ানোর মাধ্যমে তরুণদের জন্য নতুন সম্ভাবনা তৈরি করা সম্ভব।

বিসিএস নিঃসন্দেহে একটি সম্মানজনক পেশা, কিন্তু এটি জীবনের একমাত্র লক্ষ্য হওয়া উচিত নয়। অতিরিক্ত নির্ভরশীলতা তরুণদের স্বপ্ন ভেঙে দেয়, কর্মসংস্থানের সংকট তৈরি করে এবং দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতিকে বাধাগ্রস্ত করে।

আমাদের সমাজকে এমন এক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তুলতে হবে যেখানে বিসিএস কেবল একটি বিকল্প, কিন্তু একমাত্র গন্তব্য নয়। বিকল্প পেশা ও দক্ষতা উন্নয়নের পথ তৈরি হলেই তরুণ প্রজন্ম আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে নিজেদের ভবিষ্যৎ গড়তে পারবে এবং দেশও অগ্রগতির পথে এগিয়ে যাবে।

মো. নূর হামজা পিয়াস
শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ
ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ

রূপালী বাংলাদেশ

Link copied!