হতাশার ঘোরে হাবুডুবু খাচ্ছে মিয়ানমারের জান্তা সরকার। দেশের ভেতরে প্রতিদিন দাউ দাউ করে জ্বলছে প্রতিরোধ আন্দোলনের আগুন, আর বাইরে আন্তর্জাতিক মঞ্চে তারা ঘুরে বেড়াচ্ছে বৈধতার খোঁজে। ক্রমশ কোণঠাসা হচ্ছে মিয়ানমারের জান্তা। তাদের হাতে বাকি শুধু বিদেশি কূটনীতি আর প্রতিবেশী শক্তির কাঁধে ভর দিয়ে টিকে থাকার লড়াই।
একদিকে পিপলস ডিফেন্স ফোর্সেস (পিডিএফ) ও আরাকান আর্মি প্রতিদিন হামলা চালাচ্ছে, অন্যদিকে জাতীয় ঐক্য সরকার (এনইউজি) গঠনের প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে জান্তা। চলতি বছরের আগস্ট-সেপ্টেম্বরে সামরিক সরকারের প্রধান জেনারেল মিন অং হ্লাইং একের পর এক সফরে ছুটেছেন বেইজিং ও নয়াদিল্লি। অংশ নেন সাংহাই সহযোগিতা সংস্থার (এসসিও) শীর্ষ সম্মেলনে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিজয় উদযাপনকে কেন্দ্র করে আয়োজিত কুচকাওয়াজে বেইজিংয়ের মাটিতে পদচারণ করেন।
একই সময় তিনি বৈঠকে বসেন চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদির সঙ্গে। এরই মধ্যে আগামী ২৮ ডিসেম্বর জাতীয় নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করেছে জান্তা সরকার। অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচনে চীন ও ভারতের কাছে নির্বাচনি পর্যবেক্ষক পাঠানোর অনুরোধ জানিয়েছে মিয়ানমার। দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম অর্থনীতির এই দুই দেশের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বৃদ্ধি ও সম্পর্কোন্নয়নে এই তাড়াহুড়ো স্বভাবতই প্রশ্ন তৈরি করেছে। তবে উত্তরটি সহজ। শাসনের বৈধতা, সীমান্তে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনা ও সামরিক সহায়তা পাওয়া।
চীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা
চীনের সঙ্গে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করার তাগিদে ১৪ সেপ্টেম্বর জান্তা সরকারের প্রধানমন্ত্রী নিও স হাজির হন নাননিং শহরে ২২তম চীন-আসিয়ান এক্সপোতে। সেদিন গুইলিনে অনুষ্ঠিত আসিয়ান-চীন মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে অংশ নেন মায়ো থান্টের নেতৃত্বে জান্তার এক প্রতিনিধিদল। প্রধান আলোচ্য বিষয় ছিল শহর ও গ্রাম উন্নয়নে সহযোগিতা, বেল্ট অ্যান্ড রোড উদ্যোগের বাস্তবায়ন এবং চীন-মিয়ানমার অর্থনৈতিক করিডরের (সিএমইসি) অগ্রগতি। এ ছাড়াও ২০২১ সালের মান্ডালয়ের ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত অবকাঠামো পুনরুদ্ধারের বিষয়টিও অগ্রাধিকার পায়।
তিন দিন পর জান্তার প্রতিরক্ষামন্ত্রী জেনারেল মাউং মাউং আয়ে উপস্থিত হন বেইজিং জিয়াংশান ফোরামে। সেখানে তিনি চীনের প্রতিরক্ষামন্ত্রী অ্যাডমিরাল ডং জুনের সঙ্গে আলাপ করেন এবং বিভিন্ন উন্নত সামরিক শিল্পের কারখানা ও নির্মাণকেন্দ্র ঘুরে দেখেন। ড্রোন উৎপাদন থেকে বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, ইলেকট্রনিক যুদ্ধ সরঞ্জাম থেকে শুরু করে বিমান প্রযুক্তি, এসব কিছুই সামরিক জান্তার কাছে আকর্ষণীয়। স্বভাবতই নিজেদের সামরিক বহরে এসব সমরাস্ত্র মজুত রাখার আকাক্সক্ষা সবারই থাকে।
চীন বহুদিন ধরেই মিয়ানমারে জান্তার অস্ত্রাগারের প্রধান সরবরাহকারী। এফটিসি-২০০০জি যুদ্ধবিমান, ওয়াই-১২ ও কে-৮ প্রশিক্ষণ বিমান, সিএইচ-৩ সিরিজের ড্রোন, টাইপ ০৫৩এইচ১ ফ্রিগেট, টাইপ ৯২ পদাতিক যুদ্ধযান, এমনকি মাল্টিপল লঞ্চ রকেট সিস্টেম সবই বেইজিংয়ের হাত ধরে পৌঁছেছে নাইপিদোতে। প্রতিরোধ আন্দোলনের বিরুদ্ধে জান্তার যে কিছুটা বাড়তি সুবিধা এখনো আছে, তার বড় অংশই এসেছে এই চীনা অস্ত্রের কারণে। প্রশ্নটা তাই স্বাভাবিক, এই অস্ত্রগুলো শান্তির জন্য, নাকি দমন-পীড়নের জন্য?
যদিও জাতিসংঘ জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে পশ্চিম উপকূলের রাখাইনে জাতিগত নির্মূল করার অভিযোগ এনেছে।
চীনের মধ্যস্থতায় মিয়ানমার ন্যাশনাল ডেমোক্র্যাটিক অ্যালায়েন্স আর্মি (এমএনডিএএ) যুদ্ধবিরতিতে গিয়েছে। ইউনাইটেড ওয়া স্টেট আর্মি (ইউডব্লিউএসএ) আবার কয়েকটি গোষ্ঠীকে আর্থিক ও সামরিক সহায়তা কমিয়ে দিয়েছে। জান্তা আশা করছে, এবার কেআইএ-কে চীনের চাপেই দমন করা যাবে, আর আরাকান আর্মিকে বেল্ট অ্যান্ড রোড উদ্যোগের বিনিয়োগকেন্দ্র কিয়াউকপিউ বন্দরে হামলা থেকে বিরত রাখা যাবে।
তবে এটি তো একটি মাত্র দল এবং কিছু এলাকা মাত্র। যথেষ্ট সুবিধা পেতে বা প্রভাব বিস্তার করতে হলে এমন আরও নতুন বন্ধুত্বের গভীরে যেতে হবে। ‘ফেয়ার অব দ্য স্পিয়ার’ বিষয়টিও বিবেচনার বাইরে রাখার সুযোগ কম।
ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক
ভারতের সঙ্গে মিয়ানমানের সম্পর্কও সাম্প্রতিক মাসগুলোতে নতুন মাত্রা পেয়েছে। লেফটেন্যান্ট জেনারেল কো কো ও-এর নেতৃত্বে সেনাপ্রধান উপেন্দ্র দ্বিবেদীর সঙ্গে চলতি সেপ্টেম্বরের প্রথমার্ধে একটি উচ্চপদস্থ সামরিক দল নয়াদিল্লি গিয়ে বৈঠক করে। এ বৈঠকে আলোচনার মূল বিষয় ছিল প্রতিরক্ষা সহযোগিতা বাড়ানো এবং দুই দেশের মধ্যে সামরিক সম্পর্ক জোরদার করা।
এর দিন কয়েক পরে ১৬ সেপ্টেম্বর ঘটল এক নজিরবিহীন পাল্টাপাল্টি সফর। কর্নেল জার নি অং-এর নেতৃত্বে ১২০ সদস্যের জান্তার একটি দল ভারতে পৌঁছায়, একই দিনে সমসংখ্যক ভারতীয় সেনা কর্মকর্তা পৌঁছাল মিয়ানমারে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, ভারতও তাদের কূটনৈতিক স্বার্থে মিয়ানমারকে পাশে পেতে চাইছে। বিশেষ করে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর (সেভেন সিস্টার্স) যোগাযোগ সুরক্ষায় উচ্চাভিলাষী কালাদান মাল্টিমডাল ট্রানজিট ট্রান্সপোর্ট প্রকল্পের জন্য।
২০২৭ সালের মধ্যে প্রকল্পটি কার্যকর হলে সেভেন সিস্টার্সকে দক্ষিণ এশিয়ার ব্যবসায়িক কেন্দ্র বানাতে চায় নয়াদিল্লি। এ ছাড়া সেভেন সিস্টার্স নিয়ে আঞ্চলিক হুমকি মোকাবিলায় ক্ষমতাসীন জান্তার দরকার পড়বে। অন্যদিকে রাখাইন ও চীন রাজ্যের সীমান্ত রুট সুরক্ষার দায়িত্ব ভারতের ওপর দিতে চায় মিয়ানমার।
আর শুধু কূটনৈতিক ভদ্রতা নয়, ভারত বাস্তবে সামরিক সহায়তাও দিচ্ছে। সংবাদমাধ্যমের তথ্য অনুসারে, ৩৭.৯ মিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে দূরপাল্লার (আর্টিলারি) সরঞ্জাম, যেমন- রকেট লঞ্চার, নাইট ভিশন ডিভাইস, রাডার এবং টর্পেডোসহ প্রযুক্তিগত সরঞ্জাম সবই যাচ্ছে নেইপিদোতে। প্রতিরোধ দমনে জান্তার যে সরঞ্জাম ঘাটতি রয়েছে, তা মেটাতেও নয়াদিল্লি আগ্রহী বলে গুঞ্জন।
টিকে থাকার দৌড়ঝাঁপ
জান্তার এই ছোটাছুটির পেছনে তিনটি কারণ স্পষ্ট। প্রথমত, প্রতিরোধ গোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে সামরিকভাবে টিকে থাকা। এনইউজি, পিডিএফ ও আরাকান আর্মির প্রতিনিয়ত হামলা পর্যুদস্ত করছে জান্তা সরকারকে। দীর্ঘদিন ধরে সামরিক লড়াইয়ে লিপ্ত থাকায় ক্রমেই শক্তি কমে আসছে। ফলে প্রশাসনিক, যোগাযোগ ও সাপ্লাই লাইনগুলোও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, যা জান্তার সামরিক ও প্রশাসনিক কার্যক্রমকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করছে।
সম্প্রতি মিয়ানমারের উত্তর-পশ্চিমের বানমাউক শহর পিডিএফের দখলে চলে যায়। ফলে জান্তার নিয়ন্ত্রণে থাকা (এক চতুর্থাংশেরও কম) এলাকা আরও সঙ্কুচিত হয়ে পড়ে। মিয়ানমারের সামরিক সরকার ইতোমধ্যেই ঘোষণা করেছে যে, ৩৩০টি আসনের মধ্যে অন্তত ১২১টি নির্বাচনি এলাকায় ভোটই হবে না। কারণ সামরিক সহায়তা ও প্রযুক্তি ছাড়া জান্তার পক্ষে ডিসেম্বরের ভোট পর্যন্ত টিকে থাকা প্রায় অসম্ভব।
দ্বিতীয়ত, রাজনৈতিক বৈধতা। দেশে জনগণের কাছে জান্তার কোনো গ্রহণযোগ্যতা নেই। যেটা তাদের অভ্যন্তরীণ বৈধতাকে সম্পূর্ণ শূন্যে নামিয়েছে। তাই আন্তর্জাতিক বৈধতাই তাদের টিকে থাকার একমাত্র ভরসা। যদিও বেইজিং বা নয়াদিল্লি কেউই এখনো সরাসরি সমর্থন দেয়নি। আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষণে উপস্থিতি বা প্রতিবেশী শক্তির ‘মনোযোগ’ টানার চেষ্টা জান্তার টিকে থাকার একমাত্র কৌশল হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই বলেছেন, নির্বাচন শান্তি, জাতীয় পুনর্মিলন ও উন্নয়নের পথে সহায়ক হতে পারে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেছেন, নির্বাচন হতে হবে ‘সুষ্ঠু ও অন্তর্ভুক্তিমূলক’। এই দুই দেশের শর্তসাপেক্ষ মন্তব্যের পর মিয়ানমারের সামরিক সরকার নির্বাচনি পর্যবেক্ষক পাঠানোর মাধ্যমে দুই দেশকে পাশে দাঁড় করানোর চেষ্টা করছে। এর মাধ্যমে জান্তা চাইছে অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক চাপ হ্রাস ও আন্তর্জাতিক বৈধতা অর্জন করতে।
তৃতীয়ত, জাতিগত সশস্ত্র সংগঠনগুলোর ওপর চীন-ভারতের প্রভাব। কাচিন ইন্ডিপেনডেন্স আর্মি (কেআইএ), তা’আং ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি (টিএনএলএ) আর আরাকান আর্মি জান্তার সবচেয়ে বড় মাথাব্যথা। তাদের সশস্ত্র উপস্থিতি সামরিক সরকারের নির্বাচনি পরিকল্পনাকে ভেঙে দিচ্ছে। প্রতিরোধ সংগঠনগুলোর সঙ্গে গোপনে বা প্রকাশ্যে বহির্শক্তিগুলো সমানতালে যোগাযোগ রক্ষা করছে বলেও খবর ছড়িয়েছে।
এদিকে জান্তা সরকার আয়োজিত মিয়ানমারের আসন্ন নির্বাচনকে ‘ভুয়া নির্বাচন’ আখ্যা দিয়েছে এশিয়ান নেটওয়ার্ক ফর ফ্রি ইলেকশনস (এএনএফআরইএল)। সম্প্রতি প্রকাশিত তাদের মূল্যায়ন প্রতিবেদন বলছে, জান্তার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে ব্যাপক সহিংসতা, কঠোর আইন ও তীব্র দমন-পীড়নের মধ্যে। এতে ব্যবহার করা হবে প্রশ্নবিদ্ধ ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন, হাতে গোনা অনুমোদিত রাজনৈতিক দল এবং থাকবে না গণমাধ্যম বা নাগরিক সমাজের কোনো স্বাধীন তদারকি। সবকিছু সাজানো হচ্ছে এই আশায়, যেন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ফলাফল মেনে নেয় এবং মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্ক পুনরায় স্থাপন করে।
নির্বাচনি প্রক্রিয়ার বিভিন্ন দিক বিশ্লেষণ করে সংস্থাটি দেখিয়েছে, মিয়ানমারে জান্তা আয়োজিত নির্বাচন কোনোভাবেই আন্তর্জাতিক মানদ- পূরণ করে না এবং এগুলোকে বিশ্বাসযোগ্য বা বৈধ বলা যায় না। বহুল আলোচিত এই ‘ভুয়া নির্বাচন’ গুরুতর রাজনৈতিক ও প্রক্রিয়াগত ত্রুটিতে ভরপুর এবং চলমান সংঘাতের সমাধানও নয়। কেবল বৈধতার প্রশ্ন নয়, জনগণের লাগাতার দুর্ভোগের কারণে এই নির্বাচন গভীর নৈতিক সংকটও ডেকে আনছে।
চলতি বছরের শুরুর দিকে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ জানায়, বর্তমান পরিস্থিতিতে অনুষ্ঠিত নির্বাচনকে ‘দূরবর্তীভাবে বিশ্বাসযোগ্য’ বলে মনে করা জান্তাদের ‘ভ্রান্ত ধারণা’ হবে। নির্বাচন আয়োজনের পূর্বশর্ত হিসেবে তাদের সহিংসতা বন্ধ করতে হবে, নির্বিচারে আটক সকলকে মুক্তি দিতে হবে এবং বিরোধী দলগুলো ভেঙে ফেলার বদলে সব রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন ও অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।
মিয়ানমারের ভবিষ্যৎ আজ কেবল একটি দেশের প্রশ্ন নয়; এটি পুরো দক্ষিণ এশিয়ার স্থিতিশীলতার সঙ্গে জড়িয়ে গেছে। সীমান্তের অস্থিরতা ঢুকে পড়ছে আঞ্চলিক রাজনীতির ভেতরে। বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া প্রায় ১৩ লাখ রোহিঙ্গা সংকট বর্তমানে এই অঞ্চলের জন্য হুমকি। চীন ও ভারতের সামনে তাই দুটো রাস্তা। একদিকে জান্তার পাশে দাঁড়িয়ে সাময়িক স্বার্থসিদ্ধি, অন্যদিকে বার্মিজ জনগণের পাশে দাঁড়িয়ে টেকসই শান্তি প্রতিষ্ঠা। তারা কোন পথ বেছে নেবে, সেটাই নির্ধারণ করবে এই অঞ্চলের ভবিষ্যৎ।
লেখক: সৈয়দ মুহাম্মদ আজম, সাংবাদিক।
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন