দেশের দক্ষিণ-পূর্ব সীমান্ত এলাকা কক্সবাজারের টেকনাফ আজ মানবপাচার, মাদক বাণিজ্য ও চোরাচালানের এক ভয়াবহ অন্ধকার ঘূর্ণিপাকে আবদ্ধ। সীমান্ত পথে প্রতিনিয়তই মিয়ানমার থেকে প্রবেশ করছে ইয়াবা ও আইসের মতো জীবনঘাতী মাদক, আর তার বিনিময়ে পাচার হচ্ছে মানুষ ও নিত্যপণ্য। সম্প্রতি এই পাচার পরিস্থিতি এমন মাত্রায় পৌঁছেছে যে, সীমান্ত উপজেলা টেকনাফ এখন মাদক ও মানবপাচারের হটস্পট হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠেছে।
রূপালী বাংলাদেশে প্রকাশিত ‘যাচ্ছে মানব, আসছে মাদক’ শিরোনামের বিশেষ প্রতিবেদনে উঠে এসেছে ভয়াবহ তথ্য। প্রতিবেদনটি বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, মালয়েশিয়া পাচারের উদ্দেশ্যে পাহাড়ে বন্দি করে রাখা হচ্ছে রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ, এমনকি কিশোরীদেরও। আর এদের বিনিময়েই মিয়ানমার থেকে আসছে বিপুল পরিমাণ ইয়াবা ও ক্রিস্টাল মেথ। সীমান্তের শতাধিক পয়েন্ট দিয়ে এই মাদক চোরাচালান নিয়ন্ত্রণ করছে স্থানীয় দালাল চক্র ও মিয়ানমারের বিদ্রোহী সংগঠন আরাকান আর্মির সঙ্গে যুক্ত এক আন্তর্জাতিক সিন্ডিকেট। বাংলাদেশি খাদ্যপণ্য, সিমেন্ট, সার বা অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস পাচার হয়ে যাচ্ছে ওপারে, আর তার বদলে ফিরছে মাদক ও অস্ত্র।
বিজিবি, র্যাব ও কোস্টগার্ডের যৌথ অভিযান সত্ত্বেও চক্রের মূল হোতারা এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে। প্রশাসন বলছে, তারা তথ্য সংগ্রহ করছে, কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়, বছরের পর বছর ধরেই কেন এই দালাল নেটওয়ার্ক অটুট থাকে? কেন প্রতিবার ধরা পড়ে কেবল ছোট ‘মাছগুলো’? আরেকটি উদ্বেগজনক বিষয় হলো, মানবপাচার ও মাদক কারবার এখন একে অপরের বিকল্প উৎসে পরিণত হয়েছে, মানুষ যাচ্ছে, মাদক আসছে। এর ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে মানবিক মূল্যবোধ, সামাজিক নিরাপত্তা ও রাষ্ট্রের সার্বিক আইনশৃঙ্খলা।
জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮-২০২৫ সাল পর্যন্ত পাচার ও ঝুঁকিপূর্ণ অভিবাসনের শিকার হয়েছেন প্রায় দেড় হাজার মানুষ; কেবল কক্সবাজারে চলছে ৪৬০টি মানবপাচার মামলা, যার মধ্যে নিষ্পত্তি হয়েছে মাত্র ১৬টি। এই পরিসংখ্যান আমাদের আইন প্রয়োগ ও বিচারিক সক্ষমতার সীমাবদ্ধতা চোখে আঙুল দিয়ে দেখায়। অপরাধীরা শাস্তি না পেলে অপরাধ আরও বাড়ে। এ সত্য আমরা বারবার প্রত্যক্ষ করছি।
মাদক ও মানবপাচারের অর্থ এখন সরাসরি যাচ্ছে মিয়ানমারের আরাকান আর্মির মতো সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠীর হাতে। বিজিবির নিজস্ব তথ্যেই তা প্রমাণিত। অর্থাৎ এটি এখন কেবল সীমান্ত অপরাধ নয়, বরং জাতীয় নিরাপত্তার জন্যও এক ভয়াবহ হুমকি। সীমান্তের দুর্বল নিয়ন্ত্রণ, স্থানীয় রাজনৈতিক প্রভাব ও দুর্নীতিগ্রস্ত সিন্ডিকেট এই অপরাধকে পুষ্ট করছে।
এই অবস্থায় কেবল অভিযানে সীমাবদ্ধ থাকা যথেষ্ট নয়। প্রয়োজন সীমান্তজুড়ে প্রযুক্তিনির্ভর নজরদারি। ড্রোন, স্যাটেলাইট ম্যাপিং ও সেন্সরভিত্তিক মনিটরিং ব্যবস্থার। পাশাপাশি সীমান্তবর্তী জনগোষ্ঠীর মধ্যে কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়াতে হবে, যাতে তারা দালালচক্রের হাতে না পড়ে। মানবপাচার ও মাদকবিরোধী মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য আলাদা ট্রাইব্যুনাল গঠনও জরুরি।
সবচেয়ে বড় কথা, মাদকের ভয়াবহ প্রভাব শুধু ব্যক্তিগত জীবনেই সীমাবদ্ধ থাকে না, এটি পারিবারিক অস্থিরতা, শিক্ষা ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়া, কর্মক্ষমতা হ্রাস, এবং সমাজে নৈতিক অবক্ষয়ের অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তরুণ প্রজন্মের একটি বড় অংশ মাদকাসক্ত হয়ে পড়ছে, যা আমাদের ভবিষ্যতের জন্য অশনিসংকেত।
আমরা মনে করি, রাষ্ট্রের সকল শক্তি, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, স্থানীয় প্রশাসন, রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও নাগরিক সমাজ, একত্রে কাজ করতে পারলে সীমান্তপথে মাদক ও মানবপাচারের এই দুষ্টচক্র ভাঙা সম্ভব হবে।
আমরা আশা করব, দেশ ও জাতির ভবিষ্যতের স্বার্থে মাদকমুক্ত সমাজ গঠনের জন্য সরকার, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, মিডিয়া, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও নাগরিক সমাজসহ সবাই সমন্বিতভাবে কাজ করবে। মাদককে না বলতে হবে এখনই, নইলে আগামী প্রজন্মের ভবিষ্যৎ খুব একটা সুখকর হবে না।
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন