শুক্রবার সকালের ভূমিকম্পের শক্তিশালী ঝাঁকুনি আমাদের সবাইকে আবারও মনে করিয়ে দিল, আমরা কতটা ভূমিকম্প ঝুঁকিপূর্ণ দেশে বসবাস করি। মাত্র কয়েক সেকেন্ডের কম্পনে রাজধানী ঢাকা থেকে শুরু করে দেশের বিভিন্ন জেলায় প্রাণহানি, আহত, ভবনে ফাটল, বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ হয়ে যাওয়াসহ একাধিক হৃদয়বিদারক ঘটনা প্রমাণ করে যে, আমাদের প্রস্তুতির ঘাটতি এখনো রয়ে গেছে। নরসিংদীর মাধবদীকে কেন্দ্র করে হওয়া এই ভূমিকম্প ছিল গত কয়েক দশকের মধ্যে অন্যতম তীব্র। এতে ঢাকাসহ গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী ও আরও অনেক এলাকায় মানুষ আতঙ্কে রাস্তায় বেরিয়ে আসে। কোথাও দেয়াল ধসে শিশুর মৃত্যু, কোথাও ভবনের রেলিং ভেঙে আহত বা নিহত। সব মিলিয়ে পরিস্থিতি ছিল অত্যন্ত দুঃসহ। সাধারণ মানুষ বলছেন, গত কয়েক দশকের মধ্যে এ রকম তীব্র কম্পন দেখেনি তারা।
এ ধরনের দুর্যোগে মানুষের আতঙ্কই অনেক সময় বড় ক্ষতির কারণ হয়। অনেক শ্রমিক হুড়োহুড়ি করে নামতে গিয়ে আহত হয়েছেন, গাজীপুর ও মাগুরার কয়েকটি কারখানায় কর্মীরা আতঙ্কে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। ঢাকা-চট্টগ্রামে বেশ কয়েকটি ভবন হেলে পড়েছে, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে ফাটল দেখা গেছে। এসব ঘটনা আমাদের শহর ও ভবন নির্মাণব্যবস্থার দুর্বলতা পরিষ্কারভাবে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। পাশাপাশি এটি আবারও মনে করিয়ে দেয়, ভূমিকম্পের সময় আমরা কী করব, সে বিষয়ে আমাদের জ্ঞান ও প্রস্তুতি এখনো যথেষ্ট নয়।
সরকার, প্রশাসন ও জরুরি সেবাগুলো ভূমিকম্পের পর দ্রুত ব্যবস্থা নিয়েছে, কন্ট্রোল রুম খোলা, ফায়ার সার্ভিসের উদ্ধারকাজ, বিদ্যুৎ উৎপাদন স্বাভাবিক করা, ক্ষয়ক্ষতির তথ্য সংগ্রহ এসব পদক্ষেপ প্রশংসনীয়। তবুও এসব পদক্ষেপ মূলত ঘটনার পরের ব্যবস্থা। আমাদের দরকার ছিল এবং এখনো আছে, ভূমিকম্পের আগেই প্রস্তুতি নিয়ে রাখা। বড় ধরনের দুর্যোগ রোধ করা যায় না, কিন্তু ক্ষতি কমিয়ে আনা যায়। এটি আমরা বিশ্বের অনেক দেশ থেকেই দেখি।
আমাদের ভবনগুলো কতটা শক্ত, কতটা ঝুঁকিপূর্ণ, এ বিষয়ে নিয়মিত পরিদর্শন ও মেরামত প্রয়োজন। বহু ভবন পুরোনো, কোথাও কোথাও মানহীন নির্মাণ। এসবই তীব্র কম্পনে বড় বিপর্যয়ের কারণ হতে পারে। শহর পরিকল্পনার খামতি, ঘনবসতি, সরু রাস্তা এসবও উদ্ধারকাজকে কঠিন করে দেয়। এসব সমস্যা আমরা বহু বছর ধরে দেখে আসছি, কিন্তু ভূমিকম্পের সময়ই এগুলো সবচেয়ে বেশি ভয়াবহভাবে চোখে পড়ে।
একইসঙ্গে মানুষের সচেতনতা সবচেয়ে জরুরি। ভূমিকম্প হলে কীভাবে নিরাপদ থাকতে হয়, এ বিষয়ে স্কুল, কলেজ, অফিস, কারখানায় নিয়মিত মহড়া দরকার। পরিবারে শিশু ও বয়স্কদের কীভাবে বাইরে নিয়ে যেতে হবে, কোথায় দাঁড়ালে নিরাপদ। এসব নিয়ে সাধারণ মানুষকে সহজভাবে শেখানো প্রয়োজন। আতঙ্ক কমানো গেলে অর্ধেক ক্ষতি কমে যায়। এটি গতকালের পরিস্থিতি আবারও প্রমাণ করেছে।
আমাদের জরুরি সেবা, ফায়ার সার্ভিস, সিভিল ডিফেন্স, হাসপাতালগুলোতে সক্ষমতা আরও বাড়াতে হবে। বড় বিপর্যয় এলে তারা দ্রুত সেবা দিতে পারলে প্রাণহানি অনেক কমে যাবে। পাশাপাশি ভূমিকম্পসংক্রান্ত গবেষণা ও পর্যবেক্ষণ আরও বাড়াতে হবে, যাতে ঝুঁকি সম্পর্কে আগেই সতর্ক হওয়া যায়।
বাংলাদেশের মানুষ সবসময়ই দুর্যোগ মোকাবিলায় দৃঢ়তা দেখিয়েছে। বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, অগ্নিকা- সবকিছু মোকাবিলা করে আমরা এগিয়ে যেতে শিখেছি। ভূমিকম্পও তার ব্যতিক্রম নয়। তবে কেবল সাহস দিয়ে নয়, সঠিক প্রস্তুতি দিয়ে আমরা ভবিষ্যৎ ক্ষয়ক্ষতি কমাতে পারি।
এই ঘটনাটি আমাদের চোখ খুলে দেওয়ার জন্যই যথেষ্ট। ভূমিকম্প থামানো সম্ভব নয়, কিন্তু তার পরিণতি কমানো সম্ভব। তাই এখনই সময়Ñ রাষ্ট্র, প্রতিষ্ঠান, স্থানীয় প্রশাসন থেকে শুরু করে প্রতিটি পরিবারকে নিজেদের প্রস্তুত করে তোলার। নিরাপত্তা ও সচেতনতাই আমাদের সবচেয়ে বড় অস্ত্র। যেকোনো সময় আরও বড় ঝাঁকুনির সম্মুখীন হতে পারি আমরাÑ তাই নিজেদের রক্ষা করতে হলে আরও বড় ঝাঁকুনির আগেই নিজেদের প্রস্তুত রাখতে হবে।

সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন