রবিবার, ২৩ নভেম্বর, ২০২৫

ফেসবুক


ইউটিউব


টিকটক

Rupali Bangladesh

ইনস্টাগ্রাম

Rupali Bangladesh

এক্স

Rupali Bangladesh


লিংকডইন

Rupali Bangladesh

পিন্টারেস্ট

Rupali Bangladesh

গুগল নিউজ

Rupali Bangladesh


হোয়াটস অ্যাপ

Rupali Bangladesh

টেলিগ্রাম

Rupali Bangladesh

মেসেঞ্জার গ্রুপ

Rupali Bangladesh


মুনাওয়ার হোসাইন মইনুল, গণমাধ্যম উদ্যোক্তা ও মানবাধিকার কর্মী

প্রকাশিত: নভেম্বর ২৩, ২০২৫, ০৩:১৯ এএম

ভূমিকম্পের ভয়াবহতা : বাংলাদেশের চিত্র ও জরুরি প্রস্তুতি

মুনাওয়ার হোসাইন মইনুল, গণমাধ্যম উদ্যোক্তা ও মানবাধিকার কর্মী

প্রকাশিত: নভেম্বর ২৩, ২০২৫, ০৩:১৯ এএম

ভূমিকম্পের ভয়াবহতা : বাংলাদেশের চিত্র ও জরুরি প্রস্তুতি

বাংলাদেশ, বিশ্বের অন্যতম জনবহুল ও জমির গভীর ভাঙা পুরাতন মাটির ওপর অবস্থিত এক দেশ, দীর্ঘদিন ধরেই ভূমিকম্প-ঝুঁঁকিতে রয়েছে। তার পেছনে রয়েছে জটিল ভৌগোলিক কাঠামো: ভারত, ইউরেশিয়া এবং বার্মা (মিয়ানমার) প্লেটগুলোর সংযোগস্থল। বিশেষজ্ঞরা সবসময় সতর্ক করছেনÑ ভূমিকম্প রোধ করা যায় না, কিন্তু প্রস্তুতি নিতে পারি; গত ২১ নভেম্বর-২০২৫ নরসিংদীর মাধবদী থেকে উৎপন্ন ৫.৭ মাত্রার ভূমিকম্প আমাদের সেই ভয়াবহতা আরও কাছাকাছি এনে দিয়েছে।

ভূমিকম্প ঝুঁঁকির ভিত্তি : বাংলাদেশের ভৌগোলিক ও টেকটোনিক অবস্থান :

বাংলাদেশ ভূতাত্ত্বিকভাবে তিনটি মূল প্লেটÑ ভারতীয়, ইউরেশিয়ান ও বার্মীয় সংযোগস্থলে অবস্থিত। এই প্লেটগুলোর সংঘর্ষ এবং ভূ-চাপের সঞ্চয় আমাদের দেশে মাঝারি থেকে বড় মাত্রার ভূকম্পন সম্ভাবনা তৈরি করে।

বিশেষ করে ডাউকি ফল্ট সিস্টেমটি বিপজ্জনক। এটি শিলং প্লাটোর দক্ষিণ সীমানা বরাবর বিস্তৃত একটি রিভার্স (উল্টাকার) ফল্ট। অভ্যন্তরীণ গবেষণাগুলো দেখায়, এই ফল্ট এবং সঙ্গে যুক্ত মাধুপুর ফল্ট, সিলেট-অসম লাইনে ভবিষ্যতে ৭ মাত্রার বা তারও বেশি ভূমিকম্প সৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে বলে বহুদিন থেকে ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞরা বলে সতর্ক করে আসছেন।

গভীর দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা যায়, দেশে অতীতে বহু ভূমিকম্প ঘটেছেÑ ইতিহাস ও ভূতাত্ত্বিক ডেটা অনুযায়ী ডাউকি ফল্টের গড় পুনরাবৃত্তি সময় হয় প্রায় ৩৫০-৭০০ বছর। তাই, বিশেষজ্ঞরা মনে করেন যে, আমাদের এ-সংক্রান্ত সতর্কতা ও প্রস্তুতির ঘাটতি রয়েছে।

নরসিংদীর ৫.৭ মাত্রার ভূমিকম্প : নতুন ঝুঁকির সতর্কবার্তা :

আজ (২১ নভেম্বর, ২০২৫) সকালে নরসিংদীর মাধবদী এলাকায় রিখটার স্কেলে ৫.৭ মাত্রার ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে। খবর অনুযায়ী, ঢাকাসহ আশপাশের এলাকায় ভবন ভয়ংকরভাবে কেঁপে উঠেছে এবং লোকজন আতঙ্কিত হয়ে বাইরে বেরিয়ে এসেছে। অনেকেই বলেছেন, ভূমিকম্পের প্রচ- ঝাঁকুনি ছিল যা এখন পর্যন্ত ভূমিকম্পে বাংলাদেশে কেউ এমন ঝাঁকুনি স্মরণ করতে পারছে না। এখন পর্যন্ত ২ জন শিশু, একজন মেডিকেল ছাত্রসহ মোট ০৬ জনের মৃত্যু ও অনেক মানুষের আহত হবার খবর পাওয়া গেছে। ঢাকাসহ আশপাশের কয়েকটি শহরে অনেক ভবন হেলে পড়েছে এবং কয়েকটি ভবন ও দেয়াল ধসে পড়ে মানুষ হতাহত হয়েছে। বলা হচ্ছে, ৩০ বছরের মধ্যে শক্তিশালী ও ভয়াবহতম ভূমিকম্প এটি।

এ ধরনের মধ্যম মাত্রার ভূমিকম্প সাধারণভাবে বড় বিপর্যয়ের ইঙ্গিত নাও হতে পারে; তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটি অনুরূপ বড় ভূকম্পনের জন্য একটি সতর্ক সংকেতও। ঢাকার ভূমিকম্প-ঝুঁকি বিশেষজ্ঞরা দীর্ঘদিন ধরে সতর্ক করে আসছেন। বুয়েটের এক ভূতত্ত্ব বিশেষজ্ঞ জানিয়েছেন, মাধবদী ফল্ট এই ধরনের পরিমাণ বা তারও বেশি ভূমিকম্প সৃষ্টিতে সক্ষম।

ঢাকার মতো অপরিকল্পিত, জনবহুল শহরে, যেখানে অনেক ভবন পুরোনো ও ভূমিকম্প-রোধী কোড মেনে তৈরি হয়নি, ৬ বা তার বেশি মাত্রার ভূমিকম্প হলে ভয়াবহ ক্ষয়ক্ষতির সম্ভাবনা রয়েছে। বিশেষ করে পুরান ঢাকার ঘনবসতি, সরু গলি, খোলা জায়গার অভাব এবং বহু বছর ধরে অবৈধ বা কম মানের ইমারত নির্মাণ এবং শত বছরের জীর্ণ ও ঝুঁকিপূর্ণ ভবনে বসবাস এ সবই বিপদ বহুলাংশে বাড়িয়ে দেয়।

সরকারি প্রতিক্রিয়া হিসেবে ইতিমধ্যেই কিছু উদ্যোগ দেখা গেছে : রাজউক শহর পুনর্গঠন প্রকল্পে আছে কিছু স্থাপনার ভূমিকম্প-রোধী সংস্কার, ইমারত নীতিমালা তৈরি এবং ঝুঁকিপূর্ণ ইমারত চিহ্নিত করে খালি করা। কিন্তু আমদের ব্যাবসায়িক স্বার্থ এবং দুর্নীতি পূর্ণতার কারণে এসব ঠিকঠাক কার্যকর হচ্ছে কি? তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এমন অবস্থা থেকে বের হতেই হবে; নচেৎ ৬ মাত্রার ভূমিকম্প যে কি ভায়াবহ অবস্থা সৃষ্টি করে তে পারে তার কিছুটা নজীর রানাপ্লাজা ধ্বংসের সময় টের পেয়েছে জাতি। সেই হিসেবে পুরান ঢাকার শত শত জীর্ণ ভবনগুলোর জন্য এখনই সময় কিছু একটা করার।

যদিও সরকারের পক্ষ থেকে সাধারণ মানুষকে করণীয় হিসেবে সচেতনতামূলক পরামর্শ অব্যাহত আছে যেমন, ভূমিকম্প হলে দ্রুত নিরাপদ স্থানে যাওয়া, খোলা জায়গা, খোলামুখী পার্ক, মাঠে আশ্রয় নেওয়া এবং প্রাথমিক উদ্ধার কিট হাতে রাখা। এ ছাড়া, পরিবারে ভূমিকম্প পরিকল্পনা তৈরি রাখাÑ যেমন যে গৃহস্থালী সদস্যদের করণীয় হিসেবে আগে একেই সচেতনতা তৈরি করা, ভূমিকম্প হলে কে কখন কারা কমিউনিকেশন রাখবে, কোথায় মিলবে এগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

আন্তর্জাতিক ভূমিকম্প থেকে শিক্ষা : প্রতিবেশী দেশগুলোর অভিজ্ঞতা :

আমরা যদি বিশ্বব্যাপী ভূমিকম্প-দুর্ঘটনাগুলোর দিকে তাকাই, তাহলে নেপাল, তুরস্ক, আফগানিস্তান, পাকিস্তান ও ফিলিপাইন দেশের দুর্ঘটনাগুলো আমাদের জন্য বেশকিছু শিক্ষা দেয়। এই দেশগুলোতে বড় মাত্রার ভূমিকম্পের পর ভবন ধ্বংস, বিস্তীর্ণ গৃহহীনতা ও অবকাঠামোগত বিপর্যয় দেখা গেছে; উদ্ধার প্রক্রিয়া দীর্ঘস্থায়ী এবং পুনর্নির্মাণ ব্যয়বহুল হয়ে উঠেছে।

বাংলাদেশে আমাদেরও প্রস্তুতি হওয়া উচিত : দ্রুত উদ্ধার ও প্রতিক্রিয়া ইউনিট গঠন, প্রশিক্ষণ-কর্মশালা, জরুরি সরবরাহ (পানি, ওষুধ, খাদ্য) স্টক রাখা এবং পুনর্নির্মাণ পরিকল্পনায় ভূমিকম্প-সহনশীল নকশা প্রাধান্য দেওয়া।

সরকার এই অভিজ্ঞতাগুলো থেকে শিখতে পারে এবং জাতীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা নীতিগুলোতে ভূমিকম্প-প্রতিরোধকে অন্তর্ভুক্ত করতে পারে। আন্তর্জাতিক সাহায্য ও অভিজ্ঞতা বিনিময় (যেমন জাপান, নেপাল থেকে) অত্যন্ত মূল্যবান হবে।

প্রতীকী ব্যবস্থা: রোধ না পারলেও প্রস্তুতি নেওয়া যাবে :

যদিও ভূমিকম্প সম্পূর্ণ রোধ করা সম্ভব নয়, আমরা প্রতীকী ব্যবস্থা নিতে পারি :

১. নিরাপদ নির্মাণ নীতিমালা : ভবন ডিজাইন ও নির্মাণে ভূমিকম্প-রেসিলিয়েন্স (বধৎঃযয়ঁধশব ৎবংরষরবহপব) নিশ্চিত করার জন্য শক্তিশালী কোড ও নিয়ম প্রয়োগ করা। স্থানীয় এবং সরকারি ইউনিটগুলোর জন্য প্রশিক্ষণ এবং পর্যবেক্ষণ গুরুত্বপূর্ণ।

২. ভবন পুনর্বিন্যাস : পুরোনো ঝুঁকিপূর্ণ ভবন চিহ্নিত করে তাদের মেরামত বা ধ্বংসপূর্বক পুনর্নির্মাণ। বিশেষ করে পুরান ঢাকার অব্যবহৃত ও পুরোনো গলিবিহীন গড়নগুলোতে জরুরি নজর দেওয়া উচিত।

৩. স্থানীয় প্রস্তুতি ও সচেতনতা : কমিউনিটিভিত্তিক ভূমিকম্প প্রতিরোধ কমিটি গঠন, উদ্ধার দল গঠন এবং নিয়মিত ভূমিকম্প ড্রিল আয়োজন।

৪. স্কুল ও কলেজে শিক্ষা : ছাত্রী-ছাত্রীদের মধ্যে ভূমিকম্প সচেতনতা বৃদ্ধি করা। স্কুলে নিয়মিত ভূমিকম্প শিক্ষা অনুষ্ঠিত করা, শুধু একটি বিষয় হিসেবে নয়, বরং জীবন দক্ষতা অংশ হিসেবে নেওয়া।

৫. জনসংযোগ ও মিডিয়া : প্রচারের মাধ্যমে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করাÑ টেলিভিশন, রেডিও, সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করে মৌলিক তথ্য দেওয়া : ভূমিকম্প হলে কী করবেন, কোথায় আশ্রয় নেবেন, কীভাবে পরিবার পরিকল্পনা করবেন।

পূর্বাভাস ও ভবিষ্যৎ সতর্কতা : বিশেষজ্ঞদের দৃষ্টিভঙ্গি

বিশেষজ্ঞরা পুরোনো পরিসংখ্যান এবং ক্ষেত্রভিক্তিক গবেষণার ভিত্তিতে সতর্ক করেছেন : ডাউকি ফল্ট ও মাধুপুর ফল্ট অঞ্চলে বড় মাত্রার ভূমিকম্পের সম্ভাবনা রয়েছে এবং ঢাকার মতো শহর বিশেষভাবে ঝুঁকিপূর্ণ।

বুয়েটের প্রফেসর মেহেদি আহমেদ আনসারি জানিয়েছেন, ঢাকার মাটির গঠন এবং অনিয়মিত নগরায়ণ গভীরভাবে বিপদ বাড়ায়। এ ছাড়া, বিশেষজ্ঞ মেঘবিজ্ঞানী এবং ভূমি গতিশীলতা পর্যবেক্ষকরা বলছেন যে, শুধু ভবন নয়, আমরা সামাজিক প্রতিক্রিয়া ব্যবস্থাও শক্তিশালী করতে হবে : উদ্ধার প্রশিক্ষণ, সিগন্যাল-শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ এবং সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে ‘ভূমিকম্প প্রতিরোধ মানসিকতা’ গড়ে তুলতে হবে।

সংক্ষেপে ভূমিকম্পে মানুষের করণীয় কি কি

১. ঘরের ভেতরে থাকলে

শান্ত থাকুন এবং পরিবারের সবাইকে সঙ্গে নিয়ে টেবিল, ডেস্ক বা মজবুত আসবাবের নিচে আশ্রয় নিন। দরজা ও জানালা থেকে দূরে থাকুন। লিফট ব্যবহার করবেন না।

২. বাইরে থাকলে

ভবন, গাছ, বৈদ্যুতিক খুঁটি থেকে দূরে খোলা স্থানে দাঁড়ান। রাস্তায় গাড়িতে থাকলে নিরাপদ পাশে থামুন।

৩. কম্পন থামার পর

নিজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে আশপাশের মানুষকে সাহায্য করুন।

গ্যাস-বৈদ্যুতিক লাইনে ক্ষতি আছে কি না দেখুন।

জরুরি প্রয়োজনে অফিসিয়াল নির্দেশনা অনুসরণ করুন।

পরিবার ও সহকর্মীদের সঙ্গে জরুরি যোগাযোগের চেষ্টা করুন । 

উপসংহার

বাংলাদেশে ভূমিকম্প একটি অব্যাহত ও বাস্তব বিপদ। আমাদের ভৌগোলিক অবস্থান , পুরোনো অবকাঠামো, জনসংখ্যার ঘনত্ব এবং অপরিকল্পিত নগরায়ণ আমাদের ঝুঁকিপূর্ণ করে তোলে। ২১ নভেম্বর-২০২৫ এর নরসিংদীর ৫.৭ মাত্রার কাঁপুনি সেই ঝুঁকির একটি শংকাজনকভাবে প্রমাণ দিচ্ছে, আমাদের এখনই প্রস্তুতি নিতে হবে।

সরকার, বিশেষজ্ঞ এবং সাধারণ মানুষÑ তিনটি স্তরেই সমন্বিত কাজ করা জরুরি। নিরাপদ নির্মাণ নীতিমালা প্রয়োগ, পুরাতন ইমারতগুলোর পুনর্নির্মাণ এবং জনসচেতনতা বৃদ্ধি আমাদের সামনের যুদ্ধ। স্কুল-কলেজে ভূমিকম্প শিক্ষা ও সম্প্রদায়ভিত্তিক প্রস্তুতি শুধু এক বিকল্প নয়, আমাদের অস্তিত্বের প্রয়োজন।

আসুন, আজই এই ভূমিকম্প-চিন্তাকে গুরুত্ব দিইÑ কারণ প্রস্তুতি নেওয়া মানেই জীবনের মূল্য নেওয়া। ভবিষ্যতের আকস্মিক ধাক্কা মোকাবিলায় এখনই সময় কাজ শুরু করার।

রূপালী বাংলাদেশ

Link copied!