ঢাকা বৃহস্পতিবার, ২৭ নভেম্বর, ২০২৫

ঢাকাকে বাঁচাতে এখনই পদক্ষেপ জরুরি

হুমায়ুন আহমেদ নাইম
প্রকাশিত: নভেম্বর ২৭, ২০২৫, ১২:৩২ এএম

বর্তমানে যতগুলো প্রাকৃতিক দুর্যোগ রয়েছে তন্মধ্যে ভূমিকম্প সবচেয়ে ভয়ংকর একটি দুর্যোগ। কারণ অন্যান্য দুর্যোগের পূর্বাভাস সম্পর্কে জেনে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি গ্রহণ করতে পারলেও, ভূমিকম্পের কোনো আগাম সংবাদ আজ পর্যন্ত বিজ্ঞান দিতে পারেনি। যার ফলে হঠাৎ করে কয়েক সেকেন্ডের ভূকম্পনেই ধসে যেতে পারে একটা অঞ্চল। আর ভূমিকম্পের ঝুঁকির মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম ঝুঁকিপূর্ণ দেশ। তার মধ্যে ঢাকা অত্যন্ত বিপজ্জনক অবস্থানে রয়েছে। ঢাকার অধিকাংশ ভবনের মেয়াদ শেষ, নয়তো প্রায় শেষের দিকে। যার ফলে একটা কম্পনেই একসঙ্গে ধসে যেতে পারে ঢাকার অধিকাংশ ভবন। যা নগরবাসীসহ দেশবাসীকে শঙ্কিত করে তুলছে।

ঢাকার ঝুঁকির মূল কারণগুলোর মধ্যে প্রথমেই আসে অত্যধিক জনঘনত্ব। পৃথিবীর সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ শহরগুলোর একটি হিসেবে এখানে মাথাপিছু জায়গা খুব কম, রাস্তাগুলো সরু, খোলা জায়গা সীমিত। কোনো বিপর্যয়ের পর উদ্ধারকারী দল ঢুকতে পারবে কি না এটাই বড় প্রশ্ন। এর সঙ্গে অনিয়ন্ত্রিত ভবন নির্মাণ। যদিও জাতীয় ভবন কোড আছে, বাস্তবে তা মানা হয় খুবই সীমিত পরিসরে। বহু ভবন অপর্যাপ্ত ফাউন্ডেশন, নি¤œমানের উপকরণ এবং নীতিমালা না মেনে তৈরি। এমন ভবন বড় কম্পনে সহজেই ধসে পড়তে পারে।

তা ছাড়া, ঢাকার মাটির গঠনও ঝুঁকিপূর্ণ। পলিমাটির স্তরভিত্তিক গঠন ভূমিকম্পে ‘লিকুইফ্যাকশন’ ঘটাতে পারে, ফলে মাটি তরলের মতো আচরণ করে ভবন বসে যেতে পারে বা কাত হয়ে যেতে পারে। এমনকি জরুরি সেবা যেমন ফায়ার সার্ভিস, হাসপাতাল, অ্যাম্বুলেন্স ইত্যাদি বড় বিপর্যয়ে দ্রুত অচল হয়ে পড়তে পারে, কারণ তাদের সক্ষমতা শহরের সম্ভাব্য ক্ষতির তুলনায় খুবই সীমিত।

একটি বড় মাত্রার ভূমিকম্প হলে ঢাকার সম্ভাব্য পরিস্থিতি কল্পনা করাই কঠিন। কয়েক হাজার ভবন ভেঙে পড়ে রাস্তা আটকে দিতে পারে, বিদ্যুৎ-গ্যাস-টেলিকম সেবা অচল হয়ে যেতে পারে, হাসপাতালে রোগীর ঢল সামাল দেওয়া অসম্ভব হয়ে পড়বে। বিশেষত রাতের বেলায় এমন কম্পন হলে ক্ষয়ক্ষতি ও প্রাণহানি আরও বাড়বে। বহু মানুষ বাসার ভেতর আটকা পড়ে যাবে এবং উদ্ধারকাজ বহু এলাকায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা দেরিতে পৌঁছাতে পারে। সংকট মোকাবিলায় পরিকল্পনা না থাকলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে।

এ ভয়াবহ সম্ভাবনা এড়াতে হলে এখনই পরিকল্পিত পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রথমত, ভবন নিরাপত্তা নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি। জাতীয় ভবন কোড শুধু কাগজে নয়, বাস্তবে প্রয়োগ করতে হবে। পুরোনো ও ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের তালিকা তৈরি করে অগ্রাধিকারভিত্তিতে সংস্কার বা পুনর্নির্মাণ করতে হবে। নতুন সব ভবনে ভূমিকম্প-সহনশীল নকশা বাধ্যতামূলক করা অপরিহার্য। নির্মাণের প্রতিটি ধাপে তদারকি নিশ্চিত করতে হবেÑ নচেৎ কোড থাকা সত্ত্বেও তা বাস্তবে প্রয়োগ হবে না, যা ইতোমধ্যেই একটি বড় সমস্যা।

দ্বিতীয়ত, উদ্ধার সক্ষমতা আধুনিকায়ন করা জরুরি। বর্তমানে উদ্ধারযন্ত্র, ভারী মেশিন, পানির লাইন কাটার উপকরণ, থার্মাল ক্যামেরা, স্নিফার ডগ এসবের সংখ্যা সীমিত। বড় বিপর্যয়ে এগুলো যথেষ্ট হবে না। ফায়ার সার্ভিসকে আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী আধুনিক সরঞ্জাম ও প্রশিক্ষণ দিতে হবে। একই সঙ্গে প্রতিটি ওয়ার্ডে প্রশিক্ষিত স্বেচ্ছাসেবক দল গঠন করা হলে ভূমিকম্পের প্রথম কয়েক ঘণ্টায় তারা মূল্যবান জীবন বাঁচাতে পারে। হাসপাতালগুলোতে জরুরি ট্রমা সেন্টার, অতিরিক্ত বেড এবং রক্ত সরবরাহ ব্যবস্থাও জোরদার করা প্রয়োজন।

তৃতীয়ত, রাস্তা-পরিকল্পনা ও খোলা জায়গা বাড়ানোও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শহরের রাস্তা সরু, অনেক জায়গায় অবৈধ দখল, ভবনের ঘনত্ব অস্বাভাবিক, যা বিপর্যয়ের সময় উদ্ধারকাজে বড় বাধা সৃষ্টি করবে। প্রধান সড়কগুলোকে অবৈধ দখলমুক্ত করতে হবে, গলিগুলো প্রয়োজন অনুযায়ী প্রশস্ত করতে হবে। নতুন আবাসিক এলাকায় ন্যূনতম খোলা জায়গা বাধ্যতামূলক করা জরুরি। বিদ্যমান পার্ক, খেলার মাঠ ও স্কুল প্রাঙ্গণকে জরুরি আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে প্রস্তুত রাখতে হবে।

চতুর্থত, জনসচেতনতা বাড়ানোও অত্যন্ত জরুরি। দেশের বেশিরভাগ মানুষ ভূমিকম্পের সময়ে কী করতে হয় তা জানে না। আতঙ্কে দৌড়াদৌড়ি, লাফাঝাঁপি বা ভুল সিদ্ধান্ত নেওয়ায় হতাহতের সংখ্যা অনেক বাড়ে। পরিবারভিত্তিক জরুরি পরিকল্পনা, স্কুল ও অফিসে নিয়মিত ড্রিল, মিডিয়ায় সচেতনতা প্রচার করলে, তা দীর্ঘমেয়াদে জীবন বাঁচাতে কার্যকর ভূমিকা রাখে। বাড়িতে জরুরি ব্যাগ রাখা, বের হওয়ার পথ জানা এসব ছোট ছোট প্রস্তুতি বড় বিপর্যয়ে কাজে লাগে।

পঞ্চমত, গবেষণা ও পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থাকে আরও শক্তিশালী করতে হবে। ভূকম্পন পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র, মাটির গঠন মানচিত্র, ভবনের ঝুঁকি-ডেটাবেজ ইত্যাদি ছাড়া বৈজ্ঞানিক সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব নয়। অধিক সিসমিক স্টেশন স্থাপন, বিশেষজ্ঞ নিয়োগ, এবং বিশ্ববিদ্যালয়-গবেষণা কেন্দ্রকে তহবিল দেওয়া জরুরি।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলোÑ ঢাকাকেন্দ্রিক উন্নয়নকে দেশের অন্যান্য অঞ্চলে ছড়িয়ে দেওয়া। মূল কথা ঢাকাকে ডিসেন্ট্রালাইজেশন করা। আমাদের দেশের সকল উন্নয়ন কার্যক্রমই ঢাকানির্ভর। ফলে ঢাকার ওপর অতিরিক্ত জনচাপ সৃষ্টি হয়েছে, যা অতিনগরায়ণ ঘটাতে সবচেয়ে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে। তা ছাড়া শিক্ষা, চিকিৎসা, চাকরি, প্রশাসন সবকিছু ঢাকায় কেন্দ্রীভূত থাকায় মানুষ বাধ্য হয়ে এখানে আসে। এই প্রবাহকে থামাতে হবে। যদিও ঢাকা পূর্বের তুলনায় অনেক বড় হয়েছে এবং হচ্ছে। তবে তা যথেষ্ট নয়। ফলে বাকি বিভাগীয় শহরগুলোতে স্মার্ট নগরায়ণ গড়ে তুলতে পারলে ঢাকায় জনাধিক্য অনেক কমে যাবে। ফলে ভূমিকম্পসহ আকস্মিক যেকোনো দুর্যোগে ক্ষয়ক্ষতি কম ও এড়ানো সহজ হবে।

যেহেতু ভূমিকম্পের আগাম আভাস পাওয়া যায় না, তাই ভূমিকম্পের সময় ও এর পরবর্তী সময়ে যেন ক্ষতি কম হয় সেদিকে খেয়াল রাখা অত্যন্ত জরুরি। পরবর্তীতে কখন ঢাকা কিংবা বাংলাদেশ ভূমিকম্পে আক্রান্ত তা নিশ্চিতভাবে বলা কঠিন, তবে রাষ্ট্র ও জনগণের ঐকান্তিক প্রচেষ্টাই পারে ভূমিকম্পের ক্ষতি কমিয়ে আনতে এবং একটা সুস্থ নগরায়ণবান্ধব নগর গড়ে তুলতে।

হুমায়ুন আহমেদ নাইম
শিক্ষার্থী, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়