বাংলা সিনেমার মুকুটহীন সম্রাটখ্যাত অভিনেতা আনোয়ার হোসেন। ‘নবাব সিরাজউদ্দৌলা’ সিনেমায় নবাব চরিত্রে তার অভিনয় আজও দর্শকের মনে দাগ কেটে যায়। দীর্ঘ ৫২ বছর তিনি অভিনয় করেছেন। তার অভিনীত সিনেমার সংখ্যা পাঁচশ’র বেশি। অনবদ্য অভিনয়ে মুগ্ধ করেছেন দেশের মানুষকে।
নায়ক থেকে বাবা, দাদার চরিত্রে এসেও সমানতালে দক্ষতার সঙ্গে অভিনয় করেছেন তিনি। দেশের সিনেমার ইতিহাসে অন্যতম স্মরণীয় ও খ্যাতিমান অভিনেতা তিনি। ঢালিউড ইন্ডাস্ট্রিতে তিনি নবাব সিরাজউদ্দৌলা কিংবা মুকুটহীন নবাব নামেও খ্যাত। ২০১৩ সালের আজকের দিনে তিনি ইহলোকের মায়া ছেড়ে না ফেরার দেশে চলে যান। আজ আনোয়ার হোসেনের চলে যাওয়ার ১ যুগ।
আনোয়ার হোসেন যখন প্রাইমারি স্কুলের ছাত্র, তখন থেকেই সাংস্কৃতিক কর্মকা-ে যুক্ত হন। কলেজে ভর্তি হওয়ার পর মঞ্চ নাটকের সঙ্গে যুক্ত হন আনোয়ার হোসেন। কলেজের প্রথম বর্ষে থাকাকালীন ‘পদক্ষেপ’ নাটকে অভিনয় করেন তিনি। এরপর থেকেই অভিনয়ের প্রতি আনোয়ার হোসেনের দুর্বার আগ্রহ সৃষ্টি হয়।
কিন্তু চাইলেও তখন থেকে অভিনয়ে নিয়মিত হতে পারেননি আনোয়ার হোসেন। কলেজের প্রথম বর্ষের পরীক্ষা দিয়ে ‘সেলকন ইঞ্জিনিয়ারিং’ ফার্মে সুপারভাইজারের চাকরি নিয়ে ঢাকায় চলে আসেন তিনি। তবে এই চাকরি নিয়ে ঢাকা আসার পেছনে তার মূল উদ্দেশ্য ছিল অভিনয় করা। তাই ঢাকায় এসে তিনি নাটকের ভুবনে নিয়মিত যাতায়াত শুরু করেন। বেতারে অডিশন দেন এবং নির্বচিত হন ‘হাতেম তাই’ নাটকের জন্য। যদিও তাতে আনোয়ার হোসেনের চরিত্রটি ছিল খুব ছোট।
ধীরে ধীরে আনোয়ার হোসেন মঞ্চ নাটকের পরিচিত ব্যক্তি হয়ে ওঠেন। মঞ্চ নাটকে আনোয়ার হোসেনের দুর্দান্ত অভিনয় দেখে মুগ্ধ হন পরিচালক মহিউদ্দিন। সেই সুবাদে ১৯৬১ সালে মহিউদ্দিনের ‘তোমার আমার’ সিনেমায় ভিলেনের চরিত্রে অভিনয়ের সুযোগ পান আনোয়ার হোসেন। তার অভিনয় নজর কাড়ে চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্টদের।
নায়ক চরিত্রে আনোয়ার হোসেনের আত্মপ্রকাশ ঘটে ‘সুর্যস্নান’ সিনেমা দিয়ে। এরপরই নায়ক তথা ইতিবাচক চরিত্রে আনোয়ার হোসেন পরিচিত হয়ে ওঠেন। ষাটের দশকের প্রথম পাঁচ বছরে আনোয়ার হোসেন অন্তত দেড় ডজন সিনেমায় অভিনয় করেছেন। কিন্তু ব্যাপক পরিসরে জনপ্রিয়তা পাননি। তাকে তারকাখ্যাতি এনে দিয়েছিল ১৯৬৭ সালের সিনেমা ‘নবাব সিরাজউদ্দৌলা’।
বাংলার শেষ নবাবের জীবন অবলম্বনে নির্মিত এই সিনেমা দেশের সমস্ত প্রান্তে জনপ্রিয়তা লাভ করে। এই সিনেমায় নবাব সিরাজউদ্দৌলার ভূমিকায় অভিনয় করে আনোয়ার হোসেন কাক্সিক্ষত সাফল্যের দেখা পান। এরপর শুধু এগিয়ে যাওয়ার গল্প।
ঐতিহাসিক, রাজনৈতিক, সাহিত্যনির্ভর, শিশুতোষ, লোককাহিনিভিত্তিক, পোশাকি ফ্যান্টাসি, পরিচ্ছন্ন সামাজিক, পারিবারিক মেলোড্রামা, বক্তব্যধর্মী-সব ধরনের সিনেমাতেই অভিনয় করেছেন আনোয়ার হোসেন। দেশের বিখ্যাত সব নির্মাতার সিনেমায় দেখা গেছে তাকে।
সমৃদ্ধ অভিনয় জীবনে আনোয়ার হোসেনের প্রাপ্তি কম নয়। দর্শকদের অকৃত্রিম ভালোবাসার পাশাপাশি তিনি অর্জন করেছেন রাষ্ট্রীয় সম্মাননাও। দেশের ইতিহাসে প্রথম অভিনেতা হিসেবে তিনি একুশে পদক লাভ করেছিলেন ১৯৮৮ সালে। এ ছাড়া জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার প্রবর্তনের পর তিনিই শ্রেষ্ঠ অভিনেতা হিসেবে প্রথম পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৭৫ সালে পুরস্কারটি তিনি লাভ করেন ‘লাঠিয়াল’ সিনেমার জন্য। এরপর তিনি ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’ ও ‘দায়ী কে?’ সিনেমার জন্য শ্রেষ্ঠ পার্শ্ব চরিত্রের অভিনেতা হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান। ২০১০ সালে তাকে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে আজীবন সম্মাননা দেওয়া হয়। এ ছাড়াও আনোয়ার হোসেন দুইবার বাচসাস পুরস্কার এবং পাকিস্তানের নিগার পুরস্কারসহ অসংখ্য পুরস্কার-সম্মাননা লাভ করেছেন।