চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলার উত্তরাঞ্চলের একমাত্র নারী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ‘নারায়ণহাট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়’ আজ চরম অস্তিত্ব সংকটে। শিক্ষক ও অর্থসংকটে বিদ্যালয়টি কার্যত বন্ধ হওয়ার পথে। এবারের এসএসসি পরীক্ষায় প্রতিষ্ঠান থেকে মাত্র দুই শিক্ষার্থী অংশ নিয়ে উভয়েই অকৃতকার্য হয়েছে, যা চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডে একমাত্র প্রতিষ্ঠান হিসেবে শতভাগ ফেল করার রেকর্ড। এ নিয়ে ফলাফল প্রকাশের পর থেকেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শুরু হয় আলোচনা-সমালোচনার ঝড়। এক সময়কার গৌরবময় এ প্রতিষ্ঠান আজ রূপ নিয়েছে একটি অবহেলিত শিক্ষাকেন্দ্রে।
২০০১ সালে স্থাপিত বিদ্যালয়টি এক সময় এলাকার নারী শিক্ষায় অগ্রণী ভূমিকা রাখলেও বর্তমানে এটি পরিণত হয়েছে অবহেলিত এক শিক্ষাকেন্দ্রে। বড় মাঠ, লম্বা ভবন (সেমি পাকা), সবুজ গাছ-পালা বেষ্টিত মনোরম পরিবেশ সবই ছিল। তবে এখন বাস্তব চিত্র একেবারেই ভিন্ন।
সরেজমিনে দেখা যায়, খাতা-কলমে শিক্ষার্থী সংখ্যা ১৭০ জন হলেও উপস্থিত আছে মাত্র ৯ জন। ৭ জন শিক্ষকের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন মাত্র ৩ জন। শ্রেণিকক্ষগুলো ভাঙাচোরা, ছাদ চুঁইয়ে পানি পড়ে, প্রধান শিক্ষকের কক্ষও স্যাঁতসেঁতে। বিদ্যালয়ের মাঠে গবাদিপশুর অবাধ বিচরণ আর ঝোপঝাড়ে ছেয়ে আছে চত্বর। বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জানান, শিক্ষার্থী বাড়াতে সম্পূর্ণ বিনা মূল্যে পড়ালেখার সুযোগ দিলেও ভালো শিক্ষক না থাকায় বাড়ছে না শিক্ষার্থী।
প্রধান শিক্ষক সুখেন্দু বিকাশ দে বলেন, ‘বিদ্যালয়টি একক অনুদানে চলছে। সরকারিভাবে কোনো সহায়তা নেই। অল্প বেতনে মানসম্পন্ন শিক্ষক রাখা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে পাঠদানেও ঘাটতি। তাই, বাড়ছে শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া। সরকারি সহায়তা পেলে মানসম্পন্ন শিক্ষক রাখা সম্ভব। বাড়বে শিক্ষার্থীদের সংখ্যাও।’
সহকারী শিক্ষিকা আশাশ্রী নন্দী বলেন, ‘আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি। শিক্ষার্থীর স্বল্পতা পর্যাপ্ত শিক্ষক না থাকাসহ নানা সংকটে বিদ্যালয়ের সুনাম রক্ষা করা সম্ভব হচ্ছে না। সরকারি কোনো সহায়তা ছাড়া এই বিদ্যালয়ের ঘুরে দাঁড়ানো সম্ভব না।’
দশম শ্রেণির এক শিক্ষার্থী (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) বলেন, ‘স্যার-ম্যাডামরা অনেক সময় আসেন না, ক্লাস ঠিকঠাক হয় না। আমার পরিবার বলেছে, অন্য স্কুলে নিয়ে যাবে। আমরা ভালোভাবে পড়তে চাই।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক অভিভাবক বলেন, ‘একসময় মেয়েকে এই স্কুলে ভর্তি করিয়েছিলাম। কিন্তু শিক্ষক সংকট, দুর্বল ব্যবস্থাপনা আর অনুপযুক্ত পরিবেশ দেখে তাকে অন্য স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছি।’
বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতি শওকত হোসেন সিকদার বলেন, ‘আমাদের একান্ত অনুরোধ, শর্তসাপেক্ষে হলেও যদি সরকার শিক্ষকদের বেতনের ব্যবস্থা করে, তাহলে আমরা ভালো শিক্ষক রাখতে পারব। তাহলে শিক্ষার্থী বাড়বে, ফলাফলও ভালো হবে। আমরা এতটুকু সুযোগ চাই।
এলাকাবাসীর দাবি, দ্রুত সরকারি সহায়তা, মানসম্পন্ন শিক্ষক নিয়োগ এবং অবকাঠামোগত উন্নয়নের মধ্য দিয়ে বিদ্যালয়টি আবার আগের গৌরব ফিরে পাক। অন্যথায়, এটি হয়ে উঠবে আরও একটি হারিয়ে যাওয়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নাম।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা ড. সেলিম রেজা বলেন, বিদ্যালয়টি নন এমপিওভুক্ত একটি প্রতিষ্ঠান। আমরা প্রতিষ্ঠানটি এমপিওভুক্তির জন্য দুইবার আবেদন করেছিলাম। কিন্তু, এমপিওভুক্তি করা সম্ভব হয়নি। যার প্রেক্ষিতে শিক্ষকদের সংখ্যা কমতে শুরু করেছে। আর সেই প্রভাবে ছাত্র-ছাত্রীরাও কমতে শুরু করেছে। খাতা-কলমে ১৭০ জন শিক্ষার্থী থাকলেও আমরা সর্বসাকুল্যে ৪০-৪৫ জনের ওপরে শিক্ষার্থী কখনোই পায়নি। এবার এসএসসি পরীক্ষায় দুইজন শিক্ষার্থী অংশগ্রহণ করে দু’জনই ফেল করেছে। যেটা বিদ্যালয়টির জন্য আরেকটি বড় দুঃসংবাদ। বিদ্যালয়টিকে টিকিয়ে রাখতে আসলে সরকারি সহযোগিতা প্রয়োজন।
আপনার মতামত লিখুন :