ঢাকা শনিবার, ০২ আগস্ট, ২০২৫

হুমকিতে ৪০০ কোটি টাকার বিদ্যুৎ প্রকল্প

গজারিয়া (মুন্সীগঞ্জ) প্রতিনিধি
প্রকাশিত: জুলাই ২৫, ২০২৫, ১২:২৩ এএম

মুন্সীগঞ্জের গজারিয়া উপজেলায় ৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য অধিগ্রহণ করা জমি ও নির্মিত বাঁধ ঘেঁষে মেঘনা নদী থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করছে একটি প্রভাবশালী সিন্ডিকেট। দীর্ঘ এক মাস ধরে চলা এই বালু উত্তোলনের ফলে প্রকল্প রক্ষাবাঁধে ধস দেখা দিয়েছে, ঝুঁকিতে পড়েছে শত শত কোটি টাকার সরকারি এই প্রকল্প।
প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানান, ৪০০ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত রক্ষাবাঁধের পাশ ঘেঁষে যেভাবে বালু কাটা হচ্ছে, তাতে যেকোনো সময় ধসে যেতে পারে পুরো প্রকল্প এলাকা।

অভিযোগ উঠেছে, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সাবেক একান্ত সচিব মিয়া নুরুদ্দিন অপু, জেলা যুবদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মজিবুর রহমান এবং জেলা ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি আমিনুল ইসলাম ওরফে জসিমের নেতৃত্বে একটি সিন্ডিকেট এই বালু উত্তোলনে জড়িত। এরা আদন ড্রেজিং লিমিটেড নামে একটি প্রতিষ্ঠানের আড়ালে কার্যক্রম চালাচ্ছে। প্রতিষ্ঠানটির মালিক মিয়া নুরুদ্দিন অপুর বড় বোন সেলিনা আক্তার হলেও প্রকৃতপক্ষে অপুই এটি পরিচালনা করছেন।

প্রকল্প এলাকায় সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, রক্ষাবাঁধ থেকে মাত্র ৬০-৭০ ফুট দূরে প্রায় ৩০-৩৫টি ড্রেজার দিয়ে বালু উত্তোলন চলছে। ড্রেজারগুলো তিন ভাগে ভাগ হয়ে একযোগে কাজ করছে। বালু সংগ্রহ করে বাল্কহেডের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন এলাকায় পাঠানো হচ্ছে। এ সময় দেখা যায়, ১০-১২ জন অস্ত্রধারী যুবক ট্রলারে করে মহড়া দিচ্ছে, স্থানীয়দের মাঝে আতঙ্ক বিরাজ করছে।

স্থানীয়রা জানান, যারা বালু কাটছে তারা সবাই বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত এবং খুবই প্রভাবশালী। কেউ প্রতিবাদ করলে হুমকি দেওয়া হয়, এমনকি প্রাণনাশের আশঙ্কাও থাকে। অথচ আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ও বালুমহাল ইজারা নিয়ে বালু কাটা হয়েছে, তবে কখনো প্রকল্পের এত কাছ ঘেঁষে নয়।

২০১৬ সালে রুরাল পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড গজারিয়ার ইমামপুর ইউনিয়নের ষোলআনি ও দৌলতপুর মৌজায় ২৫৪.০১ একর জমি অধিগ্রহণ করে কয়লাভিত্তিক ৩৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রকল্প গ্রহণ করে। পরে এটি পরিবর্তন করে ৬০০ মেগাওয়াট গ্যাসভিত্তিক কম্বাইন্ড সাইকেল প্লান্ট ও ৬০ মেগাওয়াটের একটি সৌর বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের সিদ্ধান্ত হয়। প্রকল্প এলাকা রক্ষায় নদী তীরজুড়ে ব্লক বসিয়ে মজবুত বাঁধ তৈরি করা হয়েছিল। অথচ এখন সেই বাঁধেই ফাঁটল দেখা দিয়েছে, কিছু স্থানে ব্লকও ধসে পড়েছে।

জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ১২৮ একর নদীতে বালুমহাল ইজারা দেওয়া হয় আদন ড্রেজিং লিমিটেডকে। ইজারার শর্ত ছিল নদীর তীর থেকে ৬০০ ফুট ভেতরে বালু উত্তোলন এবং প্রকল্প এলাকা থেকে নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রাখা। বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, এই শর্ত পুরোপুরি উপেক্ষা করে বাঁধ ঘেঁষেই বালু কাটা হচ্ছে।

প্রকল্পের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. সেলিম ভূঁইয়া বারবার জেলা প্রশাসক ও পুলিশ প্রশাসনকে চিঠি দিয়েও কোনো কার্যকর ব্যবস্থা পাননি। বর্তমানে প্রকল্পের নির্বাহী পরিচালক ড. সুসান্ত কুমার সাহা বলেন, ‘৪০০ কোটি টাকার প্রকল্প রক্ষা করতে এখনই জরুরি ব্যবস্থা দরকার। আমরা মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।’

জেলা প্রশাসক ফাতেমাতুল জান্নাত জানান, সম্প্রতি বালু উত্তোলনের বিষয়ে অভিযান চালানো হয়েছে। তিনি বলেন, ‘নির্ধারিত সীমানার বাইরে বালু কাটলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

একটি রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ বিদ্যুৎ প্রকল্প রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের বালু দস্যুতার কারণে চরম ঝুঁকিতে পড়েছে। এ অবস্থায় অবিলম্বে প্রশাসনের কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ প্রয়োজন, অন্যথায় দেশ হারাতে পারে শত কোটি টাকার অবকাঠামো এবং জনগণ হারাবে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিদ্যুৎ কেন্দ্র।